মাদারীপুর
গ্রামে গ্রামে দালাল, বিদেশযাত্রায় নিঃস্ব শত শত পরিবার
ভুক্তভোগীদের ছবি হাতে স্বজনরা। ছবি-জাগো নিউজ
মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের পখিরা গ্রামের বাসিন্দা রাকিব মহাজন (২৩)। ইচ্ছা ছিল অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে স্বপ্নের দেশ ইতালি যাবেন। এজন্য যোগাযোগ করেন দালালদের সঙ্গে। তারা ইতালি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তাদের কথায় আস্থা রাখেন রাকিব মহাজন ও তার পরিবার।
তবে রাকিবের কপালে বোধহয় অন্য কিছুই লেখা ছিল। দালালচক্রের ফাঁদে পড়েন তিনি। দফায় দফায় রাকিবের পরিবারের কাছ থেকে ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দালালরা। শুধু তাই নয়, দালালচক্রকে এত পরিমাণ টাকা দিয়েও প্রাণে বাঁচতে পারেননি রাকিব। দীর্ঘ তিন বছর গেমঘরে বন্দি থেকে লিবিয়ায় দালালদের নির্যাতনে মারা যান তিনি।
নিহত রাকিবের বাবা নাজিম উদ্দিন মহাজন বলেন, ‘দফায় দফায় টাকা দিয়ে আমি সর্বস্বান্ত। আমার ছেলেকে না খাইয়ে ও নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে। আমি দালালদের বিচার চাই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু রাকিব মহাজন নন; ইতালি যেতে গিয়ে দালালদের ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য যুবক। নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার।
‘লিবিয়ায় নির্যাতনের পাশাপাশি অনেকের ঠাঁই হয় কারাগারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের কোনো লিখিত কাগজপত্র থাকে না। ফলে আইনের আশ্রয় চাইলেও বেশিরভাগ দালালই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। এ কারণেই দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন মাদারীপুরের দালালরা।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রায় ৩০ বছর ধরে মাদারীপুরের বহু যুবক অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে ইতালি যান। যাওয়ার পথে সমুদ্রে প্রাণ গেছে অনেক যুবকের। অনেককে বরণ করতে হয়েছে লিবিয়ায় বন্দিজীবন। এতে নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার। তবুও মাদারীপুর থেকে ইতালি যাওয়ার এ প্রবণতা কমছে না; বরং দিন দিন সংখ্যা বেড়েই চলছে।
ভুক্তভোগী ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইতালি যাওয়ার জন্য প্রথমদিকে দালালদের ব্যবহার থাকে খুবই মধুর। এরপর তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়ে চুক্তি করেন। ভালো সম্পর্ক আর সর্বোচ্চ বিশ্বাসের ফুলঝুরি দিয়ে ১২-১৫ লাখ টাকার মধ্যে চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী টাকা পাওয়ার পর কয়েকটি দেশ ঘুরিয়ে লিবিয়ায় আনা হয়। লিবিয়ায় আনার পর দালালদের শুরু হয় নানান টালবাহানা। এক দালাল চক্র থাকে মাদারীপুরে, আরেকটি লিবিয়ায়। লিবিয়ায় থাকে মাফিয়া চক্র। মূলত এই তিন চক্রের মাধ্যমে চুক্তির ১২-১৫ লাখ টাকা দাঁড়ায় ৪০-৫০ লাখ টাকায়। সেই টাকা না পেলে শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন।
সেই নির্যাতনের ভিডিও পাঠানো হয় পরিবারগুলোতে। তখন বাধ্য হয়ে জমি-জমা, বাড়িঘর বিক্রি করে দালালদের হাতে তুলে দিতে হয় লাখ লাখ টাকা। এতে পরিবারগুলো জড়িয়ে পড়ে ঋণের জালে।

এদিকে তিন দালাল চক্রের টাকা হাতে পৌঁছে গেলে ইতালিপ্রত্যাশীদের তোলা হয় গেমঘরে। সেই গেমঘর থেকে তাদের সুযোগ বুঝে ছোট ছোট নৌকায় পাঠানো হয় সমুদ্রপথে। ভাগ্য ভালো হলে কেউ পৌঁছে যান স্বপ্নের দেশ ইতালি। ভাগ্য সহায় না হলে প্রাণ যায় সমুদ্র ডুবে।
- আরও পড়ুন:
- ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে নির্যাতন, সাতক্ষীরায় কাঁদছে পরিবার
- দালালরা হাতিয়েছে ৪৪ লাখ টাকা, বন্দিদশা থেকে বেঁচে ফিরলেন সাগর
- ‘মৃত ভেবে মরুভূমিতে ফেলে গিয়েছিল, ভাবিনি বেঁচে দেশে ফিরবো’
