‘জনস্বার্থে’ ডজন ডজন লিগ্যাল নোটিশ, কার্যকারিতা কতটুকু?
অডিও শুনুন
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে ভেঙে পড়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি। এর প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিল্প ও শিক্ষাসহ সব খাতও স্থবির হয়ে পড়েছে। কিন্তু এমন বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতেও থেমে নেই জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা, অনিয়ম, দুর্নীতি। করোনায় দুস্থ মানুষের জন্য বরাদ্দ ত্রাণ চুরি থেকে শুরু করে করোনার ভুয়া নেগেটিভ-পজিটিভ রিপোর্ট দেয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এসব অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ ইস্যু হয়েছে অনেক। সাধারণত লিগ্যাল নোটিশে প্রতিকার বা ব্যবস্থা গ্রহণের তাগাদা দেয়া হয়, নইলে পরবর্তী পদক্ষেপ অর্থাৎ মামলার হুঁশিয়ারি থাকে। কিন্তু সেসব নোটিশ আসলে কতখানি কার্যকর হয়েছে বা পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ায় এগিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
কয়েকজন আইনজীবীর মতে, অনিয়ম বা প্রতারণা বন্ধে লিগ্যাল নোটিশ প্রাথমিক পদক্ষেপ হলেও অনেক আইনজীবীই পরবর্তী প্রক্রিয়া ধরে এগোচ্ছেন না। ফলে এ ধরনের লিগ্যাল নোটিশ জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকেও পানতা ভাত করে দেয়। এক্ষেত্রে আইনজীবীদের পুরোপুরি পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতে হবে।
তবে নোটিশদাতা আইনজীবীরা বলছেন, ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে কোর্ট চালু হলেও অনেকের কাছে আইনি প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ কম ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা লিগ্যাল নোটিশের আশ্রয় নেন। নোটিশ পাঠানোর পর সবক’টি কার্যকর না হলেও অনেকগুলিরই কার্যকর হওয়ার সময় এখনো আছে।
জানা যায়, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার এক মাস আগে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ৯ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির পল্লব। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লিগ্যাল নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। নোটিশে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং সেল এবং প্রতিটি জেলায় মনিটরিং সেলের শাখা স্থাপন ও দেশের প্রতিটি বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এছাড়া মানুষের জন্য ভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাস্ক, স্যানিটাইজার, পিপিই, গ্লাভস, ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানানো হয়।
এ নোটিশটি আমলে নেননি সংশ্লিষ্টরা। পরে ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় এবং তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখন আক্রান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ, প্রাণও যাচ্ছে শত শত মানুষের।
পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিমানের যাত্রীদের করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করতে এবং আগতদের হয়রানি না করতে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে রাজধানীসহ দেশের সকল মসজিদের প্রবেশপথে থার্মাল স্ক্যানার স্থাপনের দাবিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে; করোনাকালে বাড়িভাড়া ৬০ শতাংশ কমাতে; করোনাকালে সঠিক মাস্ক (এন ১৯) না দিয়ে ভুয়া মাস্ক ও পিপি সরবরাহে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং করোনার টেস্ট বিনা ফিতে করার জন্য ব্যবস্থা চেয়ে; গণস্বাস্থ্যের কিটের অনুমোদন দেয়ার দাবিতে; কোন