আবুবকর সিদ্দিকের কবিতা

জীবন-অস্তিত্বের গভীর দার্শনিকতায় আক্রান্ত

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৩৯ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩

মামুন মুস্তাফা

বাংলাদেশের কবিতায় কবি আবুবকর সিদ্দিক (১৯ আগস্ট ১৯৩৪-২৮ ডিসেম্বর ২০২৩) একটি অন্যতম প্রধান কবিনাম। ১৯৬৯ সালে কবির প্রথম কবিতার বই ‘ধবল দুধের স্বরগ্রাম’ বহিরঙ্গে বিষ্ণু দে আর অন্তরঙ্গে জীবনানন্দ দাশের অনুসারী অঙ্গভূষণ নিয়ে প্রকাশিত হলেও এর ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে কবি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বকীয়। এর বিভিন্ন কবিতায় সুধীন দত্তীয় কিংবা শার্ল বোদলেয়ারীয় ছাপ, এলিয়েটের সরাসরি উপস্থিতি অথবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের টেলিগ্র্যাফিক মিতভাষণ লক্ষ্যণীয় হলেও আধুনিক কবিতার শরীরকাঠামো নির্মাণে ও নিরীক্ষায় আবুবকর সিদ্দিক শুরু থেকেই ব্যবহার করেছেন একেবারে ভিন্ন ও সম্পূর্ণ নিজস্ব চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা। এর ফলে তাঁর প্রথম কাব্য ‘ধবল দুধের স্বরগ্রাম’ই (১৯৬৯) কবি হিসেবে তাঁর বিশিষ্ট অবস্থানকে চিহ্নিত করে দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের আধুনিক কবিতাযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনার ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু উত্তরকালের আলোচকদের উদাসীনতার কারণে বাংলাদেশে কবি হিসেবে আবুবকর সিদ্দিক সেরকম ভাবে আলোচিত নন, যেমনটি হওয়া উচিত ছিল।

তবে এ কথা বলতে হয় বাংলাদেশের কাব্যজগতে অনেক আগেই নিজস্ব স্থান চিহ্নিতকারী এই কবি তাঁর প্রতিটি কাব্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ৪৭-এর দেশভাগের পটভূমিতে তৎকালীন বাংলাদেশের জনজীবনের বিচিত্র, জটিল ও বহুভঙ্গিম আবর্ত-সংর্ঘষ-গতি ও সংগ্রামের অভিঘাতে বাংলাদেশের কবিতাও হয়ে উঠলো সেই বৈরী বাস্তবতার অনুষঙ্গী। এই প্রেক্ষাপটে কবি আবুবকর সিদ্দিকের কবিতার চেতনা ও প্রকরণও হয়ে উঠেছে রক্তাক্ত, জটিল, দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ অথচ জীবন্ময়। আবুবকর সিদ্দিকের কাব্যবৈশিষ্ট্যের প্রধান দিকদর্শন তাঁর বহুমাত্রিকতা। সামাজিক দায়বদ্ধতা, আধুনিকতা, পরিশীলিত কাব্যচিন্তা, ঘূর্ণায়মান জীবনের দৈশিক ও বৈশ্বিক টানাপোড়েন, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার; এসব কিছুই কবির কাব্যবৈশিষ্ট্যের অন্যতম চরিত্র। যদিও স্বতন্ত্রভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে কবির নিজস্ব প্রতীক ব্যবহার ও শব্দ নির্মাণের সূক্ষতা।

বহুমাত্রিকতায় ভাস্বর এই কবি তাঁর প্রতিটি কাব্যের উত্তরণে নিজেকেও ভেঙেচুরে গড়েপিটে নিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার দ্যোতনায়। যে ঐতিহ্য কবি বহন করেছেন তাঁর তৃতীয় কাব্য ‘হে লোকসভ্যতা’ পর্যন্ত, তা থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন পঞ্চম কবিতাগ্রন্থ ‘হেমন্তের সোনালতা’য় (১৯৮৮)। তবে জীবনানন্দের হেমন্তের সঙ্গে একে মেলানো যাবে না। বোহেমিয়ান কবি প্রতিনিয়ত ভ্রমণ করেছেন উভয় বাংলার পথে-প্রান্তরে। দেখেছেন বনবাদাড়, জলাজংলা, প্রান্তরজুড়ে একর ভূমি, সমতট, আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, সবুজের সমারোহ, আবার প্রত্যক্ষ করেছেন রাঢ়-বরেন্দ্রর রুখাফাটা প্রকৃতির নির্জলা বাতাস। এরকম নিরাসক্ত নিসর্গের সান্নিধ্যে এসে কবি হেমন্তকে আবিষ্কার করেন শেষ কার্তিক এবং প্রথম অঘ্রানের মরা রোদ, হিমেল বাতাস, অবসন্ন গাছপালা—এসব কিছুর শরীর ও আত্মায় স্যাঁতা পড়া মৃত্যুস্পর্শের ভেতরে। ‘হেমন্তের সোনালতা’ সেই মৃত্যুগন্ধস্পর্শী গভীর দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন। সেই দার্শনিকতায় কবির ব্যক্তিজীবনও ছায়াপাত করে কুহকী ঈষদাভাস কিংবা বিভ্রম হয়ে।