- লিবিয়ার ‘গেম ঘর’ থেকে ফিরলেন লোকমান, জলে গেলো ২২ লাখ টাকা
ভুক্তভোগীরা জানান, লিবিয়ায় নির্যাতনের পাশাপাশি অনেকের ঠাঁই হয় কারাগারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের কোনো লিখিত কাগজপত্র থাকে না। ফলে আইনের আশ্রয় চাইলেও বেশিরভাগ দালালই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। এ কারণেই দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন মাদারীপুরের দালালরা।
‘ইতালি যাওয়ার জন্য প্রথমদিকে দালালদের ব্যবহার থাকে খুবই মধুর। এরপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়ে চুক্তি করেন তারা। ভালো সম্পর্ক আর সর্বোচ্চ বিশ্বাসের ফুলঝুরি দিয়ে ১২-১৫ লাখ টাকার মধ্যে চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী টাকা পাওয়ার পর কয়েকটি দেশ ঘুরিয়ে লিবিয়ায় আনা হয়। লিবিয়ায় আনার পর দালালদের শুরু হয় নানান টালবাহানা।’
মাদারীপুর জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২০২৪ পর্যন্ত মাদারীপুর জেলায় মানবপাচার মামলা হয়েছে ৩১৫টি। এরমধ্যে থানায় করা মামলার সংখ্যা ১৮টি, আদালতে করা হয় ২৯৭টি। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা এক হাজার ১৩৯ জন। যার মধ্যে থানায় করা মামলায় আসামি ৯৩ জন এবং আদালতের মামলায় আসামির সংখ্যা এক হাজার ৪৬ জন। গ্রেফতার হয়েছেন ১৫৫ জন। গত পাঁচ বছরে আদালতে অভিযোগপত্র জমা হয়েছে ১৩৬টি। আদালতে ৭৮টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। বর্তমানে ১০১টি মানবপাচার মামলা তদন্তাধীন। এর বাইরে বেশকিছু মামলা প্রত্যাহারও করেছেন বাদীরা।
গ্রামে গ্রামে দালাল
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদারীপুরের পাঁচটি উপজেলায় গ্রামে গ্রামে রয়েছে দালালদের বিস্তার। রাজৈর পৌরসভার গোবিন্দপুর গ্রামের মিরাজ, পাইকপাড়া ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের ইলিয়াস, খালিয়ার পশ্চিম স্বরমঙ্গলের মাঝিকান্দি গ্রামের ওহিদুল, খালিয়া ইউনিয়নের শাহীন সর্দার, ফিরুজ মোল্লা, সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের দুর্গাবর্দী গ্রামের নুরুল আমিন, রাজৈর উপজেলায় শরীফ, খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী, বাজিতপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান, সদর উপজেলার বড়াইলবাড়ির জামাল খাঁ ও রুবেল খাঁ, শ্রীনাথদি বাজিতপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, কুমড়াখালীর এমদাদ ব্যাপারী, চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, নয়াচর গ্রামের মহসিন মাতুব্বর ও মিজান মাতুব্বর, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাস তালুকদার, হোসেনপুরের জাকির হোসেন, টেকেরহাটের লিয়াকত, কদমবাড়ির রবিউল, শাখারপাড়ের কামরুল মোল্লা, এমরান মোল্লা, আমগ্রাম ইউনিয়নের শামীম ফকির, সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের শহিদুল মাতুব্বর, সিরাজ মাতুব্বর, সদর উপজেলার দেলোয়ার সরদার, সাগর, সোহাগ মুন্সি, হাবিব ফকির, সাগরসহ হাজারের বেশি দালাল জেলাজুড়ে ছড়িয়ে আছে।
শুধু জেলায় নয়, পার্শ্ববর্তী শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জের দালালরাও মাদারীপুরের মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। এসব দালালের বেশিরভাগ ঘরই থাকে তালাবদ্ধ।
বিষয়টির সত্যতা জানতে রাজৈরের দুর্গাবর্দি গ্রামে গেলে সেখানকার এক দালাল ইলিয়াস মীরের ঘর তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। এরপর মাদারীপুর সদর উপজেলার তালতলা বাজারসংলগ্ন দালাল সোহাগ মুন্সির বাড়িতে গিয়েও ঘর তালাবদ্ধ দেখা গেছে। এসময় ইতালি যাওয়ার বিষয়ে কথা বললে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সোহাগের মা লুৎফুন নেছা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘লোকজন টাকার জন্য চাপ দেয়। তাই এভাবে থাকতে হচ্ছে।’
