ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জোকস

জসীম উদদীনের মজার গল্প: ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৩৩ পিএম, ২৬ জুলাই ২০২২

বাপ মরে গিয়েছে। ঘুঘু আর ফাঁদ দুই ভাই। কি একটা কাজে দুই ভাইয়ের লাগল মারামারি। ফাঁদ রেগে বললো, ‘তুই ঘুঘু দেখেছিস। কিন্তু ফাঁদ দেখিস নাই।’

ঘুঘু রাগ করে বাড়ি হতে পালিয়ে গেল। বিদেশে গিয়ে সে এ বাড়ি, সে বাড়ি, কত বাড়ি ঘুরল। সবাইকে বললো, আমি ধান নিড়াইতে পারি, পাট কাটতে পারি, গরুর হেফাজত করতে পারি। কিন্তু কার চাকর কে রাখে! দেশে বড় আকাল। অবশেষে ঘুঘু গিয়ে উপস্থিত হল কিরপন (কৃপণ) মোল্লার বাড়ি। কিরপন মোল্লা চাকর রেখে খেতে দেয় না, খেতে দিলেও তার বেতন দেয় না, তাই কেউই তার বাড়িতে চাকর থাকে না।

ঘুঘুকে দেখে কিরপন মোল্লা বলল, ‘আমার বাড়িতে যদি থাকতে চাও তবে প্রতিদিন তিন পাখি করে জমি চাষ করতে হবে, বেগুন ক্ষেত সাফ করতে হবে। আর যখন যে কাজ করতে বলব তাই করতে হবে। তেঁতুল পাতায় যতটা ভাত ধরে তাই খেতে দিব। উহার বেশি চাইলে দিব না। মাসে আট আনা করে বেতন দিব। উহাতে রাজী হলে আমার বাড়ি থাকতে পার।’

আর কোথাও কাজ যখন জোটে না, ঘুঘু তাতেই রাজী হল। কিরপন মোল্লা বললো, ‘আমার আরও একটি শর্ত আছে। আমার কাজ ছেড়ে যেতে পারবে না। কাজ ছেড়ে গেলে তোমার নাক কেটে নিব।’

ঘুঘু বললো, ‘আমি এই শর্তেও রাজী আছি।’ কিরপন মোল্লা পাকা লোক। সে গ্রামের লোকজন ডেকে সব শর্ত একটি কলা পাতায় লিখে নিল। তিন পাখি জমি চাষ করতে ঘুঘুর প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল। তারপর গোসল করে খেতে আসল। কিরপন মোল্লার বউ বললো, ‘তেঁতুল পাতা নিয়ে আস।’

ঘুঘু একটি তেঁতুল পাতা এনে সামনে বিছিয়ে খেতে বসল। তেঁতুল পাতায় আর কয়টিই বা ভাত ধরে? একে তো সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম! এমন ক্ষুধা পেয়েছে যে পুরো দুনিয়া গিলে খেলেও পেট ভরবে না। সেই তেঁতুল পাতার উপরে চারটি ভাত মুখে দিয়ে ঘুঘু কিরপন মোল্লার বৌকে কাকুতি মিনতি করলো, ‘আর কয়টি ভাত দিন।’

কিরপন মোল্লা সঙ্গে সঙ্গেই তার কলা পাতায় লেখা শর্তগুলো পড়ে শুনিয়ে দিল। বেচারা ঘুঘু ধীরে ধীরে উঠে বেগুন ক্ষেত সাফ করতে গেল। রাতে আবার সেই তেঁতুল পাতায় বাড়া ভাত। সারাদিনের হাড় ভাঙ্গা খাটুনি। তিন চারদিনেই ঘুঘু একেবারে আধমরা হয়ে গেল। তখন চাকরি না ছাড়লে জীবন যায় যায় অবস্থা; কিন্তু যখনই কিরপন মোল্লার কাছে চাকরি ছাড়ার কথা বলেছে তখনি সে তার নাকটা কেটে ফেলল। নেকড়া দিয়ে কোনো রকমে নাক বেঁধে ঘুঘু দেশে ফিরল।

