২০ হাজার টাকার জন্য অন্যের হয়ে জেল খাটেন আল আমিন

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ পিএম, ০৪ মার্চ ২০২৪

মো. আল আমিন তিন বছর আগে সানারপাড় মৌচাকের ‘সুস্থ জীবন’ মাদকাসক্ত ক্লিনিকে ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করতেন। হাসপাতালটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালের মালিক ফিরোজ ফোন করে হাসপাতাল চালু করার জন্য আদালতে দাঁড়াতে হবে বলে আল আমিনকে নারী আইনজীবীর চেম্বারে নিয়ে যান। এর জন্য তাকে বিশ হাজার টাকা দেন ফিরোজ। এরপর মূল আসামি শিপু মিয়ার জায়গায় আল আমিনকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালতে দাঁড় করিয়ে একটি মামলায় আত্মসমর্পণ করে আপিল শর্তে জামিন আবেদন করেন আইনজীবী। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

ওই মামলায় শিপু মিয়ার আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। দণ্ডিত শিপু রাজধানীর ডেমরা থানাধীন সান্দিয়া কালুঘাট এলাকার মানিক মেম্বারের ছেলে। এরপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সাজা পরোয়ানামূলে প্রাপ্ত বন্দির ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কর্তৃক অনলাইন ডাটাবেজ করার সময় জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম- আল আমিন ও বাবার নাম জালাল বেপারী দেখতে পান।

আমাকে ফিরোজ ফোন করে বলে তোমার জন্য একটা চাকরি আছে। তুমি আইডি কার্ড নিয়ে ঢাকায় আসো। তার কথা মতো আমি ঢাকায় আসি। এরপর আমার আইডি কার্ড নিয়ে আমার নামের জায়গায় শিপু মিয়া লিখা হয়। আমাকে বিশ হাজার টাকা দিয়ে বলে আদালতে তোমাকে যেতে হবে। সেখানে তুমি চুপ করে থাকবে। হাসপাতাল চালু করার জন্য তোমাকে এটা করতে হবে। আমি তার কথা মতো এসব করি

এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বন্দির উপস্থিতির জন্য সোমবার (৪ মার্চ) দিন ধার্য করেন। যথারীতি বন্দি আসামিকে আদালতে হাজির করা হলে তার নাম মো. আল আমিন বলে জানান। আল আমিন একযুগ আগে ডেমরা থানার ওই মামলায় দণ্ডিত শিপু মিয়ার স্থলে সাজা ভোগ করছেন মর্মে প্রকাশ্য আদালতে স্বীকার করেন। এ ঘটনায় কোতয়ালী থানায় আল আমিন, শিপু মিয়া ও ফিরোজের নামে একটি মামলা করেন আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. আনোয়ারুল হক।

দুই বছরের সাজা ভোগ করার জন্য আদালতে আত্মসমর্পণ করি
ডাটাবেজ করার সময় ধরা পড়ার পর আসামি মো. আল আমিন এ ঘটনায় ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আমি একটি মামলার অভিযোগে আটক হয়ে বর্তমানে কারাগারে অবস্থান করছি। আমি অত্যন্ত গরিব একজন মানুষ। ফিরোজের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকার প্রলোভনে পড়ে ওই মামলার মূল আসামি শিপু মিয়ার দুই বছর ছয় মাসের সাজা ভোগ করার জন্য এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে আসি। আমার এ ধরনের কাজের জন্য বিজ্ঞ আদালতের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট আদালতে ২০১২ সালের একটি মামলায় দণ্ডবিধির ১৪৩/৩৫৩ ধারায় সাজাপ্রাপ্ত হন পলাতক আসামি মো. শিপু মিয়া। ২০২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আইনজীবীর মাধ্যমে শনাক্ত ও উপস্থাপন মতে আসামি আত্মসমর্পণপূর্বক উচ্চ আদালতে আপিলের শর্তে জামিনের আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আসামিকে সাজা পরোয়ানামূলে জেলহাজতে পাঠান। আসামি কারাভোগকালে গত ৩ মার্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সাজা পরোয়ানামূলে প্রাপ্ত বন্দির ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কর্তৃক অনলাইন ডাটাবেজ করার সময় জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম- আল আমিন ও বাবার নাম জালাল বেপারী দেখতে পান। সেখানে তার ঠিকানায় দেখা যায়, মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার বাঘড়া গ্রাম।