দালাল সোহাগের মাধ্যমে শতাধিক মানুষ লিবিয়া গেছে। কেউ যেতে পেরেছেন ইতালি। এখনো জিম্মি অনেকে।
‘এক দালাল চক্র থাকে মাদারীপুরে, আরেকটি চক্র লিবিয়ায়। মূলত এ চক্রের মাধ্যমে চুক্তির ১২-১৫ লাখ টাকা দাঁড়ায় ৪০-৫০ লাখ টাকায়। সেই টাকা না পেলে শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন।’
রাজৈরের কৃষ্টপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সুলতান শেখের ছেলে মাহবুব শেখ। দালালদের মাধ্যমে লিবিয়ায় যান। দুবার ধরা পড়েন লিবিয়ার কোস্ট গার্ডের হাতে। তিনি রাজৈরের বদরপাশার মিলন দালালের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকায় চুক্তি করেন।
ইতালিপ্রত্যাশী মাহবুবের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বদরপাশার মিলন দালালের মাধ্যমে ছেলে লিবিয়ায় গেছে। চুক্তি ছিল ১০ লাখ টাকায় পৌঁছে দেবে ইতালি। পরে দালাল বিভিন্ন অজুহাতে ৩২ লাখ টাকা নিয়েছে। এই টাকা সংগ্রহ করতে জমি বিক্রি, বাড়ি বন্ধক ও সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছি।’
- আরও পড়ুন:
- দালালকে ৪৬ লাখ টাকা দিয়েও বাঁচানো গেল না সজিবকে
- লিবিয়ায় পাচারের পর নির্যাতন, ‘মৃত্যুকূপ’ থেকে ফিরলেন ৫ বাংলাদেশি
- লিবিয়া উপকূলে ভেসে এলো ২০ মরদেহ, সবাই বাংলাদেশি হওয়ার আশঙ্কা
- লিবিয়ায় নিয়ে ভিডিওকলে রেখে নির্যাতন, ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক মাস আগেও লিবিয়া হয়ে ইতালি যেতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফেরেন মাদারীপুরের অর্ধশত যুবক। ভিটেমাটি বিক্রি করে যাওয়া ওইসব ভুক্তভোগী মানবপাচারকারী ও মাফিয়া দালাল চক্রের সদস্য মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের দালাল হাবিব ফকির ও রুবেল ফকির হাতে তুলে দেন লাখ লাখ টাকা। এই দালালের মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা হলেন একই ইউনিয়নের ছোট খালপাড় গ্রামের নুরুল ইসলাম মাতুব্বারের ছেলে ফারুক মাতব্বর, বড় বাড্ডা গ্রামের আজিজ মাতুব্বরের ছেলে নুরুজ্জামান মাতুব্বর, ছোট বাড্ডা গ্রামের নূর মোহাম্মদ বয়াতির ছেলে মোক্তার বয়াতি, বড় বাড্ডা ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কবির মাতুব্বরের ছেলে সালমান মাতুব্বর, ঘটমাঝি ইউনিয়নের উত্তর ঝিকরহাটি এলাকার লালচান হাওলাদারের ছেলে আরমান হাওলাদারসহ অর্ধশত যুবক।

কালকিনি উপজেলার দালাল খোকন চোকদার বিদেশে নেওয়ার কথা বলে কালকিনি পৌরসভার ঝাউতলা গ্রামের মেহেদি হাসান, ডাসারের বালিগ্রামের সুমন হাওলাদার ও মাইনুল হোসাইন, ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম, মাইজপাড়া, সদর উপজেলার মস্তফাপুর, মাদ্রাসহ প্রায় ৪০টি গ্রামের শতাধিক যুবককের কাছ থেকে ৭-১২ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারণা করেন।
রাজৈর উপজেলার হরিদাসদি এলাকার আরেক দালাল বেলায়েত হাওলাদারের মাধ্যমে রাজৈরের ইভান খালাসী, পাঠানকান্দির নাইম হাওলাদার, হরিদাসদির সফিকুল ইসলাম নয়ন, রায়হান হোসেনসহ বহু যুবক প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
ভুক্তভোগী রায়হান হোসেনের দুলাভাই রাজৈরের বদরপাশার দারাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, ‘বেলায়েত ও সুমনের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অনেক যুবক সর্বস্বান্ত হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিবচর উপজেলার দক্ষিণ চরকামারকান্দি গ্রামের অনেক যুবককে ইতালি যাওয়ার প্রলোভন দেখান মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের হোসেনের হাট গ্রামের দালাল আবুল কালাম মুন্সি।