তার ভাই ফাঁদ জিজ্ঞাসা করল,‘কিরে! তোর নাকটা কাটা কেন?’ ঘুঘু কেঁদে পুরো ঘটনা খুলে বললো। শুনে ফাঁদ বললো, ‘ভাই! তুমি বাড়ি থাক। আমি যাব কিরপন মোল্লার বাড়ি চাকরি করতে।’ ঘুঘু কত বারণ করলো। ফাঁদ তা কানেও নিল না। সে বললো, ‘কিরপন মোল্লা ঘুঘু দেখেছে কিন্তু ফাঁদ দেখে নাই। আমি তাকে ফাঁদ দেখিয়ে আসতেছি।’

ফাঁদ গিয়ে কিরপন মোল্লার বাড়িতে উপস্থিত। জিজ্ঞাসা করলো, ‘আপনারা কোনো চাকর রাখবেন?’ কিরপন মোল্লা বললো, ‘আমার একজন চাকর ছিল সে অল্প কয় দিন হয় চলে গেছে। তা তুমি যদি থাকতেই চাও, তবে আমার কয়েকটি শর্ত আছে। তা যদি মেনে নাও তবেই তোমাকে রাখতে পারি।’

ফাঁদ জিজ্ঞাসা করল, ‘কি কি শর্ত?’ কিরপন মোল্লা কলার পাতায় লেখা আগের চাকরের শর্তগুলো তাকে পড়ে শোনাল। ‘প্রতিদিন তিন পাখি করে জমি চষিতে হবে। বেগুন ক্ষেত সাফ করতে হবে। আর যখন যে কাজ বলব তা করতে হবে! তেঁতুল পাতায় করে ভাত দিব! মাসে আট আনা (৫০ পয়সা) করে বেতন। চাকরি ছেড়ে গেলে নাক কেটে রাখব।’

ফাঁদ সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে বললো, ‘আমারও একটি শর্ত আছে। আমাকে চাকরি হতে বরখাস্ত করতে পারবেন না। বরখাস্ত করলে আমি আপনার নাক কেটে নিব।’ কিরপন মোল্লা বলল, ‘বেশ, তাতেই আমি রাজী।’ সে পাড়ার আরও দশজনকে ডেকে সাক্ষী মেনে আর একটা কলা পাতায় সমস্ত শর্ত লিখে নিল।

সকালে ফাঁদ চললো ক্ষেতে লাঙল চষিতে। সে তিন পাখি জমির এদিক হতে ওদিকে দিল এক রেখ, আর ওদিক হতে এদিক দিল এক রেখ। এইভাবে পুরো জমিতে তিন চারটি রেখা দিয়ে গরু-বাছুর নিয়ে, বেলা দশটা না বাজতেই বাড়ি ফিরে আসল। এসেই বললো, ‘ক্ষেতে লাঙল দেওয়া শেষ হয়েছে। এখন আমাকে খেতে দাও।’

কিরপন মোল্লার বউ বললো, ‘আগে তেঁতুল পাতা নিয়ে আস।’ ফাঁদ বললো, ‘একটি ধামা দাও আর একখানা কুড়াল আমাকে দাও।’ ধামা কুড়াল নিয়ে ফাঁদ কিরপন মোল্লার উঠানের তেঁতুল গাছটির বড় ডালটি কেটে ফেললো।

কিরপন মোল্লার বউ চেঁচাতে লাগলো, ‘কর কি? কর কি? গাছটা তুমি কেটে ফেললে?’ কার কথা কে শোনে। সেই কাটা ডাল হতে মুঠি মুঠি তেঁতুল পাতা এনে অর্ধেক উঠানে বিছিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার আমাকে ভাত দাও।’

কিরপন মোল্লার বউ সামান্য কয়টি ভাত একটি তেঁতুল পাতার উপর দিতে যাচ্ছিল। ফাঁদ বললো, ‘আমার সঙ্গে চালাকি করলে চলবে না। শর্তে লেখা আছে তেঁতুল পাতায় করে ভাত দিতে হবে। কয়টা তেঁতুল পাতায় করে ভাত দিতে হবে তা লেখা নাই। সুতরাং তোমাদের উঠানে যতগুলো তেঁতুল পাতা বিছিয়েছি তার সবগুলো ভরে ভাত দিতে হবে।’

