আগাম সবজি চাষে সফল জিসান, চলতি মৌসুমেই বিক্রি সাড়ে ৩১ লাখ
আগাম সবজি চাষে সফল জিসান: জাগো নিউজ
ছোটবেলা থেকে কৃষির প্রতি গভীর আগ্রহ নিয়ে মাঠে নামেন মোহাম্মদ জিসান। গত ১০ বছর ধরে আগাম শাক-সবজি চাষের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মৌসুমে আগাম জাতের নানা ধরনের শাক-সবজি চাষ করে আসছেন। চলতি মৌসুমের শুরুতেই ৩১ লাখ ৪০ হাজার টাকার আগাম শাক-সবজি বিক্রি করেছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার পৌরসভার এক নং ওয়ার্ডের তরছ পাড়া গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে মোহাম্মদ জিসান (বয়স ২৫)। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় এই তরুণ।
জিসানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিসানের কৃষিজীবনের শুরুটা খুব ছোটবেলায়। ২০০৯ সালে যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই তিনি বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে হাত লাগাতে শুরু করেন। মাঠে বাবাকে কাজ করতে দেখে তার মনে কৃষির প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। ধীরে ধীরে কৃষির বিভিন্ন দিক শিখতে থাকেন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেন জিসান।
এরপর ২০১৫ সালে, তখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছেন—সেই সময় থেকেই সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাষের পদ্ধতি, মাটির যত্ন, বীজ নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আরও গভীরভাবে শিখে নেন। বাজারে ভালো দামের কারণে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আগাম শাক-সবজি চাষ শুরু করেন এই তরুণ। মুলা, শশা, লাউ, বরবটি, ফুলকপি, ধনিয়া পাতা, করলা ও বেগুনসহ আগাম জাতের বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করেন। ধীরে ধীরে আগাম সবজি চাষে সফলতা পেতে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে চারদিকে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন জিসান।

বর্তমানে লিজ নেওয়া প্রায় ২০-২২ বিঘা জমিতে এসব চাষ করেন তিনি। প্রতি বিঘা জমির বার্ষিক ভাড়া ১৫-২০ হাজার টাকা। চলতি শীত মৌসুমের শুরুতেই ৩১ লাখ ৪০ হাজার টাকার আগাম শাকসবজি বিক্রি করেছেন এই তরুণ।
পরিবারের সাপোর্ট ও উৎসাহ তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছে। পাশাপাশি মাঠের অভিজ্ঞ কৃষকদের পরামর্শ ও ‘কৃষকের প্রাণ কৃষি পরিবার’ ফেসবুক গ্রুপ থেকে রোগবালাইসহ বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা নেন এই উদ্যোক্তা।
আরও পড়ুন
কৃষির নতুন দিগন্ত সয়েল সেন্সর
উত্তরার দিয়াবাড়ি যেন নার্সারির রাজ্য
পাটবীজ চাষ করে সফল ফরিদপুরের চাষিরা
উদ্যোক্তা জিসান জানান, এ বছর ৪ বিঘা জমিতে ধনিয়া চাষ করে তিনি ৫ লাখ ২০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন। মরিচের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে লাগানো ৩ বিঘা ধনিয়া বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ৪ বিঘা শশা থেকে ৮ লাখ, ৪ বিঘা লাউ থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার এবং ৩ বিঘা জমিতে পরপর দুই দফা মুলা চাষ করে ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে।

করলা, বরবটি, বেগুন ও লালশাকসহ অন্যান্য ফসল মিলিয়ে আরও ৫-৬ লাখ টাকার সবজি বিক্রি করেছেন তিনি। মাঠে এখনো কিছু ফলন রয়েছে, যা বিক্রি হলে আয় আরও বাড়বে বলে জানান জিসান। তিনি বলেন, করলা, বরবটি, বেগুন, লাল শাকসহ অন্যান্য ফসল থেকে আরও ৫-৬ লাখ টাকা বিক্রি করেছি। মাঠে এখনো কিছু ফলন রয়েছে, যা বিক্রি হলে আয় আরও বাড়বে।
তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, ‘সব খরচ বাদে প্রতি সিজনে মোটা অঙ্কের লাভ থাকে। আগাম চাষে ঝুঁকি হলেও এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। কোনো জমি খালি রাখি না। একটা সবজি শেষ হওয়ার আগেই অন্য সবজি নিয়ে পরিকল্পনা করি। এই চাষের মাধ্যমে পরিবারের আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। এক সময় আমাদের কাছে কিছুই ছিল না। ঝুঁকি নিয়ে আগাম সবজি চাষের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি।’
চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি জানান, প্রতিটি ফসলের জন্য আলাদা প্রস্তুতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করেন। শশা, লাউ, করলা ও বেগুনের ক্ষেত প্রস্তুতে মালচিং ব্যবহার করা হয়। এতে ফলনও বেড়ে যায়। মুলা চাষের ক্ষেত্রে জমিকে একটু উঁচু করে শক্ত বেড় তৈরি করেন, যাতে পানি ঠিকভাবে নিষ্কাশিত হয় এবং মুলা ভালোভাবে বড় হতে পারে। ধনিয়া ও বরবটির জন্য তুলনামূলক হালকা বেড় তৈরি করেন।

এভাবে পরিকল্পিত জমি প্রস্তুতি, আধুনিক কৃষি পদ্ধতির ব্যবহার এবং ফসলভেদে ভিন্ন যত্ন নেওয়ার ফলে প্রতি বছরই ভালো ফলন পান এবং আগাম সবজি চাষে সফল হয়ে উঠেছেন এই উদ্যোক্তা।
আরও পড়ুন
আখ চাষে ঝুঁকছেন বাগেরহাটের কৃষকেরা
মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপণে ব্যস্ত চাষিরা, সার-খরচ নিয়ে চিন্তা
মিরসরাইয়ে অসময়ে তরমুজ চাষে সফল কৃষকেরা
আগাম চাষের খরচ ও ফলন কেমন হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে জিসান বলেন, ‘আগাম চাষে সাধারণত ফলন কিছুটা কম হয়। আর খরচও তুলনামূলক বেশি; কারণ রোগের আক্রমণ বেশি হয় এবং সফলভাবে চাষ করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। তবে লাভের বিষয়টি আলাদা। আগাম সবজি বাজারে সাধারণত অনেক দামে বিক্রি হয়। যদি ফলন ভালো হয় এবং বাজারে চাহিদা থাকে, তাহলে লাভও বেশি হয়। অর্থাৎ লাভের পরিমাণ মূলত ফলন এবং বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে।’

ভবিষ্যত পরিকল্পনার প্রসঙ্গে তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, সবজি চাষের পাশাপাশি ভবিষ্যতে আগাম তরমুজ, সাম্মাম এবং ফুল চাষ করার পরিকল্পনা আছে। তাই এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে কিছু চাষ করেছি।
এমআইএইচ/জেআইএম