ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

পাঁচ বছরেই মুমূর্ষু হাসপাতাল, ‘কিছুই জানেন না’ পরিচালক

মো. সজল আলী | মানিকগঞ্জ | প্রকাশিত: ০২:৫৫ পিএম, ০২ আগস্ট ২০২৫

শুরু নষ্ট যন্ত্রপাতি
তালাবদ্ধ এমআরআই যন্ত্র
অব্যবহৃত পড়ে আছে আইসিইউ
চিঠি পাঠালেও নীরব মন্ত্রণালয়

যাত্রা শুরুর বছর পাঁচেক না যেতেই নিজেই যেন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ২০২০ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া ৫০০ বেডের হাসপাতালটির অধিকাংশ বিভাগই এখন বন্ধের পথে। তবে হাসপাতালের বেহাল দশার বিষয়ে কিছুই জানেন না পরিচালক ডা. শফিকুল আলম।

জানা গেছে, আলট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই পরীক্ষাসহ সব ধরনের পরীক্ষাই বন্ধ রয়েছে হাসপাতালটিতে। এমনকি ডেন্টাল বিভাগের অধিকাংশ ডেন্টাল চেয়ার নষ্ট। কাঁচামাল সরবরাহ ও সংস্কার উদ্যোগ না নেওয়ায় ডেন্টাল বিভাগের সেবা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এছাড়াও দক্ষ জনবলের অভাবে শুরু থেকেই তালাবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে ৩০ বেডের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)।

ডেন্টাল বিভাগ

ডেন্টাল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হলেও এই বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয় ২০২১ সালে। তখন চারটি ডেন্টাল চেয়ার দেওয়া হয়। যার মধ্যে তিনটি চেয়ার নষ্ট ছিল। এখন একটি চেয়ার দিয়ে কোনো রকমে চলছে কার্যক্রম।

‘আমাদের জেলায় এত বড় হাসপাতাল থেকে কী লাভ, যদি আমরা চিকিৎসা না পাই। এই হাসপাতালে অনেক বড় ডাক্তার আছে শুনে চিকিৎসা নিতে এসেছিলাম। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে এসেও আমাদের টাকা খরচ করতে হয়।’

ডেন্টাল বিভাগের ইনচার্জ আয়উব আলী বলেন, ২০২১ সালে আমাদের ডেন্টাল বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে আমাদের চারটি মেশিন দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে দুইটি মেশিন নষ্ট ছিল। একটি মেশিন কোনো রকম চলতো, সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে একবার ঠিক করা হয়েছিল। এখন একটা ডেন্টাল চেয়ার দিয়ে কাজ করছি। প্রথমদিকে সামান্য কিছু উপকরণ দিয়েছিল। এরপর এখন পর্যন্ত আমরা কোনো উপকরণ পাইনি।

পাঁচ বছরেই মুমূর্ষু হাসপাতাল, ‘কিছুই জানেন না’ পরিচালক

রেডিওলজি বিভাগ

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতে অত্যাধুনিক তিনটি ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্র আছে। যার মধ্যে এখন দুইটি মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। একটি মেশিন ভালো আছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ সিটিস্ক্যান। হাসপাতালের শুরুর দিন থেকে কখনো আলোর মুখ দেখেনি এমআরআই যন্ত্র। প্রায় ১৮ কোটি টাকার মেশিনটি পড়ে আছে তালাবদ্ধ রুমে। এছাড়াও ডেন্টাল এক্স-রে (OPG) মেশিনটি এখন পর্যন্ত বুঝেই পাইনি বিভাগের ইনচার্জ।

আরও পড়ুন-

ইনচার্জ এসএম রুহুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এই বিভাগের অধিকাংশ মেশিন নষ্ট। এমআরআইতো কখনো আলোর মুখ দেখেনি এটা আপনারা সবাই জানেন। তাছাড়া সিটি স্ক্যান মেশিনে ছয় মাস ধরে কাজ করতে পারছি না। তিনটি এক্সরে মেশিনের মধ্যে দুইটা নষ্ট। এভাবে বসে থাকা যায়? মানুষ এসে অনেক কথা শুনিয়ে চলে যায়।

‘এ জেলায় যখন মেডিকেল কলেজ তৈরি করা হয় তখন মানুষের আশা ছিল নিজ জেলা থেকেই ভালো মানের চিকিৎসা সেবা পাবে। কিন্তু মানুষের সে আশা পূরণ হয়নি। হাসপাতালটির যে মানের সেবা প্রদান করার কথা তারা সেই সেবা দিতে পারছে না।’

আইসিইউ বিভাগ

প্রথমে ১০ বেডের একটি আইসিইউ ছিল। তারপর আবার নতুন করে ২০ বেডের আরেকটি আইসিইউ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেই আইসিইউ কখনো কোনো রোগীকে সেবা দিতে পারেনি। হাসপাতালের সূচনালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত তালাবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে এই বিভাগের দামি দামি সব যন্ত্রপাতি।