স্থানীয় বাসিন্দা বিএম রাসেল বলেন, ‘আমাদের একই গ্রামের কমপক্ষে ৫০ জন যুবক দালাল আবুল কালামের কাছে টাকা দিয়েছিলেন ইতালি যাওয়ার জন্য। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে একেকজনের কাছ থেকে ৪০-৫০ লাখ টাকা নিলেও এখন বেশিরভাগ যুবকের সঙ্গেই পরিবারের যোগাযোগ নেই। তারা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তাও তারা জানে না। এই দালালের প্রলোভনে পড়ে অনেকেই নিজের শেষ সম্বল ভিটেমাটি হারাচ্ছেন।’
আরেক দালাল মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পূর্ব কমলাপুর গ্রামের কাদের মাতুব্বরের ছেলে কামাল মাতুব্বর। তার বিরুদ্ধে অর্ধশত মানুষের অভিযোগ। তিনি ডাসার উপজেলার উত্তর খিলগ্রামের বাসিন্দা রাজিব মাতুব্বর, নিজাম সরদার, তাইফুল, তারেক মাতুব্বরসহ একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে সরাসরি ইতালি নেওয়ার কথা বলে চুক্তি করেন। প্রথমে ১৩ লাখ টাকা করে নিলেও পরবর্তীসময়ে লিবিয়ায় আটকে রেখে লাখ লাখ টাকা নেন।
ভুক্তভোগীদের একজন রাজিব মাতুব্বর জাগো নিউজকে বলেন, ‘পূর্ব কমলাপুরের কামাল মাতুব্বর আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে ইতালি নেওয়ার কথা বলে। কামালের দুই ছেলে ইতালি থাকে। এজন্য প্রলোভনে পড়ে যাই। কিন্তু ইতালির পরিবর্তে লিবিয়ায় নিয়ে বন্দিশালায় আটকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয় কামাল। পরে অমানবিক নির্যাতন করে লাখ লাখ আদায় করে কামাল ও তার চক্রের সদস্যরা। একপর্যায়ে একটি ছোট নৌকায় লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠালে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ছয় মাস জেলে ছিলাম। সেখান থেকে বাংলাদেশ সরকার আমাকে ফেরত আনে। আমি ও আমার পরিবার এখন পুরোপুরি নিঃস্ব। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।’
চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১০ জন মারা যান। এ ঘটনায় মূলহোতা রাজৈর হরিদাসদি গ্রামের দালাল স্বপন মাতুব্বর, মজুমদারকান্দি গ্রামের দালাল মনির হাওলাদার ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আলীপুরের দালাল রফিক।
এদিকে পাঁচ মাস ধরে রাজৈরের ১৪ যুবক নিখোঁজ আছেন। রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের সাধুর আশ্রম এলাকার মৃত আয়নাল হাওলাদারের ছেলে দালাল বাবুল হাওলাদার এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। জড়িত অন্যরা হলেন বাবুল হাওলাদারের মেয়ে সোনিয়া আক্তার ও শশি আক্তার এবং স্ত্রী চুন্নু বেগম।
এদিকে টাকা নেওয়ার পর থেকে কয়েক মাস ধরে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন অভিযুক্ত বাবুল ও তার পরিবার। শুধু তারাই নয়, মাদারীপুরের বেশিরভাগ দালালই ঘরে তালা দিয়ে অন্য কোথাও থাকছেন। তাই তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অবৈধপথে ইতালি যাত্রা
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানি। দালালের প্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুবকরা সমুদ্রপাড়ি দিতে গিয়েই পড়ছেন মৃত্যুর মুখে। নিখোঁজ রয়েছেন বহু যুবক।
- আরও পড়ুন:
- ইতালির কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে নির্যাতন, যুবকের মৃত্যু
- ‘পা ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে মাথা পর্যন্ত পেটাতো, এখন শরীরজুড়ে ব্যথা’
- ৪২ লাখ টাকায়ও মুক্তি মেলেনি আসাদের, খবর এলো মৃত্যুর
ভুক্তভোগী পরিবার ও বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে জানা যায়, কোনোভাবেই থামছে না অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাড়ছে প্রাণহানি। গত ১০ বছরে তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন মাদারীপুরের দুই শতাধিক যুবক। এখনো নিখোঁজ অনেকে। তবে এর নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা জানা যায়নি।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সাগরে ডুবে মারা যান রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৯), খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২), একই ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২২), কদমবাড়ির ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২৪) ও কবিরাজপুর ইউনিয়নের কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার হোসেন (২২)।
