ইয়াবা জব্দ
ট্রান্সফিট গ্লোবালের ৩ জনের অপরাধ আমলে নিলেন আদালত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৩৮ হাজার ৮৮৭ পিস ইয়াবা বড়ি বিদেশে পাচারের সময় দুই আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ইয়াবাগুলো ঢাকার উত্তরার ট্রান্সফিট গ্লোবাল লজিস্টিক (টিজিএল) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বুকিং দেওয়া হয়েছিল।
এ ঘটনায় করা মামলায় দুই দফা তদন্ত শেষে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোস্তাফিজুর রহমান রাসেলকে শুধু সাক্ষী করেন তদন্ত কর্মকর্তা। একই সঙ্গে আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়া ট্রান্সফিটের সুপারভাইজার মাহবুবুর রহমান ও প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক লিমন সরকারের অব্যাহতির আবেদন জানিয়ে আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আদালত স্বপ্রণোদিতভাবে ওই তিনজনেরও অপরাধ আমলে নিয়েছেন।
আদালত আদেশে বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তার আসামি মোস্তাফিজুরকে এ মামলায় সম্পৃক্ত না করা এবং আসামি মাহবুবুর ও লিমনকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা সঠিক হয়নি।
আসামি মোস্তাফিজুরকে এ মামলায় সম্পৃক্ত না করা এবং মাহবুবুর ও লিমনকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা সঠিক হয়নি।- আদালত
এছাড়া ট্রান্সফিট গ্লোবাল লজিস্টিকের আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত সব চালান সতর্কতার সঙ্গে স্ক্যানিং করতে কাস্টম হাউজকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজের ৩ নম্বর স্ক্রিনিং কক্ষে স্ক্রিনিং করায় সময় সন্দেহভাজন দুজনকে ৩৮ হাজার ৮৮৭ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়। জব্দ ইয়াবার ওজন ৩ দশমিক ৮৮৭ কেজি, যার বাজারমূল্য আনুমানিক প্রতি পিস ৩০০ টাকা হিসাবে এক কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ১০০ টাকা।
- আরও পড়ুন
২০২৩ সালে ৯৯৩৯ মাদক কারবারি গ্রেফতার, ৯৫ লাখ ইয়াবা উদ্ধার
বিমানবন্দরে যাত্রীর পেটে মিললো ৩৫১৮ ইয়াবা
এ ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক আজাদুল ইসলাম ছালাম বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। চলতি বছরের গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ মামুন আটজনকে আসামি করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
গত ২৩ এপ্রিল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোশাররফ হোসেন আসামি মোস্তাফিজুর রহমান রাসেলসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন। মোস্তাফিজুর পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। মোস্তাফিজুর গত ২৬ মে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আলী হায়দারের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক জামিন মঞ্জুর করেন।
অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, জবানবন্দির একটি অংশে আসামিরা বলেন, তারা একটি প্লেটে ৬০ কার্টন মাল লোড করেন। আরও একটি প্লেটে পলি বিছিয়ে দেন। তখন স্ক্রিনিং মেশিন থেকে স্ক্রিনিং অপারেটর তাদের ডেকে নিয়ে আসেন এবং ট্রান্সফিটের লোকদের ডাকতে বলেন। তারা তখন তাদের পাননি। এরপর তাদের আটক করা হয়। ট্রান্সফিটের লোকজন পালিয়ে যান। কার্টনগুলোর মধ্যে ইয়াবা থাকার বিষয়টি তারা পরে জানতে পারেন। আসামি আসাদুল্লাহ জবানবন্দিতে লিমন সরকারের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন।
স্ক্রিনিংয়ের সময় সন্দেহভাজন দুজনকে ৩৮,৮৮৭ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়। জব্দ ইয়াবার ওজন ৩ দশমিক ৮৮৭ কেজি, যার বাজারমূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ১০০ টাকা
