আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তে ‘মলমূত্রের মহিমা’
করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে ডুবতে বসেছে ভারত। বিভিন্ন রাজ্যে হাসপাতালে তিলধারণের ঠাঁই নেই, নেই ওষুধ, অক্সিজেন সঙ্কট চরমে, বিদেশে রফতানি বন্ধ করেও জনগণের কাছে ঠিকঠাক টিকা পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। অথচ এমন সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তেও সেখানে চলছে গোবর-গোমূত্রের মাধ্যমে করোনা চিকিৎসার নামে ভণ্ডামি! তাতে পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছে ভারত সরকারই। এর প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, সমালোচনা চলছে খোদ ভারতীয় গণমাধ্যমেই।
সোমবার কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘মলমূত্রের মহিমা’ নামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ হয়েছে। এতে ভারতে করোনা চিকিৎসার নামে গোবর-গোমূত্র মাখামাখির সাম্প্রতিক কাণ্ডগুলোর কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সম্পাদকীয়তে আনন্দবাজার লিখেছে, কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে মৃত্যুমিছিল অব্যাহত। হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন, ওষুধ, টিকার অভাবে এখনো অনেক রাজ্য ধুঁকছে। কিন্তু গুজরাটের তেতোড়া গ্রামের একটি কোভিড কেন্দ্রকে সেই হাহাকার স্পর্শ করেনি। কারণ, গোয়ালঘরে গড়ে তোলা কেন্দ্রটিতে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে সম্পূর্ণ ‘দেশীয়’ পদ্ধতিতে, গোমূত্র প্রয়োগে। শুধু গুজরাটেই নয়, উত্তর প্রদেশের এক বিজেপি নেতাও সম্প্রতি গোমূত্র পানের পক্ষে জোর সওয়াল করেছেন। ‘ভক্ত’দের কেউ গোমূত্রের ফোঁটা নাকে ফেলছেন, কেউ গায়ে গোবর মেখে দুধ দিয়ে গোসল করছেন।
পত্রিকাটি বলছে, অন্য সময় এমন কর্মকাণ্ডকে শিক্ষার অভাব, একশ্রেণির মানুষের অবৈজ্ঞানিক আচরণ বলে উড়িয়ে দেয়া যেত। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারির সময় একটি গণতান্ত্রিক দেশের প্রশাসন যখন নিজেই এতে পরোক্ষ প্রশ্রয় দেয়, তখন আশঙ্কা হয়, এর পেছনে অন্য কোনো বৃহত্তর কুমতলব রয়েছে। আশঙ্কাটি অমূলক নয়। স্থানীয় প্রশাসনই ওই কোভিড কেন্দ্রটি চালানোর অনুমতি দিয়েছে। শুধু এটিই নয়, এক বছর ধরে বিজেপি নেতারা গোমূত্র এবং গোবর নিয়ে নানা ‘অমূল্য উপদেশ’ বিতরণ করেছেন। কিন্তু এটি যে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক, তা বলার মতো প্রবল স্বর শীর্ষ নেতৃত্বের গলায় শোনা যায়নি। বরং ভারতের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় হৃষিকেশের এইমসকে করোনা রোগীদের দ্রুত সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে গায়ত্রী মন্ত্র জপ, প্রাণায়ামের (শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের ব্যায়াম) প্রভাব নিয়া গবেষণার জন্য অর্থ সাহায্য করছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপির সভাপতি নিজেই গোমূত্র পানের সপক্ষে বলেছিলেন।
মহামারির মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা ছড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে আনন্দবাজারের সম্পাদক বলেন, ভারতের মতো দেশে অবৈজ্ঞানিক প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয়ার একটি সুবিধা হলো, এর মাধ্যমে প্রায় বিনা পরিশ্রমে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। কোভিড-১৯’র প্রতিষেধকের যথাযথ বণ্টন নিয়ে ভারতে বিজেপি সরকারের ‘অপদার্থতা’ প্রকাণ্ড। চিকিৎসা পরিকাঠামো ক্ষেত্রের চিত্রটিও একই রকম। এমতাবস্থায় এই ‘বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি’ জনপ্রিয় হলে সরকারের ক্ষতি নেই। বরং, কিছু মানুষের দৃষ্টি এই নিদারুণ সঙ্কট এবং সরকারি ব্যর্থতা থেকে অন্যদিকে সরতে পারে।
সম্পাদকীয়র শেষাংশে বলা হয়েছে, সব দোষ সরকারের ওপর চাপিয়ে লাভ নেই। ফরাসি দার্শনিক জোসেফ দ্য মেস্ত্র্ একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন, মানুষ তার যোগ্য সরকারই পেয়ে থাকে। ভারতীয় নাগরিকদের একটি বড় অংশ আজও ওঝা, গুনিন, তুকতাক, মাদুলি, কবচসহ নানা অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের ওপর আস্থা রাখে। না হলে ‘গোমূত্রের গুণাবলি’ জনপ্রিয়তা পেত না। কলকাতার জোড়াসাঁকোতে বিজেপি নেতার কথায় গোমূত্রের ভাঁড় হাতে উঠে আসত না। এটি শুধু যে শিক্ষার অভাব তা নয়, এটি যুক্তিবুদ্ধির অভাব। আরও সহজ ভাষায় বললে, কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। ভারতীয় নাগরিকদের একাংশের মধ্যে এখনো এই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব যথেষ্ট এবং এর জন্যই তাদের ভুল বোঝানো সহজ। ‘স্বৈরাচারী শাসক’ও সে কারণে এই শ্রেণিকে পছন্দ করে- যে প্রশ্ন করবে না, পাল্টা যুক্তি দেখাবে না বরং অন্ধ অনুকরণ করবে। গোমূত্র পানের ঘটনাগুলোকে তাই বিচ্ছিন্ন বলে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই।
কেএএ/এমকেএইচ