আমি একটি মামলার অভিযোগে আটক হয়ে বর্তমানে কারাগারে অবস্থান করছি। আমি অত্যন্ত গরিব একজন মানুষ। ফিরোজের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকার প্রলোভনে পড়ে ওই মামলার মূল আসামি শিপু মিয়ার দুই বছর ছয় মাসের সাজা ভোগ করার জন্য এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে আসি। আমার এ ধরনের কাজের জন্য বিজ্ঞ আদালতের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী

এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই বন্দির উপস্থিতির জন্য ৪ মার্চ দিন ধার্য করেন। বন্দি আসামিকে আদালতে হাজির করা হলে তার নাম মো. আল আমিন বলে জানান। আল আমিন একযুগ আগে ডেমরা থানার মামলায় দণ্ডিত শিপু মিয়ার স্থলে সাজা ভোগ করছেন মর্মে প্রকাশ্য আদালতে স্বীকার করেন।

আল আমিন তিন বছর আগে সানারপাড় মৌচাকের ‘সুস্থ জীবন’ মাদকাসক্ত ক্লিনিকে ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করতো। বর্তমানে হাসপাতালটি বন্ধ আছে। হাসপাতালের মালিক ফিরোজ ফোন করে হাসপাতাল চালু করার জন্য আদালতে দাঁড়াতে হবে বলে তাকে নারী আইনজীবীর চেম্বারে নিয়ে যান। আইনজীবীর চেম্বারে শিপু নামীয় এনআইডিতে আল আমিন তার নিজের ছবিযুক্ত এনআইডিতে শিপুর নাম বসিয়ে নারী আইনজীবীর পরামর্শ মতে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠান।

জানা যায়, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধে সকাল ৯টা ২০ মিনিটের দিকে আমুলিয়া রোডে বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা একটি মাইক্রোবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অবরোধকারীদের বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এসময় কয়েকজন পুলিশ আহত হন।

এ ঘটনায় ডেমরা থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. গোলাম ফেরদৌস বসুনিয়া বাদী হয়ে ৪৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। এতে দণ্ডবিধির ১৪৩/১৪৯/৩৩২/৩৫৩/৪৩৬/৪২৭/১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ছিলেন সাজাপ্রাপ্ত শিপু মিয়া।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। এতে চার্জশিটভুক্ত ৫৩ জন আসামিকে পৃথক তিন ধারায় মোট আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারক। এ মামলার চার্জশিটভুক্ত ২৭ নম্বর আসামি ছিলেন শিপু মিয়া।

এ বিষয়ে আল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতাল বন্ধ হওয়ার পর আমার দীর্ঘদিন চাকরি ছিল না। আমাকে ফিরোজ ফোন করে বলে তোমার জন্য একটা চাকরি আছে। তুমি আইডি কার্ড নিয়ে ঢাকায় আসো। তার কথা মতো আমি ঢাকায় আসি। এরপর আমার আইডি কার্ড নিয়ে আমার নামের জায়গায় শিপু মিয়া লিখা হয়। আমাকে বিশ হাজার টাকা দিয়ে বলে আদালতে তোমাকে যেতে হবে। সেখানে তুমি চুপ করে থাকবে। হাসপাতাল চালু করার জন্য তোমাকে এটা করতে হবে। আমি তার কথা মতো এসব করি।

আল আমিনের বাবা জালাল বেপারী জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছেলে চাকরির উদ্দেশে ঢাকায় গিয়েছিল। সে আমাকে বিশ হাজার টাকা দেয়। এরপর তার কোনো খবর পাইনি। পরে শুনতে পারলাম সে অন্যের হয়ে জেলে গেছে। আমার ছেলে নির্দোষ।

এ বিষয়ে কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজ জাগো নিউজকে বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে জালিয়াতি করার উদ্দেশে জাল এনআইডি কার্ড প্রস্তুত করে তা খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করায় আল আমিন, শিপু মিয়া ও ফিরোজের নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

মামলার বাদী মো. আনোয়ারুল হক জাগো নিউজকে বলেন, প্রতারণার অভিযোগে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের নির্দেশে আল আমিন, শিপু মিয়া ও ফিরোজের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪১৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে।

জেএ/এমকেআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।