১৬৪ ধারায় দেওয়া চারজনের জবানবন্দি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ট্রান্সফিট গ্লোবাল লজিস্টিকসের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল, সুপারভাইজার মাহবুবুর রহমান, লিমন সরকার নালিশি ইয়াবা চালানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ফলে মোস্তাফিজুরকে মামলায় সম্পৃক্ত না করা এবং মাহবুবুর ও লিমনকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতির আবেদন করা সঠিক হয়নি।
‘আব্দুল আওয়াল বনাম আব্দুল মান্নান’ ১৯৮৬ বিএলডি (এডি) ৩২৮: ৩৮ ডিএলআর (এডি) (১৯৮৬)২৫৪ তে বলা হয়েছে যে, ম্যাজিস্ট্রেট যদি সন্তুষ্ট হন যে, একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অযৌক্তিক উপায়ে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তবে তিনি পুলিশ রিপোর্টের (এমনকি চূড়ান্ত রিপোর্ট হলেও) ভিত্তিতে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারার্থে আমল গ্রহণ করতে পারবেন, যা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ (১) (বি) ধারার আওতাধীন।
মামলার আসামি ইউনুস মিয়া, হাসমত আলী ওরফে প্রিন্স, আসাদুল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, আইনুল ইসলাম, ইউসুফ ওরফে বাচ্চু মিয়া, শরীফ হোসেন ওরফে শরীফ, মো. ইব্রাহিম, লিমন সরকার, মাহবুবুর রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান রাসেলের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর ৩৬(১) সারণির ক্রমিক নম্বর ৯(গ), ১০(গ) এবং ৪০/৪১ ধারার অপরাধ বিচারার্থে আমলে নেন আদালত।
এজাহারে যা আছে
বিমানবন্দর থানার ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি যে, শাহজালাল বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজের ৩ নম্বর স্ক্রিনিং কক্ষে স্ক্রিনিং করার সময় সন্দেহভাজন দুজনকে মাদকদ্রব্য জাতীয় বহু পরিমাণ ট্যাবলেট আটক করা হয়েছে। ওই সংবাদ পাওয়ার পর বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজের ভেতর ৩ নম্বর স্ক্রিনিং কক্ষে যাই। সেখানে তিনটি কার্টন তল্লাশি করে মোট ৭৬ পিস সোয়েটার পাই। তার মধ্যে দুটি কার্টনের ভেতর সোয়েটারে লুকানো অবস্থায় কাগজের পোটলায় স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো প্রতি কার্টনে ১৩ পোটলা করে ২৬ পোটলায় (প্রতি পোটলায় এক হাজার পিস করে) মোট ২৬ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যায়।
- আরও পড়ুন
কক্সবাজার থেকে ইয়াবা নিয়ে পিরোজপুরে বিক্রি করতেন মহিদুল
শাহজালালে যাত্রীর পাকস্থলিতে মিলল ১৮শ ইয়াবা
অন্য একটি কার্টনে সোয়েটারের ভেতর কাগজের পোটলার মধ্যে স্কচটেপে মোড়ানো ১২ পোটলায় (প্রতি পোটলায় এক হাজার পিস) ১২ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট এবং একটি ছোট পলিথিনের প্যাকেটে ৮৮৭ পিস ইয়াবাসহ মোট ৩৮ হাজার ৮৮৭ পিস অ্যামফিটামিনযুক্ত ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যায়। যার ওজন ৩ দশমিক ৮৮৭ কেজি, মূল্য আনুমানিক এক কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ১০০ টাকা।
জবানবন্দিতে যা বলেন আসামিরা
অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর আসামি ফিরোজ আহম্মেদ (২৮) আদালতে জবানবন্দিতে বলেন, আমি ট্রান্সফিট গ্লোবাল লজিস্টিকে লোডার হিসেবে কাজ করি। ঘটনার দিন সকালে আমি ও আবু শামীম (৩০) দুজন বিমানবন্দরে আসি। ট্রান্সফিটের সুপারভাইজার মাহাবুবুর রহমান আমাদের কাজ করতে বলেন। আমরা সেখানে লোডিংয়ের কাজ করি। লোডিং অবস্থায় স্ক্যানিং মেশিনের অপারেটর আমাদের কাছে আসেন এবং মালামাল লোড না করতে বলেন। মালামালে সমস্যা আছে জানিয়ে তিনি সেখান থেকে আমাদের মেশিনের সামনে যেতে বলেন। সেখানে লোডের সময় মাদক শনাক্ত হওয়ায় আবু শামীম ও আমাকে ঘটনাস্থলে পাওয়ায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়।
