ভুক্তভোগীর জবানবন্দি

আমার বান্ধবীদেরও শ্লীলতাহানি করেছেন শিক্ষক মুরাদ

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫৮ পিএম, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
গ্রেফতার হওয়া শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকার

> এত শিক্ষক থাকতে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন
> রিমান্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, বলছে পুলিশ
> আমি তোমাকে বাবার মতো জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেছি, কাউকে বলবে না
> নামাজের ঘরে নিয়ে জোর করে জড়িয়ে ধরেন মুরাদ
> একাধিক মেয়ের সঙ্গে একই অশালীন আচরণ

আমার বান্ধবীদেরও শ্লীলতাহানি করেছেন শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকার। আমার বান্ধবীদের পর্নোগ্রাফি ছবি দেখিয়েছেন তিনি। আমাকে হুমকিও দিয়েছেন। মুরাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।

ভিকারুননিসার আজিমপুর ক্যাম্পাসের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে যে মামলা হয়েছে, সে বিষয়ে দেওয়া জবানবন্দিতে আদালতে এসব কথা বলেছে ওই শিক্ষার্থী।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রীর মা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে রাজধানীর লালবাগ থানায় মামলা করেন। পরদিন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই শিক্ষার্থী জবানবন্দি দিয়েছে।

এত শিক্ষক থাকতে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন

গত সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দিনগত রাত ১২টার দিকে রাজধানীর কলাবাগানের বাসা থেকে মুরাদ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই রাতেই ভিকারুননিসা স্কুলের গভর্নিং বডির জরুরি সভায় শিক্ষক মুরাদকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার এসআই ফাইজার হোসেন।

আরও পড়ুন>> ভিকারুননিসার সেই শিক্ষককে ‘বরখাস্ত না করতে’ সুপারিশ 

শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকী-আল-ফারাবী দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) দুদিনের রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। মুরাদের আইনজীবী তার চিকিৎসা চেয়ে আবেদন করেন। এসময় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন? ভিকারুননিসা একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। সেখানে তো আরও শিক্ষক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আপনার বিরুদ্ধে কেন?

এসময় মুরাদ বলেন, এর আগে এ অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। সেখানে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।

এদিকে শুনানিতেও মুরাদের আইনজীবী বলেছেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে।

আমার বান্ধবীদেরও শ্লীলতাহানি করেছেন শিক্ষক মুরাদ

শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। একই সঙ্গে কারাবিধি অনুসারে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

রিমান্ডে পাওয়া গেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার এসআই ফাইজার একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, মুরাদকে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক রিমান্ডে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আসামির কাছে মামলার ঘটনার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। মামলা তদন্তের স্বার্থে আসামিকে ভবিষ্যতে আরও রিমান্ডের প্রয়োজন হতে পারে। আসামি জামিনে মুক্তি পেলে মামলার তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে বিধায় মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত জেলহাজতে আটক রাখার আবেদন করেছি।

আমি তোমাকে বাবার মতো জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেছি

মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা অভিযোগ করেন, আমার মেয়ে বর্তমানে ভিকারুননিসা নূন স্কুল, আজিমপুর দিবা শাখায় ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। ২০২২ সালে আমার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে বিবাদী শ্রেণিকক্ষে গণিতের ক্লাস নেওয়ার সময় তার ব্যক্তিগত বসার ডেস্ক ছেড়ে চেয়ার টেনে নিয়ে আমার মেয়ের বসার বেঞ্চের সামনে বসতো। আমার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিল এবং গণিতে মেধাবী ছিল। যে কোনো গণিত প্রতিযোগিতায় মেয়ের দিকে বিবাদী মুরাদ বেশি মনোযোগ দিতো এবং আমার মেয়ের ব্যক্তিগত বইয়ের পেছন দিকে মেয়ের নাম লিখতো। প্রায় সময় বিবাদী আমার মেয়ের মেধার বিষয়ে প্রশংসাসুলভ কথাবার্তা বলে মেয়েকে বিবাদীর ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টারে পড়ার জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করতো।

আরও পড়ুন>> ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: ভিকারুননিসার শিক্ষক মুরাদ রিমান্ডে 

সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মেয়ে ২০২৩ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আজিমপুরের পিলখানা রোডে বিবাদীর ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। কোচিং চলাকালীন প্রায়ই বিবাদী আমার মেয়েসহ তার সহপাঠীদের সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ প্রাপ্তবয়স্কদের কৌতুক শোনাতো। আমার মেয়ে স্কুলে নাচ করতো এবং ওই নাচের ভিডিও বিবাদী ঘুমানোর আগে দেখতো বলে আমার মেয়েকে প্রায়ই বলতো। ২০২৩ সালের ১০ মার্চ বেলা আনুমানিক ১২টা ৩০ মিনিটের সময় কোচিং শেষে আমার মেয়ের সহপাঠীরা চলে যাওয়ার সময় বিবাদী আমার মেয়েকে কৌশলে ডেকে বসিয়ে রাখে। এরপর বিবাদীর উল্লিখিত কোচিং সেন্টারে দুপুরের খাবারের পর রান্নাঘর থেকে পানি আনার কথা বলে এবং হঠাৎ করে পেছন থেকে বিবাদী আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মুখে চুম্বন করে। এতে আমার মেয়ে অস্বস্তি বোধ করলে বিবাদী মেয়েকে বলে, আমি তোমাকে বাবার মতো জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেছি। এটা কাউকে বলবে না।

নামাজের ঘরে নিয়ে জোর করে জড়িয়ে ধরে মুরাদ

মামলার অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, পরবর্তীসময়ে বিবাদী প্রায়ই কোচিং শেষে কৌশলে বসিয়ে রেখে আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতো এবং শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিতো। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে। বিবাদী আমার মেয়ের স্পর্শকাতর স্থানে পোশাকের উপরে এবং ভিতরে হাত দিতো। মেয়ে জিন্স ও টি-শার্ট পরে কোচিং সেন্টারে গেলে বিবাদী সেগুলো পরিধান না করে ঢিলেঢালা স্যালোয়ার কামিজ পরে আসার জন্য বলতো। ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর দুপুর ১টার দিকে আমার মেয়ের স্কুলে মূল্যায়ন পরীক্ষা শেষে স্কুলের পার্শ্ববর্তী বিল্ডিংয়ে বিবাদী তার কোচিং সেন্টারে পড়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে যায়। বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে কোচিং শেষে মেয়ের সহপাঠীরা চলে গেলেও আমার মেয়েকে বিবাদী কৌশলে বসিয়ে রাখে এবং পাশের নামাজের রুমে যেতে বলে। বিবাদী মেয়েকে নামাজের ঘরে নিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে রুম অন্ধকার করে আমার মেয়েকে জোর করে জড়িয়ে ধরে তার পরিহিত জামা-কাপড় খোলার চেষ্টা করে শ্লীলতাহানি করে। মেয়ে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে বিবাদী মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে বলে আমি তোমার বাবার মতো। এরকম করেছি এ ঘটনা ভুলে যাও। এ ঘটনা জানাজানি হলে তোমার মা-বাবার সম্মানহানি হবে এবং স্কুল থেকে তোমাকে বের করে দেবে।

আরও মেয়ের সঙ্গে একই অশালীন আচরণ করে মুরাদ

মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, এসব ঘটনা মেয়ে বিবাদীর ভয়ে এতদিন আমাকে জানায়নি। বিবাদী মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন সরকারের স্কুলের মেয়েদের প্রতি এ ধরনের অশালীন আচরণের ঘটনা স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে এলে গত ৩ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে আমিসহ আরও বেশ কয়েকজন অভিভাবককে নিজ নিজ সন্তানসহ স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলে ডেকে নিয়ে আসে। বিবাদী কর্তৃক আমার মেয়েসহ স্কুলের অন্য ছাত্রীরা শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে কি না জানতে চান। তখন বিষয়টি আমি জানতে পেরে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে মেয়ে উপরোক্ত ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত আমাকে জানায়। অন্য অভিভাবকদের মধ্যেও বিষয়টি জানাজানি হলে স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান অধ্যয়নরত অনেক মেয়ের সঙ্গে আমার মেয়ের মতো একই অশালীন আচরণ করে শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে মর্মে জানতে পারি।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার এসআই ফাইজার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। আমরা সব দিক দেখে মামলাটির তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে জানানো হবে।

জেএ/এমএইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।