ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মার্কিন অর্থনীতি, টেকসই হবে কতটা?
২ এপ্রিল প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের মাসিক কর্মসংস্থান প্রতিবেদনে বেশ সন্তোষজক চিত্র পাওয়া গেছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রে নয় লাখের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। মার্চের প্রথমার্ধে যখন জরিপটি পরিচালনা করা হয় তখনকার অর্থনৈতিক চিত্র পাওয়া যায় এ প্রতিবেদনে।
গত বছরের আগস্টের পর এটিই দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থা। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহের ‘হাই ফ্রিকোয়েন্সি’ তথ্য-উপাত্তের দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রতিদিনের রেস্টুরেন্টের ডিনার থেকে শুরু করে গুগল-সার্চের আচরণ, সবকিছু এটাই দেখায় যে ওই সময়ের পর থেকে কিছু যদি তরান্বিত হয়ে থাকে তা হলো ঘুরে দাঁড়ানো। যুক্তরাষ্ট্রে মহামারি-পরবর্তী অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে।
এই ঘুরে দাঁড়ানোকে স্বাগত জানাতে হবে, কারণ মহামারি-পূর্ব অবস্থায় পৌঁছাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশের এখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মারাত্মক রকমের। এমনকি কর্মসংস্থানের সর্বশেষ সংখ্যার পরও, মহামারি-পূর্ব অবস্থার চেয়ে এখনও ৮০ লাখ কম মানুষ চাকরিতে আছে।
চাকরি হারানোর ঘটনা স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যেই বেশি ঘটেছে। ছোট ব্যবসাগুলোর তিন ভাগের একভাগ এখনো বন্ধ। করোনাভাইরাস মহামারির আগের অবস্থার চেয়ে দারিদ্রের হার এখনও বেশি, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারগুলোতে। এছাড়া স্কুল বন্ধ হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব শিশুদের শিক্ষায় কয়েক দশক পর্যন্ত থেকে যেতে পারে।
হাই ফ্রিকোয়েন্সি তথ্য-উপাত্তের বড় অংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে। এসব তথ্যে দেখা গিয়েছিল, মার্কিন অর্থনীতি খাদের কিনার থেকে ধসে পড়ছে। কিন্তু এক বছর পরে একটি দ্রত শক্তিশালী হতে থাকা অর্থনীতির এখন চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি।
গুগলের ‘মোবিলিটি’ তথ্য ব্যবহার করে ‘দ্য ইকোনোমিস্ট’ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটি সূচক তৈরি করেছে। এতে লোকজনের কর্মস্থলে, স্টেশনে, দোকানে ও অবকাশ যাপন কেন্দ্রে যাওয়া সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এক মাস আগে এই সূচকটি মহামারি-পূর্ব অবস্থার চেয়ে ৩০ শতাংশ নিচে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তা ২০ শতাংশ নেমে এসেছে।
আরেকটি হাই-ফ্রিকোয়েন্সি তথ্যেও একই অবস্থা দেখা গেছে। আমেরিকান বিমানবন্দরগুলোর মাধ্যমে যাত্রীদের ভ্রমণ দ্রুত গতিতে বাড়ছে। দ্য ইকোনমিস্ট ‘ওপেনটেবিল’ নামে একটি বুকিং প্লাটফর্মের পরিসংখ্যানও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে।
ফেব্রুয়ারিতে রেস্টুরেন্টে ডিনারের হার স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ৪৮ শতাংশ কম ছিল। কিন্তু এপ্রিলে অবস্থার উন্নতি হয়ে তা দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশ কম। হোটেলে রুম বুকিং দেয়াও দ্রুত গতিতে বাড়ছে। উৎপাদন ও সেবা কার্যক্রমও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানুষজন আগের চেয়ে বাইরে বেশি বের হচ্ছে, একে অন্যের সঙ্গে দেখা করছে। সফলভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি পরিচালনার ফলে কিছু কিছু এলাকায় বিধিনিষেধ তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। আর মানুষ যখন বাসা থেকে বের হচ্ছে, তখন তারা টাকাও খরচ করছে। ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চে আমেরিকানদের অর্থ খরচের পরিমাণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
মোদ্দা কথা হলো, ২০২১ এর দ্বিতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। মার্চের শেষ নাগাদ, যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি মহামারি-পূর্ব অবস্থার চেয়ে চার শতাংশ কম ছিল। এটি এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং অনেক ধনী দেশের চেয়েও তা ভালো।
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, চলতি বছরে দেশটিতে জিডিপি ছয় শতাংশ বা তারও বেশি বৃদ্ধি পাবে। আর যদি তা হয়, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিমাসে ১০ লাখ করে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বেকারত্বের হার মহামারি-পূর্ব অবস্থায় দ্রুতই পৌঁছাতে পারবে।
তবে এখনও দুটি কারণে এই অগ্রগতি হোঁচট খেতে পারে। এর একটি অর্থনৈতিক ‘দাগ’ এর সঙ্গে সম্পর্কিত। কিছু অর্থনীতিবিদের আশঙ্কা, মহামারি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ক্ষমতাকে কমিয়ে দিয়েছে। যদি অনেক ব্যবসা দেউলিয়া হয়ে যায়, তাহলে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অনেক আমেরিকান চাকরিতে ফিরে যেতে পারবেন না।
এখন পর্যন্ত ঋণগ্রস্ত হওয়ার তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোট বাণিজ্যিক দেউলিয়াত্বের পরিমাণ ১৫ শতাংশ কম ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপক প্রণোদনার ফলে ফার্মগুলো তাদের বিল পরিশোধ করতে পেরেছে, এছাড়া অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়া নিতে ছাড় দিয়েছেন।
২০২১ সালেও দেউলিয়াত্বের হার কমই রয়েছে। তবে এটা সামনের মাসগুলোতে বাড়বে কিনা তা কেউ জানে না। কারণ প্রণোদনা দেয়া শেষ হয়ে যাচ্ছে আর বাড়িওয়ালারাও তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইবেন।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, ভ্যাকসিন প্রয়োগ চললেও সংক্রমণ আবার শুরু হতে পারে। করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরনগুলোর ব্যাপারে শঙ্কা রয়েছে। যেমন ব্রিটেনে পাওয়া ধরনটি আরও দ্রুত ছড়াতে সক্ষম।
‘ব্রিটিশ ধরনের’ সংক্রমণ স্বয়ং ব্রিটেনেই কমছে না।যুক্তরাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণ আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু জায়গায়, যেমন শিকাগো ও নিউ জার্সিতে প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা আবার স্থগিত করা হয়েছে।
এর ফলে ঘুরে দাঁড়ানোর গতি কিছুটা ধীর হয়েছে, কিন্তু থেমে যায়নি। ব্যাপকমাত্রায় ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে সংক্রমণ ও হাসপাতালে ভর্তির হার কমেছে।
গুগল-ইকোনমিস্টের অর্থনৈতিক সূচকে দেখা গেছে, ভাইরাসের ব্রিটিশ ধরন অনেক বেশি ছড়িয়েছে এমন দুটি রাজ্য- মিশিগান ও ফ্লোরিডায় অর্থনীতির গতি কিছুটা কমেছে, যদিও তা বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় এখনো শক্তিশালী। পথে অচলাবস্থা আসবে, তবে আশা করা যায় অর্থনীতির সুখবরও আসতে থাকবে।
সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট
এমকে/এএএইচ