কবি আবুবকর সিদ্দিক শুরু থেকেই তাঁর কবিতার ভাষা ও মেজাজে ছিলেন একান্ত স্বনির্ভর। আয়ুষ্কাল, নিরবধি ও অবিভাজ্য কালবোধ, অস্তিত্বের অনস্বীকার্যতা-অসহায়তা, অবিদীর্ণ ব্রহ্মাণ্ড নিখিল বিস্ময়, এই সব মননজটিল রহস্যপ্রাণতার দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন হন একজন অন্তর্মনস্ক কবি। তারই সূত্রপাত ‘হেমন্তের সোনালতা’য়। এই কাব্যের কবিতাগুলোতে প্রতীক ব্যবহারে কবি তাঁর নিজস্ব চিত্রভাষা তৈরি করেছেন—
জন্মজন্মান্তর ভেসে চলে যায় নদী বেঁকে যায়।
পৃথিবীতে ভিন্ন সংসার এসে পড়ে
ভিন্নতর বাসনকোসন,
অন্য নারী শুয়ে থাকে সেগুনপালংকে,
পরপুরুষ পান নেয় হাত বাড়িয়ে।
পাললিক স্তন হতে দুধ পায় শংকরসন্তান,
(ছেদ: হেমন্তের সোনালতা)

কবি এখানে সম্পূর্ণ নিজস্ব চিত্রভাষা তৈরি করেছেন ‘পরপুরুষ পান নেয় হাত বাড়িয়ে’ এই প্রতীক-উপমা ব্যবহারে। এর মাধ্যমে কবি মানুষের বংশবিস্তারের কথাই বলেছেন। দিন বদলের সাথে সাথে পৃথিবীর চেনাজানা অনেক কিছুই লুপ্ত হয়। কিন্তু মানুষের সংসারজীবন রয়ে যায়। সেখানে নতুন অতিথি আসে। পূর্বপুরুষের সেগুনপালংকে এখন ভিন্ন কোনো নারী। লোকায়ত বিশ্বাসে সে-ও পান দেয়, সে পান হাত বাড়িয়ে পৃথিবীরই উত্তরসন্তান গ্রহণ করে। কবি এই কবিতার ভিতরেই মানুষের আয়ুষ্কাল এবং অবিভাজ্য কালবোধকেই আবিষ্কার করেন—
কদমে কেশর ফুটে গ্যাছে, দেহ নেই, দোলনায়
দোলা লেগে আছে, ভালোলাগা কোথায় হারালো? এই
বাংলার কমলায়ও এরকম রস লেগে ছিলো;
সবারি সময় আসে, দোলনায় লেগে গ্যাছে দোলা।
জলপাইজামবনে জমাতে জমাতে পথখর্চা
কালবায়ু হানা দ্যায়, দোলনার দড়ি কেঁপে ওঠে।
(এ দড়িতে হবে না মসৃণ: হেমন্তের সোনালতা)

