করোনার মধ্যেও বাড়ির দাম বাড়ল কেন?
মাত্র এক দশক আগেও বৈশ্বিক মন্দার সময় বাড়ির দাম কমে দিয়েছিল গড়ে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে, সেসময় কিছুদিনের ব্যবধানে কয়েক ট্রিলিয়ন (১ ট্রিলিয়ন=১ লাখ কোটি) ডলার হারিয়েছিল বিশ্বের বৃহত্তম এ সম্পদ শ্রেণি। যদিও এবারের অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান ভুক্তভোগী হাউজিং মার্কেট নয়, তারপরও করোনার ধাক্কায় ১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে বড় মন্দার মুখোমুখি হওয়ায় বাড়ির মালিকেরা আরও বড় আঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
তবে তাদের সেই শঙ্কা ভুলই প্রমাণিত হয়েছে বলা যায়। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে মধ্যম ও উচ্চ আয়ের বেশিরভাগ দেশেই বাড়ির দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। ধনী দেশগুলোতে বাড়ির বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। মহামারির প্রথম দিকে ডেভেলপার ও বাড়ি ব্যবসায়ীদের শেয়ারের দাম কিছুটা কমলেও ইতোমধ্যেই তার বেশিরভাগ আগের জায়গায় ফিরে গেছে।
মহামারির মধ্যে কিছু বাজার রীতিমতো ফুলেফেঁপে উঠেছে। এবারের আগস্টে জার্মানিতে বাড়ির দাম গত বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি ছিল। দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রেতাদের জন্য নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনকে। আমেরিকায় চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রতি বর্গফুটের দাম বেড়েছে ২০০৭-০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকট পরবর্তী সময়ে যেকোনও তিনমাসের তুলনায় দ্রুতগতিতে।
মহামারির মধ্যেও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে বাড়ির মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনটি উপাদান ব্যাখ্যা করা যায়- মুদ্রানীতি, আর্থিক নীতি ও ক্রেতার রুচি পরিবর্তন।
প্রথমে মুদ্রানীতির কথা ধরা যাক। চলতি বছর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতিগত সুদের হার (পলিসি ইন্টারেস্ট রেট) কমিয়েছে গড়ে দুই শতাংশ করে। এতে কমে গেছে বন্ধকী দেনার পরিমাণ। মার্কিন নাগরিকেরা এখন ৩০ বছর মেয়াদে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ স্থির সুদের হারে বাড়ি বন্ধক নিতে পারছেন। চলতি বছরের শুরুতেও এর হার ছিল ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুদের হার কমা এবং বাড়ির মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে দৃঢ় যোগসূত্র রয়েছে। অনেক গ্রহীতাই এখন অপেক্ষাকৃত বড় সম্পত্তি বন্ধক নিতে পারছেন। অনেকের জন্য বিদ্যমান ঋণ পরিশোধ সহজ হয়ে গেছে। বাড়ির মালিকেরাও তাদের সম্পত্তির পেছনে বাড়তি খরচে না করছেন না। কারণ, অন্যান্য সম্পদের খরচ অনেকটাই কমে গেছে।
দ্বিতীয় উপাদান আর্থিক নীতি। বাড়ির মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত মন্দার সময় মানুষজন চাকরি হারানোয় আয় কমে যায়, দখলীকরণের (ফোরক্লোজার) প্রভাবে নেমে আসে বাড়ির দাম। কিন্তু, এবার ধনী দেশের সরকারগুলো পারিবারিক আয় স্থিতিশীল রেখেছে। মজুরি ভর্তুকি, দীর্ঘমেয়াদী ছুটি প্রকল্প, বর্ধিত কল্যাণ সুবিধার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৫ শতাংশ পর্যন্ত। বহু মানুষ চাকরি হারানোর পরেও চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জি৭ গ্রুপভুক্ত দেশগুলোতে পরিবারগুলোর নিষ্পত্তিযোগ্য আয় ছিল মহামারির শুরুর তুলনায় প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার বেশি।
হাউজিং মার্কেট টিকিয়ে রাখতে আরও কিছু পদক্ষেপ বেশ কাজে এসেছে। যেমন- স্পেন ঋণগ্রহীতাদের বন্ধকী কিস্তি স্থগিত করেছে। জাপানের আইনপ্রণেতারা ব্যাংকগুলোকে বন্ধকী সম্পত্তির মূল্য পরিশোধের সময় পিছিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। নেদারল্যান্ডস সাময়িকভাবে সম্পত্তির দখল নেয়া নিষিদ্ধ করেছে।
বাড়ির ব্যবসায় বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে তৃতীয় কারণটি ভোক্তার পছন্দের সঙ্গে সম্পর্কিত। ২০১৯ সালে ওইসিডি’র (অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা) অন্তর্ভুক্ত মধ্যম আয়ের দেশগুলোর বাসিন্দারা আয়ের ১৯ শতাংশ ব্যয় করেছেন বাড়ির পেছনে। বর্তমানে এক পঞ্চমাংশ কর্মী বাড়িতে বসে কাজ করছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনেকে সুন্দর বাড়িতে সময় কাটাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। মানুষজন তাদের বাসস্থানের উন্নয়নে নজর দেয়ায় বাড়ির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাড়ির বর্ধিত মূল্যের এই ধারা কি চলতেই থাকবে? সরকারগুলো তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি ধীরে ধীরে গুঁটিয়ে নিতে শুরু করেছে। এগুলো পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পর কী হবে তা কেউ জানে না। উচ্চমাত্রায় অর্থনৈতিক অনিশ্চিয়তা বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়। অতীতে মন্দাগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হলেও সেই তুলনায় পিছিয়ে থাকে নির্মাণখাত। সেই হিসাবে, এবারের মন্দার আঘাত সামলাতে আরও বহুদিন লেগে যেতে পারে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
কেএএ/পিআর