ক্ষমতা বলে বরিশালে আইনজীবীকে মোবাইল কোর্ট সাজা দিয়েছেন তা জানতে চেয়ে; মানবপাচারের অভিযোগে কুয়েতের কারাগারে বন্দি সরকারী দলীয় সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে কি-না সেটা জানতে চেয়ে; করোনা টেস্ট এবং রিপোর্ট নিয়ে প্রতারণাকারী মোহাম্মদ সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালকে টেস্টের অনুমোদন দেওয়ার কারণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের (তৎকালীন) মহাপরিচালকের গ্রেফতারের দাবিতে; মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালনার পর গণমাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটের বক্তব্য দেওয়া বৈধ কি-না তা জানতে চেয়ে; অনুমোদনহীন অনলাইন টিভি বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদ থেকে সরে যাওয়া অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতারের দাবিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়।
আইনজীবী এসএম জুলফিকার আলী জুনুর দাবি, এসব নোটিশ পাঠানোর পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। না করে থাকলে ভবিষ্যতে অ্যাকশনে যাবেন সংক্ষুব্ধ পক্ষ।
এছাড়া করোনার চিকিৎসার জন্য দেশে আসা নিউইয়র্কের ডা. ফেরদৌস খন্দকারকে কোয়ারেন্টিনে রাখার কারণ জানতে চেয়ে; যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে কনস্যুলেট ভবন ও কনসাল জেনারেলের বাসভবন ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতেও সংশ্লিষ্ট পক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়।
নোটিশদাতা আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে রিট মামলা করা হয়নি। তবে রিট করার প্রস্তুতি রয়েছে।
এদিকে, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখায় টাঙ্গাইলে রাস্তায় এক ব্যক্তিকে কাউন্সিলরের পেটানোর ঘটনায় লিগ্যাল নোটিশ ইস্যুর পর ওই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে পরে মামলা হয়। এরপর সারাদেশ টিসিবির পণ্য বিক্রি চেয়ে নোটিশ ইস্যুর পর রিটও হয়েছে। বাকি লিগ্যাল নোটিশগুলোর বেশিরভাগই পরবর্তী প্রক্রিয়ায় এগোয়নি। যেমন চাল-ত্রাণ চোরদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ চেয়ে ১৩ এপ্রিল নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্ট বারের অ্যাডভোকেট এ এইচ ইমাম হাসান ভুইয়া। নোটিশে কর্মহীনদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রীসহ সরকারি চাল সুষ্ঠুভাবে বিতরণে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। কিন্তু সেই নোটিশের পর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখনো উদ্ধার হচ্ছে চুরিকৃত চাল ও সামগ্রী।
যদিও আইনজীবীরা বলছেন, এখন সংক্ষুব্ধ পক্ষ চেয়ে আছেন আদালতের স্বাভাবিকভাবে চালু হওয়ার দিকেই। নিয়মিত পূর্ণাঙ্গ আদালত খুললেই আইনজীবীরা দায়ের করবেন এসব মামলা।
আইনজ্ঞদের মতে, লিগ্যাল নোটিশ হচ্ছে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের চূড়ান্ত সংকেত। উদ্দেশ্য হচ্ছে, নোটিশ প্রাপককে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করা। তিনি যাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহী হন। করোনার শুরুতেই চেক ডিজ-অনার মামলা, অর্থ ও বিষয়-সম্পত্তি আত্মসাৎ মামলার আইনে লিগ্যাল নোটিশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রিটের ক্ষেত্রেও লিগ্যাল নোটিশের পক্ষে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে।