কিরপন মোল্লা তার ভাঙ্গা চশমা জোড়া নিয়ে সেই কলার পাতায় লেখা শর্তগুলো বহুক্ষণ পরীক্ষা করলো। ফাঁদ যা বলেছে তা সত্য। সে তখন বউকে বললো, ‘দাও, হাঁড়িতে যত ভাত আছে তেঁতুল পাতার উপর বেড়ে দাও।’

একবার ভাত দেওয়া হলে ফাঁদ বলল, ‘আরও ভাত এনে দাও। সমস্ত তেঁতুল পাতা ভাতে ঢাকে নাই।’ কিরপন মোল্লার বউ কি আর করে? হাঁড়িতে যত ভাত ছিল সব এনে সেই তেঁতুল পাতায় ঢেলে দিল। ফাঁদ বললো, ‘ইহাতে আমার পেট ভরবে না। আরও ভাত এনে দাও।’

কিরপন মোল্লার বউ বললো, ‘আর ভাত হাড়িতে নাই।’ কিরপন মোল্লা বললো, ‘কাল তোমার জন্য আরও বেশি করে ভাত রান্না করব। আজ এগুলোই খাও।’ ফাঁদ কতক খেল-কতক ছিটিয়ে ফেলল। তারপর ঢেঁকুর তুলতে তুলতে হাত মুখ ধুতে লাগল।

বিকাল হলে কিরপন মোল্লা ফাঁদকে বললো, বেগুন ক্ষেত সাফ করতে। ফাঁদ গিয়ে সব বেগুন গাছ কেটে ফেললো। কিরপন মোল্লা হায় হায় করে মাথায় হাত দিয়ে বেগুন ক্ষেতের পাশে বসে পড়ল। ফাঁদকে বলল, ‘ও ফাঁদ! তুই তো আমার সর্বনাশ করেছিস।’

ফাঁদ বলল, ‘তুমি আমাকে বেগুন ক্ষেত সাফ করতে বলেছ। বেগুন গাছ না কাটিলে ক্ষেত সাফ হবে কেমন করে?’ তার পরদিন কিরপন মোল্লা ফাঁদকে পাঠাল ধান ক্ষেত নিড়াতে। ফাঁদ ক্ষেতের সব ধান গাছ কেটে ঘাসগুলো রেখে আসল।

একদিন তাকে নদীতে পাঠালো জাল ফেলতে। জাল ফেলতে মানে নদীতে গিয়ে জাল দিয়ে মাছ ধরতে। ফাঁদ সেই কথাটার উল্টা ব্যাখ্যা করলো। নদীতে গিয়ে সে কিরপন মোল্লার এত হাউসের খেপলা জালটা ফেলে দিয়ে আসল। কিরপন মোল্লা নদীতে গিয়ে এত খোঁজাখুঁজি করলো। অত বড় নদী কোথায় জাল তলিয়ে গেছে! খুঁজে বের করতে পারল না।

এরপর একদিন সন্ধ্যাবেলা তার ছেলেটি ধুলো কাদা গায়ে মেখে নোংরা হয়েছিল। কিরপন মোল্লা বললো ‘ফাঁদ, যাও তো ছেলেটাকে সাফ করে আন।’

ফাঁদ তার ছেলেটিকে পুকুরের কাছে নিয়ে গিয়ে পানিতে চুবিয়ে ধোপার পাটে দিল তিন চার আছাড়। ছেলের হাত পা শরীর ফেটে গেল। সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কিরপন মোল্লা তাড়াতাড়ি ফাঁদের হাত হতে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে বকতে লাগল।

ফাঁদ বললো, ‘আমাকে বকলে কি হবে? আপনি ছেলেকে সাফ করে আনতে বলেছেন। ধোপার পাটে না আছড়াইলে (আছাড় দিলে) তাকে সাফ করব কীভাবে?’

রাত্রে কিরপন মোল্লা আর তার বউ মনে মনে ফন্দি আঁটে, কি করে এই দুর্মুখ চাকরকে বিদায় করা যায়, কিন্তু কোনো উপায় নাই। তাকে বরখাস্ত করলেই কলা পাতায় লেখা শর্তানুসারে সে কিরপন মোল্লার নাক কেটে নিবে।

পরদিন সকালে কিরপন মোল্লা ফাঁদকে একটি বড় গাছ ফেড়ে চেলা (চিকন ও লম্বা কাঠের টুকরা) বানাতে হুকুম করল। ফাঁদ গাছটি কেটে অনেক গুলো চেলা বানালো। তারপর চেলার বোঝা মাথায় করে বাড়ি ফিরল।

