যে কারণে রেমিট্যান্স কমছে বাংলাদেশে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৪৩ পিএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশে হঠাৎ করেই রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা গেছে, গত আগস্টের শেষে প্রায় ১৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ গত বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের আগস্টে রেমিট্যান্স কমেছে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

এমন সময় রেমিট্যান্স কমছে, যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সংকটের মধ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।

আরও পড়ুন: গ্রিন কার্ডের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই মারা যাবে ৪ লাখ বিদেশি

এর আগে এপ্রিল এবং মে মাসেও রেমিট্যান্স অনেক কম এসেছে। তবে ঈদের মাস হওয়ায় জুন মাসে ২২০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে। এরপর আবার কমতে শুরু করে। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোয় বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন ব্যাংক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। যদিও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

এভাবে টাকা পাঠানোর কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আসলে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে দেশে আসে না বা সরকারি হিসাবে যোগ হয় না।

বৈধ চ্যানেলের বাইরে প্রবাসীরা তাদের আয় করা অর্থ দেশে পাঠিয়েছিলেন বলে মনে হলেও আসলে ডলার, রিয়েল, দিনার বা রিঙ্গিত সেই দেশেই থেকে যায়।

প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেসব দেশে আছেন তারা সেদেশের মুদ্রায় পেমেন্ট করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশি টাকায় এখানে তাদের স্বজনদের বিনিময় মূল্য দিয়ে দেওয়া হয়।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশে থেকে বিদেশে গেছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার শ্রমিক, যা আগের বছর ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার। সব মিলিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের ২ কোটি ১১ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। এর বাইরে শিক্ষার্থী, বৈধ বা অবৈধ কর্মী মিলিয়ে অর্ধ কোটির মতো মানুষ বিভিন্ন দেশে আছেন যাদের অধিকাংশই দেশে টাকা পাঠান।

প্রণোদনা দিয়েও থামছে না হুন্ডি
প্রবাসী আয়ের ওপর দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তারপরেও রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসার হার বাড়ছে না। এই খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং খাত এবং খোলা বাজারে ডলারের লেনদেনে বড় পার্থক্য তৈরি হওয়ার কারণেই আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে। ফলে বৈধ চ্যানেলে না এসে সেটা হুন্ডির কবলে পড়ে যাচ্ছে।

ডলারের অভিন্ন বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করার জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের বিনিময় হার বেধে দিতে শুরু করে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফর এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকার্সদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশি পর্যটক কমে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় কলকাতার ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই দুটি সংগঠন যৌথভাবে ডলারের দর বেঁধে দেয়। সব ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই দরে লেনদেন করতে বাধ্য, না হলে জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। এতে দেশের বাজারে আমদানির ক্ষেত্রে অভিন্ন ডলার পাওয়া গেলেও বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসার প্রবণতা কমতে শুরু করে।

কারণ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসলে ডলার প্রতি পাওয়া যাচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। তার সঙ্গে প্রণোদনার দুই শতাংশ যোগ করে বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ১১১ টাকা ৬৯ পয়সা। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে বা খোলা বাজারে (কার্ব মার্কেটে) ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা দরে।

ফলে যারা আগে বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে টাকা পাঠাতেন, এমন অনেকে এখন হুন্ডির পথ বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খোলা বাজারেও ডলারের দাম বেড়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে না পাঠালে চার পাঁচ হাজার টাকা বেশি লাভ হয়। তাই অনেকে এভাবেই টাকা পাঠাচ্ছেন।

তিনি জানান, কুয়ালালামপুরে বেশ কিছু দোকান আছে, যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে। সেখানে গিয়ে টাকা জমা দিলে বাংলাদেশের স্বজনদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অথবা সরাসরি টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়। ব্যাংকিং রেটের চেয়ে এভাবে পাঠালে টাকাও বেশি পাওয়া যায়।

এভাবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেন বেআইনি হলেও প্রবাসী অনেকের সে সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই।বাংলাদেশেও হুন্ডি ব্যবহার করে দেশে টাকা আনা বা দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অনেক অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাঝে মাঝে এর সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগই থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার যে প্রভাব পড়ছে
বাংলাদেশে কম রেমিট্যান্স আসার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে এমন সময়, যখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে। চলতি মাসেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউজের (আকু) দায় পরিশোধ করা হলে দেশে রিজার্ভ ২২ বিলিয়নের নিচে নেমে যাবে। প্রতিমাসেই প্রায় এক বিলিয়ন ডলার করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। নানা চেষ্টার পরেও সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে পারছে না।

ব্যাংকিং খাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স থেকে গত কয়েক মাসে অনেক কমে এসেছে। কর্মকর্তারা ধারণা দিয়েছেন, এখন যে রেমিট্যান্স আসছে তার একটা বড় অংশ আসলে ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য উন্নত দেশ থেকে আসে। কিন্তু সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, কুয়েত, মালয়েশিয়ার মতো যে দেশগুলোয় অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন, যাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো বেশি প্রবাসী আয় পেয়ে থাকে, রাতারাতি সেখানকার রেমিট্যান্স কমে গেছে। যদিও সেখানকার শ্রমবাজারে বড় কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং প্রতিবছর কয়েক লাখ নতুন শ্রমিক যোগ হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য মনে করছেন, বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া, সুদ হার বেড়ে যাওয়ার কারণেও প্রবাসীদের দেশে টাকা পাঠানোর প্রবণতা কিছুটা কমেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলছেন, অভিন্ন ডলারের দর দেওয়ার পরেও নিয়মিত চ্যানেলে ডলার আসছে না, কিন্তু ডলারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। খোলা বাজারে ঠিকই ডলার চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। তার মানে যেভাবে অভিন্ন দর ঠিক করা হচ্ছে, তার মধ্যে কোথাও একটা সমস্যা আছে। কিন্তু সেই সমস্যাটা শনাক্ত করার বা সমাধানের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

রেমিট্যান্স কম আসার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ব্যবসাতেও। যেসব ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন বেশি হয়, তাদের ডলার আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয়। কিন্তু ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর প্রবণতা কমে যাওয়ায় এই খাত থেকে ব্যাংকগুলোর ডলার অর্জন কমে গেছে।

ব্যাংকিং দরের সঙ্গে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া ডলারের বিনিময় মূল্যের পার্থক্য তুলে ধরে ডলারের বিনিময় মূল্য পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘সিঙ্গেল’ পুরুষদের আশ্রয় দেবে না বেলজিয়াম

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, অভিন্ন ডলারের বিনিময় দর অব্যাহত থাকলে একসময় খোলাবাজারের দরও নেমে আসবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছেন যে, ডলারের চাহিদা এবং যোগানের ভারসাম্য আনতে বিনিময় মূল্য বেধে না রেখে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। সেটা করা হলে খোলা বাজারের সাথে আনুষ্ঠানিক খাতের বিনিময় হারে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না। তখন ডলার লেনদেনে হুন্ডির প্রবণতা কমে যাবে।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখনি সেই পথে হাঁটতে চায় না। কারণ তাতে টাকার মান আরও পড়ে যাবে বলে তাদের আশঙ্কা রয়েছে। টাকার মান পড়ে গেলে দেশের ভেতরে এর মধ্যেই রেকর্ড অবস্থায় থাকা মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।