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম, অ্যাডভোকেট জে আর খান রবিন, অ্যাডভোকেট ইয়াদিয়া জামান, ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান, অ্যাডভোকেট তানজিম আল ইসলাম, অ্যাডভোকেট এ এইচ ইমাম হাসান ভুইয়া, ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম, ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব, অ্যাডভোকেট এ এম জামিউল হক ফয়সাল, ব্যারিস্টার গাজী ফরহাদ রেজা, ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন, মোহাম্মদ কাউসার, অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান লিংকন, অ্যাডভোকেট এসএম জুলফিকার আলী জুনু, ফাহিমা ফেরদৌস প্রমুখ আইনজীবী সংক্ষুব্ধ পক্ষের হয়ে লিগ্যাল নোটিশগুলো দিয়েছেন।
অ্যাডভোকেট জে আর খান রবিন এ বিষয়ে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির পদত্যাগ চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছি। দেরিতে হলেও এটির ফিডব্যাক (ডিজি পদ থেকে ডা. আবুল কালাম আজাদ সরে দাঁড়িয়েছেন) হয়েছে।
নোটিশের বিষয়ে আইনজ্ঞরা বলছেন, মামলার আগে নোটিশ করার পক্ষে হাইকোর্টের একটি জাজমেন্ট রয়েছে। এ কারণে এসব নোটিশের একটি গুরুত্বও রয়েছে। তবে অনেক আইনজীবী রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে নোটিশ ইস্যু করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো মামলা করেছেন না। হয়তো আলোচনায় আসা কিংবা প্রচারের উদ্দেশ্যেই কেউ কেউ এটি করেন। এটি হচ্ছে লিগ্যাল নোটিশের অপব্যবহার। ইদানীং এ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্য আইনজীবী এবং গণমাধ্যমের একটি দায়িত্বশীলতার বিষয় রয়েছে। প্রচার সুবিধা নেয়ার জন্য কেউ লিগ্যাল নোটিশের অপব্যবহার করছেন কি-না, এটি উভয়পক্ষকেই দেখতে হবে।
জনস্বার্থে লিগ্যাল নোটিশ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মো. খুরশিদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল মামলায় সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আদেশ যথাপথভাবে পালন করে থাকে। কিন্তু জনস্বার্থ (পিআইএল) হলো একটি পজিটিভ সাইড। আমি এতে নেগিটিভ দেখি না। তবে নেগেটিভ হলেও এখন তো পার্টিকুলারলি বলতে পারবো না। লিগ্যাল নোটিশ দেয়ার পর কেন মামলা করলো না। লিগ্যাল নেটিশ পাঠানোর পর যদি তা কমপ্লাই না করে, তা হলে মামলা করাই উচিত।
এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমি আগে থেকে বলছিলাম, একটা দরজা খুললে সবাই প্রবেশ করতে পারে। জনস্বার্থে মামলার ক্ষেত্রে আদালত আমাদের জন্য যে হাতটা প্রসারিত করেছেন, এই সুযোগে জনস্বার্থের অ্যাবিউজটা বেড়ে যাবে। সেটা আাদালত এবং আমাদের রোধ করতে হবে। অ্যাবিউজটা হলো, কথা নাই বার্তা নাই, একটা মামলা করে দেয়া। গ্রাউন্ড নাই অথবা প্রভাবিত হয়ে কোনো ইস্যু নিয়ে নোটিশ করা। অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেসব মামলা করা হয় সেটাতে অ্যাবিউজ হওয়ার সুযোগ বেশি।
মনজিল মোরসেদ বলেন, আমরা ইদানীং দেখছি লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার পর আর মামলা করা হয় না। লিগ্যাল নোটিশটা কেন দেয়? কারণ এটা দেয়ার পর একটা মামলা করা হবে। তাহলে লিগ্যাল নোটিশ দিচ্ছেন, কিন্তু মামলা করছেন না, তাহলে কি ওই পক্ষের সাথে আন্টারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেলো? তাহলে জনস্বার্থের মামলা নিয়ে কি ব্যবসা শুরু হয়ে গেলো? এই বিষয়টি কিন্তু আমার মনে জাগে। এটা তো এখন দেখা যায় প্রচারের জন্য দিচ্ছে। নোটিশ দিলে পরে পত্রিকা-টেলিভিশনে নিউজ হয়ে যাবে। কিন্তু অনেক জেনুইন লিগ্যাল নোটিশ অনেক সময় মিডিয়ায় প্রকাশ পায় না। আরও কিছু বিষয় আছে, যেগুলো খুব আলোচিত ইস্যু, কিন্তু সেটায় মামলা হয় না। যুক্তিযুক্ত বিষয় নিয়ে জনস্বার্থে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া উচিত, এটাকে পানতা ভাতের মতো করে ফেলা ঠিক হবে না। এটাতে যেন গুরুত্ব কমে না যায় সেটা এখন আমাদের সবারই দেখা দরকার।
এফএইচ/এইচএ/এমকেএইচ