বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতা কেন ভালো লাগে?

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০১:২৭ পিএম, ২২ অক্টোবর ২০২৩

সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা কবিতা। যে কারণে কবিতা নিয়ে নানাবিধ বিশ্লেষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। কবিতা মূলত কী, কবিতা কেমন হওয়া উচিত, কবিতার স্বরূপ বা শিল্পরূপ কী হওয়া উচিত—এমন গবেষণা, আলোচনা চলছে, চলবেই। আমরা জানি, কবিতায় মানবিকতা, হৃদয়ানুভূতি, ভালোবাসা, বেদনা, বিরহ, আনন্দ, সংগ্রাম, আন্দোলনের স্লোগান নানাভাবে উচ্চারিত হয়। তবে সবার প্রকাশভঙ্গি কিন্তু এক নয়। কিংবা এক হওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা প্রকাশভঙ্গি থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। তাহলেই প্রত্যেক কবি প্রত্যেকের কবিতা থেকে আলাদা হয়ে উঠবেন। এই আলাদা হয়ে ওঠাই শিল্প। একই বক্তব্য, একই ভাষা, একই আবেগ-অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে মানুষের সামনে তুলে ধরাই শিল্পীর বৈশিষ্ট্য। একেক জনের শিল্পরূপ হয়ে উঠবে একেক রকম। সে হিসেবে কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরীকে ব্যতিক্রমই বলতে হবে।

বায়তুল্লাহ্ কাদেরী নব্বই দশকের কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি কবিতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। বাংলা সনেটে জাদুবাস্তবতা, উত্তর-আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপায়ণ, লোকপুরাণ ও স্বজাত্যবোধের পাশাপাশি নতুন ভাষা ও প্রতীকতার মাধ্যমে ছন্দ ও মিলের বৈচিত্র্য আনেন। অন্ত্যজ জীবনের রূপায়ণে এনেছেন আঞ্চলিক ভাষা। ভাষার প্রবাহকে করেছেন গতিময়। ব্যবহার করেছেন যুগোপযোগী চেতনায়। তার শব্দচয়ন ও ভাষাভঙ্গি এতটাই মোহনীয় যে, মুহূর্তেই আকৃষ্ট করে পাঠককে। নারীর শরীর কিংবা শব্দের জাদুতে আচ্ছন্ন করে রাখে পুরোটা সময়। কবি যখন বলে ওঠেন—
‘ছায়াবতী কোমরের ভঙ্গি ধরে নাচে দ্রুততায়
দুধের উঠোনভর্তি ওঠে-নামে নৃত্যের কলায়
শরীরচাকুতে আচম্বিতে পোচ মেরে কমলায়
তরল আঁধার কেটে ঘনীভুত আঁধার জড়ায়’
(ত্রিণাচিকেতের নাচ)
ফলে লোকজ ভাষার সঙ্গে ধ্রুপদীর, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, লোকধর্মের সঙ্গে অস্তিত্বমান কালিক-ভাবনার আর মিথ ও দার্শনিকতার সঙ্গে প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের সম্মিলনের নিবিষ্ট সাধনায় তিনি হয়ে উঠেছেন স্বতন্ত্র, হয়ে উঠেছেন সুদূরের শিকড়ের রস ও বর্তমানের আলো-বাতাসে বিকশিত বৃক্ষ।

এর বাইরেও মিথ, পুরাণ-উপনিষদ, লোকগাঁথা আর অন্ত্যজ জীবনের সঙ্গে ধ্রুপদী জীবন ও বর্তমান সময়কে সমন্বয় হিসেবে আসে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। আর কবি প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে মানব অস্তিত্বের টানাপোড়েন প্রত্যক্ষ করেছেন; তারই মীমাংসা হয়ে এলো যেন ত্রিণাচিকেতের নাচ কাব্যগ্রন্থটি। কবি এ গ্রন্থের মাধ্যমে নিজেকে ভাঙতে চাইলেন শীতাভ সনেটগুচ্ছ ও অন্যান্য থেকে। এ গ্রন্থের উজ্জ্বলতম কবিতাটি হলো ‘ত্রিণাচিকেতের নাচ’। কবিতাটি সম্পর্কে প্রাবন্ধিক রাশেদ মিনহাজ বলেছেন, ‘গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ত্রিণাচিকেতের নাচ’ একটি ঘূর্ণিনাচনের মধ্যে পাঠককে নিক্ষেপ করে। আঞ্চলিক গীতের ‘কমলায় নৃত্য করে থমকিয়া থমকিয়া’-কে শিরোনাম করে শুরু হয় নাচ, শব্দ এবং ধ্বনির─সে নৃত্য এমন যে পাঠককে ঘোরাতে থাকে অনিবার্য দ্রুততায়, যতক্ষণ না নাচ থামে। কমলার নাচের সাথে ঘোরে জগৎসংসার, ‘বাতাসে উজাননদী স্রোতে-ভাঙা চাঁদ শীর্ণকায়/ ইচ্ছায়-আনন্দে-ধ্যানে ধান ভানে,’।

