আফ্রিকাকে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে জড়ালো চীন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১৪ পিএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২১

আফ্রিকায় চীনের ঋণে যেমন উদ্বেগ বাড়ছে, সেইসঙ্গে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনও জেঁকে বসেছে। তবে এবার আফ্রিকার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় ঘটাতে যাচ্ছে চীন। আর সেটি হচ্ছে, আর্থিক প্রতিশ্রুতি হ্রাস করে ভ্যাকসিন কূটনীতিকে জোরদার করা।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, সম্প্রতি চীন-আফ্রিকা ফোরামের অর্থনৈতিক সহযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এক ভিডিও বক্তৃতায় প্রতিশ্রুতি দেন যে, আফ্রিকাকে অনুদান হিসেবে আরও ১০০ কোটি ডোজ করোনা প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হবে।

বিশ্বে টিকা বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধনী দেশগুলো টিকার নিয়ন্ত্রক হওয়ায় দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা সরবরাহে শুরু থেকেই বৈষম্য দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আফ্রিকাকে বিপুল পরিমাণ টিকার ডোজ দেওয়ার ঘোষণা দিলেন শি জিনপিং।

jagonews24

ওই ফোরামে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, মানুষ ও তাদের জীবনকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে, করোনা টিকার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ভাগাভাগি করতে হবে। টিকা দেওয়ার ব্যবধান কমিয়ে আনতে আফ্রিকায় টিকা সরবরাহ নিশ্চিত ও সাশ্রয়ী করতে হবে বলেও জানান তিনি।

শি জিনপিং বলেন, সর্বমোট ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা হবে। এর মধ্যে চীন থেকে সরাসরি ৬০ কোটি ডোজ পাঠানো হবে। আর বাকি ৪০ কোটি ডোজ অন্যান্য উৎস থেকে আসবে যেমন- আফ্রিকার চীনা কোম্পানিগুলো থেকে উৎপাদন করা হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দশক ধরে বেইজিং আফ্রিকার প্রধান বাণিজ্যিক সহযোগী হলেও এবার তাদের কৌশল নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে। যেখানে করোনা সংকট ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য একধরনের মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের কাছে।

নর্থ ক্যারোলাইনার ওয়্যাক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক বেনাবদাল্লাহ বলেন, শি জিনপিংয়ের হ্রাসকৃত আর্থিক প্রতিশ্রুতি আশ্চর্যজনক নয় কারণ আমরা এরইমধ্যে গত কয়েক বছরে তার লক্ষণ দেখেছি।

তিনি বলেন, চীন এখন আফ্রিকার ব্যাপারে আরও সতর্কতার একটি পর্যায়ে যাচ্ছে, দুই দশকে ব্যাপক হারে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঋণের অর্থায়নের পর।

কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্লোস লোপেস লক্ষ্য করেছেন, কথিত ঋণের ফাঁদ, প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ এবং তাদের সস্তা পণ্য রপ্তানি করার জন্য আফ্রিকানদের সুবিধা নেওয়া সম্পর্কে পশ্চিমের দীর্ঘকাল ধরে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সতর্ক অবস্থানে চলে যাচ্ছে চীন।

তিনি বলেন, বেইজিং নতুন কৌশল অবলম্বন করে নেতিবাচক প্রভাব কতটা কমে বা প্রতিক্রিয়া কী আসে কিংবা পূর্বের সমালোচনা থেকে দৃষ্টিভঙ্গি ফেরাতে চায়।

তিনি আরও বলেন, আমরা আরও টেকনোক্র্যাটিক পদ্ধতির পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি, স্পষ্টতই আরও সতর্কতা, নরম শর্ত ব্যবহার করা এবং নতুন করে কৌশল অবলম্বন করা।

 

চীন সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে ভ্যাকসিনের ৬০০ মিলিয়ন অনুদান এবং ৪০০ মিলিয়ন স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করবে। এরই মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করেছে দেশটি।

চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, আফ্রিকায় সেবা সহায়তার জন্য ১৫০০ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকেও পাঠানো হবে।

jagonews24

শি জিনপিং এমন সময় এ প্রতিশ্রুতি দিলেন, যখন চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতি ব্যাপক বিশ্লেষণের মধ্যে পড়েছে। তবুও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন-আফ্রিকা সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ কার্লোস ওয়া বলেছেন যে যদি আফ্রিকায় ভ্যাকসিনেশন বাড়ানো সত্যিই বিশ্বব্যাপী মহামারিটির ধীরে ধীরে সমাপ্তিতে অবদান রাখে তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হতে পারে। এটি সম্ভাব্য হচ্ছে যে, চীন তার সীমানা ছাড়িয়ে মহামারি শেষ করতে অবদান রেখেছে।

থিংকট্যাংক এলএসই আইডিয়াস এর পরিচালক ক্রিস অ্যাল্ডেন বলেন, এই ঘোষণায় চীন আশা করবে একটি সহকর্মী উন্নয়নশীল অঞ্চলের তীব্র সংকট মোকাবিলা করে এবং একইসঙ্গে আফ্রিকাজুড়ে ভ্যাকসিন তৈরি এবং সরবরাহ করার ক্ষমতা প্রদর্শন করে নৈতিক অবস্থান আরও শক্ত করতে পারবে। চীনা ফার্মাসিউটিক্যালসের জন্য আরও বাজারের সুযোগ উন্মুক্ত করবে এই কূটনৈতিক তৎপরতা।

সমালোচকরা অবশ্য যুক্তি দেন যে আফ্রিকায় ভ্যাকসিনের ওপর শি’র জোর নতুন নয়। গত ফেব্রুয়ারিতে আফ্রিকার ১৯টি দেশে চীন ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত আফ্রিকার ৪৬টি দেশ চীনের ভ্যাকসিন নিয়েছে। ব্রিজ বেইজিং, একটি ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকাতে এ পর্যন্ত ১৫৫ মিলিয়ন ডোজের প্রতিশ্রুতির মধ্যে চীন ১০৭ মিলিয়ন দিয়েছে, যেখানে অনুদান মাত্র ১৬ মিলিয়ন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বপ্রথম শনাক্ত হওয়া ওমিক্রন আতঙ্ক ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। আফ্রিকা মহাদেশে মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিনের এক ডোজ নিয়েছেন। পুরোপুরি ভ্যাকসিন নিয়েছেন ৭ শতাংশ। বিপরীতে, যুক্তরাজ্যে ১২ বছরের ঊর্ধ্বে করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ নিয়েছেন ৩২ শতাংশ মানুষ।

ইউনিভার্সিটি অব সিডনির স্কুল অব পাবলিক হেলথের প্রধান, প্রফেসর জোয়েল নেগিন বলেন, বিভিন্ন দেশের নেতারা দুর্দান্ত কথা বললেও প্রকৃত ভ্যাকসিন সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি কোভ্যাক্সের মাধ্যমে।

কোভ্যাক্স ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও দিয়েছে মাত্র ৫৮৫ মিলিয়ন। অস্ট্রেলিয়া ৬০ মিলিয়ন ডোজ অন্যদের দিতে প্রতিশ্রুতি দিলেও দিয়েছে মাত্র ৯ মিলিয়ন। ফলে প্রয়োজনের সময় বিকল্প কিছু ভাবা কঠিন হয়ে পড়ে বা অপেক্ষা করা যায় না, বলেন তিনি।

আফ্রিকান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরামর্শদাতা ডেভেলপমেন্ট রিইমাজিনডের ডেপুটি ডিরেক্টর লিয়া লিঞ্চ জানান, মিশর এরই মধ্যে সিনোভ্যাকের সঙ্গে চুক্তি করেছে। সেনেগাল নিজেই সিনোফার্মের ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে। এরকম ১৪টি চীনা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এখন আফ্রিকার উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

এসএনআর/এসএইচএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।