পৃথিবীর ’পরে মানুষ তার ধুলোছাপ রেখে যায়। সংসারজীবনে ওটুকুই বুঝি মায়ার বাঁধন। পার্থিব জীবনে মানুষের হারানো স্মৃতি দোলা দেয় অস্তিত্বের অসহায়তায়। মানুষ তো একদিন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু রেখে যায় তার স্পর্শ সংসারজীবনের ছড়ানো ছিটানো ব্যবহৃত তৈজসপত্রে। সেই অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের যে টানাপোড়েন, তাকেই কবি এক জীবনের সারাৎসার করে দেখিয়েছেন ‘এ দড়িতে হবে না মসৃণ’ কবিতায়। ব্যক্তিমানুষের দিনযাপনের ক্রান্তিকাল, হাঁসফাঁস যাপিত জীবনকে অসহনীয় করে তোলে। এ যেন রক্তমিশ্রণ মাটি-বৃক্ষ সমস্ত নিসর্গজুড়ে আর পরম্পরা হতে কবিকে অজানা অদৃশ্য বিচ্ছেদ ও চিরনির্বাসন দিনরাত কুরে কুরে খায়। জীবনযাপনের জটিল মন্থনে আর হলাহলের মিশ্রণে ‘হেমন্তের সোনালতা’ জীবন ও অস্তিত্বের কথা বলে ভিন্ন এক মৃত্যুসংসর্গে:
সন্ধের চেয়েও ঘন মেঘ করে আসে।
আঁচলে হলুদ মুছে মেজবউ ঘরে এসে ডাকে,
ও মোহন, দ্যাখ দিকি হাটুরেরা ফিরে এলা নাকি?

নেই নেই পথে নেই দিগন্তেও নেই,
সড়কের সংসারে একটিও খড়কুটো নেই,

আবছায়া ফিশ ফিশ স্বরে ডেকে বলে,
ভাঙাচুড়ি পড়ে আছে চাঁদের নিচেয়।
এ মাটিতে পথরেখা চিনবার আর কোনো ধুলোছাপ নেই,
আর কেউ নেমে গিয়ে ফিরে আসে না তো।
(এলোমেলো পরমায়ু: হেমন্তের সোনালতা)

সমকালীন জীবনচৈতন্যের অস্থিরতা ও সংঘাত অনায়াসে আক্রান্ত করে কবির ব্যক্তি জীবনকেও। এই জীবনের অস্থিরতা ও চাঞ্চল্য তাঁর মধ্যেও অভিঘাত সঞ্চার করে। সমাজ পটভূমির এই তীক্ষ্ন অনুভব থেকেই কবি আবিষ্কার করেন পথিমধ্যে ভুল হয়ে গেলে আর ফিরবার কোনো পথ থাকে না। তখন চেনাজানা মানুষও কেমন অচেনা হয়ে যায়। ‘এলোমেলো পরমায়ু’ কবিতায় সেই কুহকী ঈষদাভাস ছলকে উঠেছে প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। এভাবেই মননের গভীরে দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন ‘হেমন্তের সোনালতা’ হয়ে উঠেছে কবির জীবনাভিজ্ঞতারই মেধাবী অনুধ্যান।

বস্তুত বাংলাদেশের কবিতায় আমূল দার্শনিকতায় আক্রান্ত এ জাতীয় কাব্য খুব একটা নজরে আসে না। সমস্ত কবিতায় অন্তর্গূঢ় ধারাবাহিকতা লক্ষ্যণীয়। উপমা, প্রতীক সব কিছু যেন জীবনানন্দ ঘরানার, কিন্তু আসলে ওটা এক ধরনের মাস্ক (Mask)। মূলত এর শব্দ, বিষাদ, উপমা—সব কিছু আবুবকর সিদ্দিকের সম্পূর্ণ নিজস্ব নির্মাণ।

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে মানুষ আধ্যাত্মবাদিতায় নিজেকে নিবিষ্ট রাখে। কেননা জাগতিক জীবনে মৃত্যু এসে চেটেপুটে নিয়ে যায় অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের বিষয়আশয়। মানুষের পার্থিব জীবন সেই চিরায়ত পথেই হাঁটে। হেঁটে হেঁটে হিসেবের কানাকড়ি আঁকড়ে ধরে থেকে যেতে যায় সংসারজীবনে। এই সব জাগতিক দ্বন্দ্ব আর তাকে ছাপিয়ে বৈনাশিক মানুষের খেলাধুলো এবং নিখিল অসহায়তা শূন্য বায়ুলোক জুড়ে কান্নাচাপা শূলব্যথা হয়ে ঘুরে ঘুরে ফেরে।

এই কাব্যের ভাষা বাংলাদেশের কবিতায় একবারেই স্বতন্ত্র ও অনন্য। জীবন, অস্তিত্ব আর মৃত্যুসংসর্গে গভীর অনুভূতির দার্শনিকতা আর মনোজগতের নিরীক্ষাধর্মী ‘হেমন্তের সোনালতা’ মূলত কবির মননশীলতারই ধারক।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।