তার চমৎকার রূপকল্পময় কবিতাগুলো স্বতঃস্ফূর্ত অথচ প্রায় প্রত্যেকটি কবিতা যেন সুপরিকল্পিতভাবে রচিত। জীবন-স্বপ্ন-ক্রোধ-দ্রোহ-প্রেম-আবেগই যেন তার কবিতার উপজীব্য। সেসব আর অনিয়ন্ত্রিত বা যুক্তিহীন আবেগ নির্ভর নয়। একটি সার্থক কবিতার জন্য যেমন যৌক্তিক আবেগ জরুরি, তেমনই জরুরি বাস্তবিক অনুরণন। কেননা আধুনিক কবিতায় পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করা একটি কঠিন সাধনা। ফলে তার কবিতাভাবনা আমাদের জটিল এক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দেয়। যুক্তিনির্ভর এসব আবেগ-অনুভূতি-যন্ত্রণার মিশ্র সমাহার লক্ষ্য করা যায় প্রতিটি পঙক্তিতে।

কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর আরেকটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘আড়ম্বর’। এ গ্রন্থ সম্পর্কে কবি আমিনুর রহমান সুলতান বলেছেন, ‘আবহমান মানব যা কিছু অর্জন করে তার কোন চিহ্নই থাকে না, একমাত্র ‘আড়ম্বর’টুকুই থাকে। কাল যেন মানব জীবনের সবটুকু গ্রাস করে। কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর গ্রন্থের সব ক’টি কবিতায় একটি অখণ্ড দর্শনলব্ধ চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার দর্শনলব্ধ চেতনায় উঠে এসেছে যখন মা সন্তানসম্ভবা হয়; তখন থেকেই শুরু হয় আবহমান মানবের ‘আড়ম্বর’। আর সে আড়ম্বর জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে নানামাত্রা পায়। আড়ম্বরের কায়াকৃতি একটি বাঁক, অন্যান্য বাঁকগুলো হচ্ছে ‘আগমচুম্বনে’, ‘হাতেখড়ি’, ‘অভিষেক’, ‘প্রজাচার’, ‘প্রজাপতি’, ‘নৃত্য’, ‘অনুগমন’। আড়ম্বর পরিলক্ষিত হয় কায়াকৃতিতে, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজনের আগমচুম্বনে, শৈশবের ‘হাতে খড়িতে’, ‘যৌবনে অভিষেক’-এর মধ্য দিয়ে যৌবনটাই যে আচারে পরিব্যপ্ত─তা হোক লোকাচারে, লোকধর্মে, লোককল্যাণে যা ‘প্রজাচারে’-এর মধ্যে প্রবহমান প্রজাপতি প্রতীকে বিয়ের মধ্য দিয়ে ‘প্রজন্মান্তরের প্রতীক ‘নৃত্য’-এর মধ্য দিয়ে এবং অনুগমন অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষের বয়োবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মৃত্যুর পরিণতিতে।’ (আবহমান মানবচেতনায় কবির আড়ম্বর, আমিনুর রহমান সুলতান, যুগান্তর)
আড়ম্বর বইটির কিছু উক্তি যদি পরখ করা যায়, তাহলে এ মূল্যায়ন যথার্থ হয়ে উঠবে বলে মনে করি। যথা-
‘চমৎকার সেজেছে রজনী!
চমৎকার তার রূপ বিজলিখসা হাসি!
আতসবাজির ঝুরঝুরে ছিটকানো আলো
দ্রিদিম দ্রিদিম বাদ্য, অনবদ্য রমণীর মৃগনাভিঘ্রাণ
কী ঝাঁঝালো, ঝিঁঝিঁময় তীব্র একটানা আড়ম্বর’
(প্রজাচার-২)