নিহত সজীব কাজীর চাচাতো ভাই মেহেদী কাজী বলেন, ‘এভাবে আমার ভাই মারা যাবে, কখনো ভাবতেই পারিনি। দালালদের কঠোর বিচার হওয়া উচিত। দালালদের কাজের সঙ্গে কথার কোনো মিল নেই।’
২০২৪ সালের ১৭ জুন অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূ-মধ্যসাগরে ডুবে প্রাণ হারান মাদারীপুরের শিবচর পৌরসভার খানকান্দি এলাকার ইউনুস হাওলাদারের ছেলে আলী হাওলাদার আলী হাওলাদার (৩২) নামের এক যুবক। একই ঘটনায় মারা যান মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের পশ্চিম কালাইমার গ্রামের মামুন আকনের ছেলে সাব্বির আকন (১৮)।
২০২৫ সালের ২৪ জানুয়ারি অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এতে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১০ জন মারা যান।
চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের খাটোপাড়া গ্রামের শহিদুল বেপারীর ছেলে সাইদুল বেপারী দালালদের নির্যাতনে মারা যান। একই বছরের ৪ মার্চ অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় মারা যান রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের চরমস্তফাপুর গ্রামের আবু হাওলাদারের ছেলে সুমন হাওলাদার (২২) ও একই উপজেলার শাখারপাড়ের সিদ্দিক মাতুব্বরের ছেলে নাসির মাতুব্বর (৩৪)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ আছেন রাজৈরের ১৫ যুবক। পাঁচ মাস ধরে তাদের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার।
নিখোঁজদের একজন সোলায়মান আকনের মা সালমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছেলেকে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এরপর দফায় দফায় মুক্তিপণের জন্য টাকা আদায় করে। কয়েক দফায় বিভিন্ন ব্যাংক হিসেবে মোট ৩৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এরপরও আমার ছেলের সন্ধান পাইনি। উল্টো আমাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির হুমকি দিচ্ছেন স্থানীয় দালাল হাওয়া বেগম এবং বাবুল মাতুব্বর।’
পুলিশ প্রশাসন সুশীল সমাজের বক্তব্য
স্থানীয় সংগঠন জাগো উন্নয়ন সংস্থার ফারজানা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘দালালচক্রকে নির্মূল না করায় একের পর এক নৌকাডুবিতে মারা যাচ্ছে মানুষ। প্রতিরোধে প্রয়োজন জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতা আর সচেতনতা বৃদ্ধি করা।’
স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী মশিউর রহমান পারভেজ বলেন, ‘মানবপাচারের ঘটনায় দালালদের কঠিন বিচার হলে সমাজ থেকে এ অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।’
দালালচক্রের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করার পাশাপাশি জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মাদারীপুর আদালতের আইনজীবী রেজাউল হক।

তিনি বলেন, দালালদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো আছে, তা তদন্ত করে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ভাস্কর সাহা বলেন, মাদারীপুর জেলাজুড়ে মানবপাচার চক্র সক্রিয়। একজন নয়, আলাদা আলাদাভাবে চক্র গড়ে উঠেছে। তবে যখনই মানবপাচারের ঘটনায় মামলা হচ্ছে, তখনই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, যুবকরা মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও স্বেচ্ছায় ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে দালালরা।
এসআর/এএসএম