স্ক্যানিং অপারেটর আমাদের ডেকে নেন এবং ট্রান্সফিটের লোকদের ডাকতে বলেন। কিন্তু আমরা তাদের সেখানে পাই না। ট্রান্সফিটের লোকজন পালিয়ে যান। তখন আমাদের আটক করা হয়। পরে আমরা জানতে পারলাম কার্টনগুলোতে ইয়াবা ছিল।- জবানবন্দিতে আসামি ফিরোজ
ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, ট্রান্সফিট কোম্পানির মালিকের নাম রাসেল। সুপারভাইজার মাহবুব। গাড়ি ঢোকানো, আনলোড, ওজন পুরো কাজটিই ট্রান্সফিটের লোকেরা করেন। ৪৩৯ কার্টন মাল। মাল বেশি হওয়ায় আমাকেও ডাকা হয়। এরপর আমি সেখানে যাই এবং লোডের কাজ করি। ট্রান্সফিটের আনোয়ার, আসাদ, রাজু ও উজ্জ্বল স্ক্যানিং মেশিনে মাল দেন এবং মনিরুল ইসলাম শাহীন, বিল্লাল ও হামিদুল সেগুলো নামান। এরপর কার্টনগুলো আমরা লোডিং করি। একটি প্লেটে ৬০ কার্টন মাল লোড করি। আরও একটি প্লেটে পলি বিছিয়ে দেই। তখন স্ক্যানিং মেশিন থেকে স্ক্যানিং অপারেটর আমাদের ডেকে নেন এবং ট্রান্সফিটের লোকদের ডাকতে বলেন। কিন্তু আমরা তাদের সেখানে পাই না। ট্রান্সফিটের লোকজন পালিয়ে যান। তখন আমাদের আটক করা হয়। পরে আমরা জানতে পারি কার্টনগুলোতে ইয়াবা ছিল।
জবানবন্দিতে আসামি মাহবুবুর রহমান (৩৩) বলেন, আমি ট্রান্সপিট গ্লোবাল লজিস্টিকস (টিজিএল) প্রতিষ্ঠানে ইনচার্জ হিসেবে রপ্তানি কার্গো ভিলেজে কর্মরত ছিলাম। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোস্তাফিজুর রহমানের বিদেশে রপ্তানিকৃত কার্টনগুলো বুঝিয়ে দিতাম। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট থেকে প্রাপ্ত কাগজপত্র ও ডকুমেন্টের ভিত্তিতে স্ক্যানিংয়ের জন্য লোডারদের নির্দেশ দিতাম। লিমন সরকার জানান, ২০২০ সালের ১২ বা ১৩ অক্টোবর শিপমেন্ট আছে, তখন মালামাল পাঠানো যাবে। লিমন দেরিতে মাল আনার কারণে সেদিনের শিপমেন্টে পাঠানো সম্ভব হয়নি।
পরের শিপমেন্টে পাঠাতে তার ১০টি কার্টন কার্গো ভিলেজের ভেতরেই আলাদা কাটিমস ক্লিয়ারেন্স পেপার পাওয়ার পরে ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর শিপমেন্টের ৯৩৬টি কার্টন তল্লাশি করতে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোডারদের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেদিন রাত আনুমানিক ১০টার পর লোডারদের ফোনে জানতে পারি, নেশার মদের মধ্যে থাকা ১০ কার্টন মালের লটে মাদক পাওয়া গেছে। সঙ্গে সঙ্গে টিজিএলের মালিককে ফোন করে তা জানানো হয়। আমি কোনোদিন ইয়াবা ট্যাবলেট দেখিনি।
যা বললেন তদন্ত কর্মকর্তা
তিনজনকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত শেষে আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছি। পরে শুনেছি আদালত ১১ জনের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিয়েছেন। আদালত যা ভালো মনে করেছেন সেটা করেছেন।’
ঢাকার আদালতের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ৩৮ হাজার পিস ইয়াবার মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা আটজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে ২৪ নম্বর সাক্ষী মোস্তাফিজুর রহমান রাসেলকে মামলায় সম্পৃক্ত না করা এবং জবানবন্দি দেওয়া দুই আসামি মাহবুবুর ও লিমনকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। কিন্তু আদালত এ তিনজনসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে অপরাধ আমলে নিয়েছেন।
মামলার বিষয়ে মোস্তাফিজুরের আইনজীবী নাসির উদ্দিনের বক্তব্য চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
জেএ/এমকেআর/এমএমএআর/জেআইএম