একই সঙ্গে দার্শনিকতাকেও প্রযুক্তির সঙ্গে একাকার করে দেন কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরী। তার ‘শীতাভ সনেট গুচ্ছ’, ‘ত্রিণাচিকেতের নাচ’, ‘কিম্ভূত হবার কথা ছিল’, ‘প্রজন্ম লোহিত’ কাব্যগ্রন্থে তারই ছায়া লক্ষ্য করা যায় স্পষ্টভাবেই। এমনকি তার কবিতায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, মিথ, জাদুবাস্তবতা উঠে আসে অবলীলায়। কবি বলেন—
‘কবে, কারা, কার অব্যবহিত মৃত্যুর পরে
সিংহাসনে চড়ে বসেছিল
এলিয়েবেলিয়ে চলে গিয়েছিল ভেলাসহ হেরেম অবধি
কার যন্ত্রণার তৃণে হরিণপিয়াস জেগে ওঠে
আবার নিভেছে নিজে-নিজে
কাচের বোতলে,
সত্যিকার দত্যি এল বলে ভয়ে জড়সড়
অতঃপর দাসানুদাস দৈত্যের ঘাড়ে রাঢ়বঙ্গ’
(প্রজন্ম লোহিত: ২৫)
কখনো কখনো কবিতায় ভালোবাসার পরশে জেগে ওঠে কবিমন। অবলীলায় ব্যক্ত করেন মনের আকুতি। যা সবারই আরাধ্য। কবি তাই তো বলেন—
‘ভালবাসিবে প্রেমিক মন
এই কথা বলতে পারি না
বলতে পারি না গোদাবরীতীরে দেখেছিনু নামিতে কাহার মুখ
স্পেসে কেমনে সে সূর্যমুখী ভেসে উঠেছিল পুনর্বার!’
(প্রজন্ম লোহিত: ৩০)

তার লেখা প্রেমের অন্য সব কবিতার পাশাপাশি লেখমালা সিরিজে প্রকাশিত ‘রূপমলাটে পদ-চতুর্দশী’ শিরোনামের কবিতা পুস্তিকায় কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর ১৪টি খণ্ড কবিতা স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে—সনেটের বউ এক ও দুই; পেন্সিল এক, দুই ও তিন; বৃষ্টির সনেট এক, দুই, তিন, চার ও পাঁচ; ফটোক্রেডিট; ইগোর গাড়িতে তুমি এবং কাপালিক এক ও দুই নামীয় কবিতা রয়েছে। এই কবিতাগুলোর মধ্য দিয়েও পাঠক অনন্য প্রেমিক বায়তুল্লাহ্ কাদেরীকে চিনবেন নতুন করে। একজন আপাদমস্তক প্রেমের কবিকে চিনবেন। কেননা কবির প্রেমের কবিতার পসরা আছে ‘রূপ মলাটে পদ-চতুর্দশীতে’; আছে রূপের মলাটে।

