সবার জন্য বাংলা


প্রকাশিত: ০১:৫৬ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

একটি বেসরকারি টিভিতে আমি কাজ করি সিনিয়র নিউজ এডিটর পদে। বাংলায় জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক। জ্যেষ্ঠ লেখতে গিয়ে, অনেকেই লেখেন জৈষ্ঠ্য। বাংলায় এমন শব্দ বিভ্রাটের মুখোমুখি আমাদের হতেই হয়। শুধু পেশায় নয়, পরিবারে বা ব্যক্তিগত গণ্ডিতে অনেক সময়ই আমরা লাগসই বাংলা শব্দ খুঁজে পাই না। তারপরও আমরা চাই, শতভাগ বাংলায় সংবাদ প্রচার করতে, ব্যক্তিগতভাবে, শতভাগ বাংলায় যোগাযোগ করতে।  

শতভাগ বাংলা!! জি, শতভাগ বাংলা `শব্দটি` উচ্চারণ করার পর, অনেক ভ্রুকুঞ্চন দেখেছি। তাহলে কী আপনি চেয়ার বলবেন না? কেদারা বলবেন? না, আমি কেদারা বলবো না। চেয়ারই বলবো। চেয়ার বললে, সেটা এখন আর ইংরেজি বলা হয় না। বাংলা ব্যাকরণ মতে, পাঁচ ধরনের শব্দ বাংলা ভাষায় আছে। তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি। এসব শ্রেণির আওতায়, যা যা শব্দ আমাদের সাধারণ মানুষ বুঝেন, তার অর্থ বুঝেন, সবই বাংলা। শতভাগ বাংলা তাহলে খুব একটা কঠিন নয়?

`শব্দ` আসলে আমাদের `অভিজ্ঞতার`ই ভিন্ন নাম। যেমন, গরম একটা অনুভূতি। সে অনুভূতি পেতে হলে, গরম চা বা পানির গ্লাস হাত দিয়ে `ধরে` দেখতে হবে। যে লোক কোনো দিন, `কবোষ্ণ` কিছুতে হাত রাখেনি, তাকে, হাজার বার বলেও বুঝানো যাবে না, কবোষ্ণ মানে ঠিক কতটুকু গরম। তেমনি আনন্দ, বিরহ কিংবা আন্দোলন, সব কিছুই অভিজ্ঞতা। শব্দের মাধ্যমে আমরা একে অন্যকে অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানাই। ফলে, পৃথিবীতে ভাষা আলাদা আলাদা হলেও, সব মানুষের অনুভূতিই এক। কোল্ড বলেন, আর ঠাণ্ডা বলেন, পেছনের অনুভূতি, একই। তাহলে একটা দেশের বেশির ভাগ মানুষ, যে শব্দ শুনে, যা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তা বুঝতে পারলে, সেটাই স্থানীয় শব্দ। সহজ কথায়, নতুন শব্দ যদি পুরান শব্দকে হটিয়ে নিজের রাজত্ব কায়েম করতে পারে, তাকে আর অপরিচিত শব্দ বলে লাভ কি? পরিচিত মানেই কাছের। আন্তরিকতা বাড়লে সে বন্ধু। আত্মার বাঁধনে ধরা দিলে আত্মীয়।
 
তাহলে, শতভাগ বাংলা আমরা চাইলেই বলতে পারি। বিশেষ বিবেচনায় আনতে হবে, নামের বিষয়টি। মানে বিশেষ্য পদকে। ব্রকলি নিশ্চয়ই সবুজ কপি নামে পরিচিত হবে না। আলু নিশ্চয়ই পটেটো হবে না, টমেটো নিশ্চয়ই টালু নাম ধারণ করবে না। অবশ্য, রাষ্ট্রীয়ভাবেই বাংলাদেশের বেশ কিছু পদের নাম ইংরেজিতে আছে। সেগুলোর বাংলাও আছে, যেমন আইজিপি। এর বাংলা নামও আছে, পুলিশ মহাপরিদর্শক। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে বলা যায়, ঢাকা মহানগর পুলিশ। রেকর্ডকে বলা যায় ধারণ করা। চাইলে অনেক সুন্দর সুন্দর বাংলা শব্দ আমাদের হাতের নাগালেই আছে। শব্দ না থাকলে আমাদের সাহিত্যিকরা নিশ্চয়ই নতুন শব্দ আবিষ্কার করতে পারবেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ যেমন, ইন্টারনেটের বাংলা করেছেন অন্তর্জাল, মোবাইল ফোনের বাংলা করেছেন, মুঠোফোন। কথা হলো, শুধু শব্দ থাকলেইতো শতভাগ বাংলার প্রচলন হলো না।  সে সব শব্দ ব্যবহারও করতে হবে।

বাংলা আমরা বললাম, কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, তার ব্যবহার করলাম না। তাহলে, সেই প্রেম টেকসই হলো না। বিশেষ করে, বাণিজ্যিক ও অফিস আদালতে বাংলা চালু করতে হবে, দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই। তাহলে সাধারণ মানুষ বুঝবে, তাদের ভাগ্যে কী হতে যাচ্ছে। তারা কি করতে চায়, কাজটি করার জন্য দেশের আইনে কী বলা আছে, তা জানতে পারলে, তাদের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি অবশ্যই থাকতে হবে। শেখার প্রশ্ন যখন আসবে, তখন ভাষা যাই হোক, দেশি হোক বা বিদেশি, শিখতে হবে। জ্ঞানের কোনো সীমান্ত নেই। কাজেই, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের মাথা উঁচু করার জন্য, বিদেশি ভাষা শেখার দরকার হলে, তা করতে হবে। এর সঙ্গে নিশ্চয়ই সবস্তরে বাংলা চালুর করার কোনো বিরোধ নেই।

পৃথিবী আসলে এখন একটা গ্রাম। আশপাশের বেশ কিছু বাড়ি যেমন প্রতিবেশি, ইন্টারনেটের বদৌলতে এখন গ্রহের উল্টো দিকের দেশও নিকটতম প্রতিবেশি। যদি সেই প্রতিবেশির সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করতে হয়, নিজের লাভটা ষোলআনা বুঝে নিতে হয়, তবে তাকে বুঝা চাই সবার আগে। বুঝার উপায় ভাষা। কারণ আমরা ভাষা দিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করি। ভাষা দিয়ে অনুভূতি বিনিময় করি। একে অন্যের ওপর নির্ভর করি। কাজেই, দেশে বসে বা বাইরে গিয়ে, দেশের বাইরের কারো সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলে, বিদেশি ভাষা, বিদেশি শব্দ বুঝতে হবে।

সবকিছু ঠিক রেখে, সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায়, বাংলার প্রচলনকেই সমর্থন দিতে হবে। ভাষা বহতা নদীর মতো। স্রোতে অনেক কিছুকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার অনেক কিছুই নদীতে মিশে অবলীলায়। `ভাষা- নদীও` সাধারণের গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়েই সামনে এগিয়ে যাবে।             

লেখক: সিনিয়র নিউজ এডিটর, দীপ্ত টিভি

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।