কিরপন মোল্লার বৃদ্ধ মা বারান্দায় বসে পান চিবাচ্ছিল। ফাঁদ তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘খড়ির বোঝা কোথায় নামাব?’ সারা উঠান খালি পড়ে আছে। যেখানে সেখানে নামান যায়। তবুও ফাঁদ এই সামান্য ব্যাপারটির জন্যে বুড়িকে জিজ্ঞাসা করায় বুড়ি ভীষণ রেগে গেল। সে বলল, ‘বুঝতে পার না কোথায় নামাতে হবে? আমার ঘাড়ে নামাও।’

যেই বলা অমনি ফাঁদ খড়ির বোঝা বুড়ির ঘাড়ের উপর ফেলে দিল। ঘাড়ের উপর এতগুলো কাঠের ভার সইতে না পেড়ে বুড়ি দাঁত কেলিয়ে মরে গেল। কিরপন মোল্লা ফাঁদকে কিছু বলতেও পারে না। কারণ সে বুড়ির আদেশ মতোই কাজ করেছে। ফাঁদকে বাড়ি হতে তাড়িয়ে দিতে গেলেও সে তার নাক কেটে নিবে। ফাঁদকে নিয়ে কি করা যায়?

প্রতিদিন সে একটা না একটা অঘটন করে বসে। অনেক ভেবে চিন্তে কিরপন মোল্লা ঠিক করলো, সে আর তার বউ তীর্থযাত্রা গিয়ে অন্তত কিছুদিনের জন্য ফাঁদের হাত হতে রক্ষা পাবে। যাওয়ার সময় কিরপন মোল্লা ফাঁদকে বললো, ‘ফাঁদ! আমরা চললাম। তুই বাড়ি-ঘর দেখিস।’ ফাঁদ জবাব দিল, ‘আর বলতে হবে না। তোমরা নিশ্চিন্তে চলে যাও। আমি সব দেখব।’

কিরপন মোল্লা চলে গেল। ফাঁদ তার ভাই ঘুঘুকে ডেকে এনে বাড়ির সর্বেসর্বা হয়ে বসলো। বাড়িতে আম, জাম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল, কত রকমের গাছ। দুই ভাই সেই সব গাছের ফল বিক্রি করে অনেক টাকা জমাল। তার মধ্যে গ্রামে আসল সেটেলমেন্টের আমিন। ফাঁদ কিরপন মোল্লার বাড়ি-ঘর, জমা-জমি সকল নিজের নামে লিখিয়ে নিল।

কিছুদিন পরে তীর্থ থেকে কিরপন মোল্লা আর তার বউ দেশে ফিরলো। ফাঁদ তাদের বাড়িতে ঢুকতে দিল না। সে বললো, ‘এ বাড়ি তো আমাকে বেচে গিয়েছো। দেখ না গিয়ে সেটেলমেন্টের অফিসে, সেখানে বাড়ি আমার নামে লেখা হয়েছে।’

গচ্ছিত টাকা-পয়সা যা ছিল তা কিরপন মোল্লা তীর্থে গিয়ে খরচ করে এসেছে। ফাঁদের নামে মামলা করার টাকা পাবে কোথায়? আর মামলায় জিতলেই বা কি হবে? কলার পাতায় লেখা যে শর্তে সে ফাঁদের সঙ্গে আটকা পড়েছে তাহা হতে কে তাকে রক্ষা করবে?

কিরপন মেল্লার বাড়িতে ফাঁদ আর ঘুঘু সুখে বাস করতে লাগল। কিরপন মোল্লার উপর কারো কোনো দয়া নাই! কারণ সে বিনা অপরাধে ঘুঘুর নাক কেটেছিল। সে গ্রামের কোনো মানুষের কোনো উপকার করে নাই বা কাউকেই কোনোদিন আধ পয়সাও দান করে নাই।

লেখা: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

প্রিয় পাঠক, আপনিও অংশ নিতে পারেন আমাদের এ আয়োজনে। আপনার মজার (রম্য) গল্পটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়। লেখা মনোনীত হলেই যে কোনো শুক্রবার প্রকাশিত হবে।

কেএসকে/জিকেএস

আরও পড়ুন