এবার যদি আমরা তার কিছু কবিতা পড়ে নিই, তাহলে বিষয় ও আঙ্গিক সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে যেতে পারি। তার কবিতার বিশাল ভান্ডারের মাঝে এসব হয়তো সামান্যই মনে হতে পারে। তবে উদাহরণ হিসেবে যথেষ্ট বলে মনে হয় আমার কাছে। যেমন-
১.
এখনই নাচবো আমি─এসো সিনীবালি, আমি অমা
তুমি সা, সা তুমি, আমি সাম, তুমি ঋক─সিনীবালি,
আমার নাচন ধরো ওষ্ঠে, ঊরুদ্বয়ে ধৃত করো
নৃত্যরত আমার আগুন, অরণিমন্থনে জেগে
উঠুক প্রাণের বীজ─এখনই নাচবো আমি, প্রাণে
ধরো এই নাচের নিয়ম...
(সিনীবালি: এক)
২.
কে খেলা করবে এ লোডশেডিং-এ? মেয়র না কবি
প্রশ্ন প্রশ্ন আর প্রশ্ন হোটেল-কক্ষের আলো ঘুরে মরে যায়।
(লোডশেডিং-কাল-২)
৩.
দেখছি পিতার মতো অতি সপ্রতিভ, প্রজাপতিব্রতসারা
তৃপ্তিময় ময়ানের তুলো, হয়তো ‘জয়তু’ বলে
এখনই জানাবে সম্ভাষণ বৎসে’
(আগমচুম্বনে-১)
ফলে তার কবিতাচর্চায় আঙ্গিক ও বিষয়ের দিক থেকে বিশেষ সচেতনতা চোখে পড়ে। বিশেষত তার শব্দ প্রয়োগে সচেতনতা ও পরিমিতিবোধ এবং বিষয় বিচারে আধুনিক মনন। তার বেশিরভাগ কবিতায় সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকে, থাকে সুনির্মিত আখ্যান এবং তা থাকে রূপক, প্রতীক, রূপকল্পের ভেতরেই। তার অনেক কবিতা পড়ে মনে হয়, কবির যথার্থই বিশ্বাস জীবনের গভীরতর দার্শনিক বোধ বা বোধের সমষ্টিই কবিতা।

শব্দ, বাক্য বিন্যাসের পর ভাষা বিন্যাসেও ব্যতিক্রম সুর ঝংকৃত হয় তার কবিতায়। কবিতার দৃশ্যপট আলোড়ন যেন তোলে। কবির ভাষায়—
‘এখন নতুন আর কীবা কহিবাম,
সুন্দরসুগন্ধভাষে জাল ফেলে
শব্দখোর মোটকুরি শাদাপেটে আজীবন কেন্দ্রমুখী,
একটি হিন্তাল লাঠি এমন উদ্যত, নগ্ন, কীবা কহিবাম’
(তোমারে কহন্ত কত)
একই সঙ্গে আঞ্চলিকতাও যেন শিল্প হয়ে ওঠে বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতার চরণে। কবিতায় আঞ্চলিকতা বা আঞ্চলিক কবিতা অনেক হয়তো পড়েছি আমরা। তবে বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতায় তা উঠে আসে ভিন্ন আঙ্গিকে। কবি যখন বলেন—
‘এ কোন শহরে এসে থেমে গেলে কাউট্টাসহ, এ কোন্ শহর?
কন্ডে যাইয়ুম আঁই অবেলায়! কন্ডে যাইয়ুম?’
(দেহরজ্জু)
মূলত শব্দ নিয়ে খেলা করা, শব্দের সাধনা করাই যেন তার অভিষ্ট্য লক্ষ্য। তাই তো কবিতায় তিনি বিশেষ নৈপুণ্য দেখাতে পেরেছেন। কারণ তিনি নানা মাত্রিক কবিতায় বিচরণ করলেও তার জীবনের দীর্ঘসময় চর্চা করেছেন মূলত শব্দেরই। এ ক্ষেত্রে কবিতাচর্চার জগতে এসে প্রকৃত কবিসত্তার অধিকারী হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি। কবি যখন আবার আঞ্চলিক স্বরে বলে ওঠেন—
‘চেইত্যা গেলে মন বড়ো হাসে
বিলাই ফুডানি দেখায় ড্রেসিং রুমে আয়নায়,
আর মানুষের দরকষাকষি শেষে
এক পয়সার মন দুই পয়সায় মন রেখে জ্বলে, শুধু
রাতার চোখের মত লাল লাল গাড়ি চলে যায়।’
(গাড়ি, রেলগাড়ি-সন্ধ্যা)

বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতায় নির্মম সত্য উদ্ভাসিত হয়। তার কবিতায় গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা নাগরিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করে। কবিতায় তার গ্রাম চমৎকার সব চিত্রকল্পে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ফলে মনে হয়, গ্রামীণ চিত্রকল্পই যেন তার কবিতার একমাত্র উপলক্ষ্য। তাই তো তার কবিতায় ফুটে ওঠে গ্রামীণ আবহ। যেমন-
‘শুক পাখিরে বইলা দিবা
মহাবিজ্ঞ শুক
বনের মাঝে দেখবা ফিরে
বউলালটুকটুক’
(পাতা)
একইভাবে জীবনযন্ত্রণা ধরা দেয় তার কবিতায়। সমকালীনতা এসে কড়া নাড়ে পাঠকের কানে। নাগরিকের মনোবেদনা উপলব্ধি করেন কবি। তাই তো বলে ওঠেন—
‘এ বাজারদর নয়। তেল বেড়ে
ডলারে ডলারে
পৌঁছে গেছে, পদদলিত ডলারে
পৌঁছেছে পাছার পায়ুতেল, আমেরিকা চায়
ইরানে সেঁধিয়ে যেতে ভেতরের তেলে’
(দিঘি থেকে তোলা-জলে)
এ যেন জীবনেরই আলেখ্য। সেই জীবন থেকে বাদ পড়ে না আন্তর্জাতিকতাও। সেই বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারী বিক্ষোভ নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত আলোড়ন তোলে।

কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরী তার কবিতায় বহু লোকজ শব্দ বা আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়। অবশ্য তাকে অত্যধিক হারে প্রচলিত বা অপ্রচলিত সংস্কৃত ও ইংরেজি শব্দও ব্যবহার করতে দেখা গেছে। আমার দৃষ্টিতে তা দোষণীয় বলে মনে হয়নি। কারণ ভাষা তো ভাব প্রকাশেরই মাধ্যম। তাই ধরে নিচ্ছি, পুরাণ-উপনিষদের নানা মিথ ব্যবহারের লক্ষ্যে হয়তো তার এত সংস্কৃত শব্দের আমদানি ঘটাতে হয়েছে। তবে তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় ঢঙ্গের আঞ্চলিক ক্রিয়া─করেছিনু, খেয়েছিনু জাতীয় কিছু শব্দকেও সংযুক্ত করেছেন তার কবিতায়। তাই বলে কিন্তু তা রাবীন্দ্রিক হয়ে ওঠেনি। আলাদা ব্যঞ্জনাও সৃষ্টি করতে পেরেছে।

একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কবির ফরমেশন বা ধারাও কিন্তু চোখে পড়ার মতো। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও আমরা তা লক্ষ্য করেছি। যদিও তা একজন কবি বা শিল্পীর ইচ্ছা, মনন, মেধা ও সামর্থের ওপর নির্ভর করে। তবে কবি যে স্বনির্মিত ধারা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়েছেন, তিনি যে ধারার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছেন; তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই পারে। তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, কারণে-অকারণ, অজুহাতে-দুর্বোধ্যতায় কঠিন দেওয়াল সৃষ্টি করেননি। তার কবিতা অবশ্যই সুবোধ্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তার বিমূর্ত চিত্রকলার আদলে সৃষ্টি করা কবিতা ‘বিমূর্ত’ না ‘পরাবাস্তব’ তা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে।

এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বায়তুল্লাহ্ কাদেরী একটি সুদীর্ঘ সময় ধরে নিবিষ্ট ধ্যানে-সাধনায় কাজ করে চলেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি মেধা ও মননের স্বাক্ষর রেখেছেন। তারপর বারবার তার প্রচেষ্টা ছিল নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া, নিজেকে ভাঙা, নিজেকে নতুন করে গড়া। সেই যাত্রায় তিনি সফল হয়েছেন। তবে সেই সাফল্য কতটুকু; তা সময়ই হয়তো বলে দেবে। তবে তার সেই যাত্রাকে কণ্টকমুক্ত রাখতে রাজধানীতে বসবাস করেও নিজেকে একপ্রকার আড়ালে রেখে এগিয়ে চলেছেন। তাই তো তার কবিতার বিষয়ে আমি আশাবাদী এই কারণে যে─ভবিষ্যতে তার শিল্পনিষ্ঠ বলিষ্ঠ উপস্থিতি পাঠকের প্রত্যাশাকে ফলবান করে তুলবেই।

১৯৬৮ সালের ৯ জুলাই কুমিল্লায় জন্ম নেওয়া কবি বায়তুল্লাহ কাদেরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তিনি ১৯৯৮ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৩ সালে পেয়েছেন শব্দগুচ্ছ কবিতা পুরস্কার। এ ছাড়াও বাংলাদেশ রাইটার্স ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ডস ও লতিফা জেরীন স্বর্ণপদক পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় যে কোনো স্বীকৃতি তাকে আরও মহিমান্বিত করে তুলবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।