পাঁচ বছরেই মুমূর্ষু হাসপাতাল, ‘কিছুই জানেন না’ পরিচালক

সরেজমিনে এই বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতীয় তলায় ২০ বেডের আইসিইউ রুমটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। যন্ত্রপাতিগুলো রুমের একপাশে স্তূপ করে রেখে দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় তলায় ১০ বেডেরও একই অবস্থা।

প্যাথলজি বিভাগ

গত ৫ বছর নামেমাত্র সেবা প্রদান করা হয়েছে এই বিভাগ থেকে। গত জুন মাসের ১৭ তারিখ থেকে নতুন করে এখানে সেবা চালু করা হয়েছে। এখনো কয়েকটি মেশিনের টেকনিক্যাল সমস্যা রয়েছে।

প্যাথলজি বিভাগের ইনচার্জ ইব্রাহিম হোসেন বলেন, আমাদের এই বিভাগের কার্যক্রম আমরা ভালো করে শুরু করেছি গত ১৭ জুন থেকে। এখনো ভালো করে গুছিয়ে উঠতে পারিনি। এর আগেও কার্যক্রম চালু ছিল তখন কলেজ শাখা থেকে দেখাশোনা করা হতো।

পশ্চিম দাসরা এলাকার মো. আরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমার বোন জামাইকে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি বিভিন্ন টেস্ট এবং সিটি স্ক্যান করতে দেন। হাসপাতালে আমরা সিটি স্ক্যান করতে গেলে তারা বলে এখানে হবে না। বাইরে থেকে সিটি স্ক্যান করে নিয়ে আসেন। আসলে প্রাইভেট ডায়গোনেস্টিক সেন্টারগুলো থেকে সিটি স্ক্যান করতে গেলে সেটা ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া অন্যান্য পরীক্ষা-নীরিক্ষার সেবাগুলো মেডিকেল কলেজে ঠিকমতো পাচ্ছি না আমরা।

‘আসলে এটা নিয়ে সমস্যা আছে। এই যন্ত্রপাতিগুলো যে নষ্ট, এই বিষয়টি নিয়ে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো তারা সব সময় সতর্ক থাকে যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের না হয়ে আসে। এ কারণে মন্ত্রণালয় থেকেও আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।’

কুশের চর এলাকার সিঙ্গাপুর প্রবাসী শরীফ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের জেলায় এত বড় হাসপাতাল থেকে কী লাভ, যদি আমরা চিকিৎসা না পাই। এই হাসপাতালে অনেক বড় ডাক্তার আছে শুনে চিকিৎসা নিতে এসেছিলাম। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে এসেও আমাদের টাকা খরচ করতে হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, ঢাকার কাছের জেলা মানিকগঞ্জ। এ জেলায় যখন মেডিকেল কলেজ তৈরি করা হয় তখন মানুষের আশা ছিল নিজ জেলা থেকেই ভালো মানের চিকিৎসা সেবা পাবে। কিন্তু মানুষের সে আশা পূরণ হয়নি। হাসপাতালটির যে মানের সেবা প্রদান করার কথা তারা সেই সেবা দিতে পারছে না। আমরা চাই হাসপাতালটি সকল সমস্যা কাটিয়ে ভালো মানের চিকিৎসা সেবা যেন দেয়।

পাঁচ বছরেই মুমূর্ষু হাসপাতাল, ‘কিছুই জানেন না’ পরিচালক

এদিকে গত ২০২৪ সালের মার্চ মাসের ২৩ তারিখে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ডা. মো. শফিকুল ইসলাম। এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো এই হাসপাতালের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি তার।

নানান সমস্যার দিক তুলে ধরে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিকুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি বিষয়গুলো জানি না। আমি ভালো করে খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাতে পারবো।

ডেন্টাল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাফেজা সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের ডেন্টাল চেয়ার নষ্ট হয়, আবার ঠিক করা হয়। পরিচালক স্যারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। দুইটি ডেন্টাল চেয়ার এখনো ঠিক হয়নি।

মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক এ কিউ এম আশরাফুল হক জাগো নিউজকে বলেন, এখন পর্যন্ত যন্ত্রপাতির বিষয়ে কোনো মিটিং আমাদের হয়নি। এমনি মাসিক সমন্বয় মিটিং হয় কিন্তু যন্ত্রপাতির বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। এর আগে ডিজি অফিস থেকে একটা চিঠি আসছিল এখন পর্যন্ত কোন কোন যন্ত্রপাতি বাক্সে বন্দি সেটা জানানোর জন্য। সেই চিঠির জবাব দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. জহিরুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, মাসিক মিটিংয়ে এই যন্ত্রপাতির বিষয়ে পরিচালক স্যার কিছু বলেন না। অন্যান্য বিভাগের যারা আছেন তারা নিয়মিত এই বিষয়ে বলেন। তারা উপস্থাপন করার পর পরিচালক চিঠি লিখেছেন সচিব বরাবর।

তিনি আরও বলেন, আসলে এটা নিয়ে সমস্যা আছে। এই যন্ত্রপাতিগুলো যে নষ্ট, এই বিষয়টি নিয়ে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো তারা সব সময় সতর্ক থাকে যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের না হয়ে আসে। এ কারণে মন্ত্রণালয় থেকেও আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

এফএ/এমএস