এক নির্বাচনে ২০ বছর দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান হারলেন আপিলে

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০৮ এএম, ২২ এপ্রিল ২০২৪
ফাইল ছবি

বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ভোটে জয়ী হওয়ার পরে আর কোনো নির্বাচন ছাড়াই দীর্ঘ ২০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন ভোলার লালমোহন উপজেলার ৭ নং পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ।

এরপরে উচ্চ আদালত চেয়ারম্যান পদ থেকে আবু ইউসুফকে ২০২৩ সালের ২২ মে অব্যাহতি দেন। অন্যদিকে একই দিনে প্যানেল চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ চলতি বছর ওই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগ করার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন আদালত। তবে, এখনো প্রশাসক নিয়োগ না করায় প্যানেল চেয়ারম্যানই দায়িত্ব পালন করছেন। জানা গেছে আদালতের আদেশ এখনো সংশ্লিষ্ট দপ্তর হাতে পায়নি।

এদিকে, ২০০৩ সালে ভোটে একবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ২০ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসা আবু ইউসুফের করা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে পুর্নগঠিত ওই ইউনিয়ন ও নতুন গঠন করা ইউনিয়নে নির্বাচন সম্পন্ন করতে বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে ওই দুই ইউনিয়নে নির্বাচন সম্পন্ন করতে আর কোনো বাঁধা নেই বলে জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন রিটকারীর আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব।

বর্তমানে ওই ইউনিয়ন পরিষদকে ভাগ করে আলাদা দুটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা হয়েছে। পুরোনো ৭নং পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নকে পুর্নগঠন করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর ১০ নং মোতাহার নগর ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা হয়েছে। ওয়ার্ড পুর্নবিন্যাস করে দুটি পৃথক ইউনিয়নের গেজেট প্রকাশ করা হয়। যাতে চারটি মৌজা ভাগ করে আলাদা আলাদা ভাবে চারটি মৌজাকে দুটি করে ভাগ করে দেওয়া হয় বলে জানান অপর রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মনির হোসেন হাওলাদার।

তিনি জানান, এ সংক্রান্ত বিষয়ে শুনানি নিয়ে রোববার (২১ এপ্রিল) প্রধানবিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন সৈয়দ মামুন মাহবুব। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. মনির হোসেন হাওলাদার। অন্যদিকে, আপিলের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান।

আবু ইউসুফ ২০১৯ সালে ২২ সেপ্টেম্বর অনুমতি ছাড়া ভারতের কলকাতা গিয়ে দেশে ফেরেন ওই বছরের ৬ অক্টোবর (ইমিগ্রেশন বিশেষ পুলিশের শাখার তথ্য অনুযায়ী)। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি বিধান) বাৎসরিক সভা ও মাসিক সভা করার কথা থাকলেও তা নিয়মিত না করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি ওই চেয়ারম্যানকে বহিষ্কার করেছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সচিব। সেই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছিলেন বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান। ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রুল জারির পাশাপাশি বহিষ্কারাদেশ তিন মাসের জন্য স্থগিত করে আদেশ দেন হাইকোর্ট। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর রিটটি খারিজ করে দেন আদালত। ফলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের চেয়ারম্যানের বহিষ্কার আদেশ বহাল থাকে হাইকোর্টে।

জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে ওইদিন প্যানেল চেয়ারম্যানের আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবির। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. মনির হোসেন হাওলাদার। বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান আবু ইউসুফের রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলম। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। এর ফলে ওইদিন আইনজীবী জানান ২০০৩ সালে জয়ী হওয়া চেয়ারম্যান তার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলে জাগো নিউজকে জানান আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবির।

প্যানেল চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনের আইনজীবী বলেন, আমরা আদালতের শুনানিতে বলেছি যে, ওই ইউনিয়ন পরিষদে ২০০৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপরে এখন পর্যন্ত আর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি এবং চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্তে প্রমাণিতও হয়েছে। এসব বিষয়ে শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট তার বহিষ্কারাদেশ নিয়ে করা রিট খারিজ করে রায় দেন। এই রায়ের ফলে চেয়ারম্যান পদ আর বহাল থাকলো না এবং চেয়ারম্যান এখন থেকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের আইন অনুযায়ী আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।

দীর্ঘদিন ওই ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন না হওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০৩ সালে চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে সেখানে কচুয়ার চর ইউপির এক ভোটারকে চর উমেদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে রিট করা হয়। সেই রিটের শুনানি নিয়ে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। কিন্তু সেটির কোনো চূড়ান্ত রায় না হওয়ায় নির্বাচন আয়োজনের মেয়াদ শেষ হতে থাকে আর কেটে যায় বছরের পর। সেখানে তফসিল দেওয়ার পর নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে ১০ থেকে ১২টি রিট করেন ভোটাররা। সংশ্লিষ্ট এই কোর্টেই চার থেকে পাঁচটি রিট করা হয়। ওই সব রিট পেন্ডিং থাকার কারণে স্থানীয় সরকার থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেনি।

আইনজীবী মনির হোসেন হাওলাদার আরও বলেন, এর মধ্যে ওই চেয়ারম্যানের অনিয়ম নিয়ে তাকে বহিষ্কার করে এক ওয়ার্ড মেম্বারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আবু ইউসুফ তার চেয়ারম্যান পদ ফিরে পেতে হাইকোর্টে আসেন এবং তিনি রিটটি করেন। ওই রিটের জারি করা রুলের পক্ষভুক্ত হন প্যানেল চেয়ারম্যান (ওয়ার্ড মেম্বার) আলমগীর হোসেন। সেই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত রিটটি খারিজ করে দিলেন। ফলে আবু ইউসুফের চেয়ারম্যান পদ বা ক্ষমতা আর থাকলো না।

২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি আবু ইউসুফকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ পরিষদে নিয়মিত কোনো সভা করছেন না এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ভারত গমন করেন। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তদন্তে প্রমাণিত হয়। ফলে চেয়ারম্যান আবু ইউসুফের সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিষদসহ জনস্বার্থের পরিপন্থি বিবেচনায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪ (১) ধারা অনুযায়ী তাকে তার পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো।

এদিকে, চেয়ারম্যান আবু ইউসুফের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের অভিযোগ হলো, তিনি বহু দুরভিসন্ধি করে এই চেয়ারম্যান পদ ২০ বছর ধরে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। মামলাবাজি করে দীর্ঘ সময় পার করে জনগণের অধিকার হরণ করেন। কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি। বরখাস্তের মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘদিনের দুঃশাসনের পরিসমাপ্তি ঘটলো। এখন দ্রুত ইউনিয়নটিতে নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন।

এফএইচ/এসএনআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।