ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র
‘রোগী দেখি, ওষুধ দেই, হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও করি’
গ্রামীণ পর্যায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র আশ্রয়স্থল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সেখানে ছোটে মানুষ। ইউনিয়নবাসীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য এটি ‘ইউনিয়ন হাসপাতাল’ নামেও পরিচিত। সব জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে এমন স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
তবে চিকিৎসক, জনবল ও ওষুধ সঙ্কটে ব্যাহত হচ্ছে রাজবাড়ী জেলার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কার্যক্রম। এতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ইউনিয়নবাসী।
জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সময় সরকার নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নিলেও এখন পর্যন্ত রজবাড়ীর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। এসব হাসপাতালে সিভিল সার্জনের অধীনে স্বাস্থ্য বিভাগের একজন মেডিকেল অফিসার, একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো), ফার্মাসিস্ট, মিডওয়াইফ, এমএলএসএস থাকার কথা। তবে রাজবাড়ীর বেশিরভাগ ইউনিয়ন হাসপাতালে রয়েছে জনবল সংকট। জেলার কোনো ইউনিয়ন হাসপাতালে নেই মেডিকেল অফিসারের পদায়ন।
পদায়ন হলেও নানা অজুহাতে তারা চলে যান জেলা সদর বা উপজেলা হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। আবার অনেককে সংযুক্তি করে এসব হাসপাতালে আনে কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় মেডিকেল অফিসারদের অনুপস্থিতিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা দিতে হচ্ছে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারকে।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে জ্বর, সর্দি, পেট ও মাথাব্যথার মতো সাধারণ রোগের চিকিৎসা এবং ওষুুধ দেওয়া হয়। তবে রোগীদের অভিযোগ, অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়। আবার অনেক সময় চিকিৎসক পাওয়া যায় না। দেওয়া হয় না জটিল বা কঠিন রোগের চিকিৎসা। সামান্য ক্ষত বা হাত-পা ভাঙাসহ জটিল রোগের কোনো রোগী এলে পাঠানো হয় জেলা সদর বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
আরও পড়ুন:
- ৯০ শতাংশ ‘হেপাটাইটিস বি’ রোগী জানেন না তিনি আক্রান্ত
- রামেক হাসপাতালের আইসিইউ যেন আরেক সন্তান ডা. আবু হেনার
- রোগীতে ঠাসা, শয্যার অভাবে বারান্দায় চিকিৎসা
- কমিউনিটি ক্লিনিককে আরও আধুনিকায়ন করছে সরকার
খোঁজ নিয়ে জানা গছে, রাজবাড়ী জেলায় ৪২টি ইউনিয়ন রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সিভিল সার্জন এবং জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালকের অধীনে রয়েছে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (ইউনিয়ন হাসপাতাল)। এসব ইউনিয়নে পৃথকভাবে রোগীদের সেবা দেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে থাকা দায়িত্বরতরা। তবে জনবল সংকটে অনেক হাসপাতালই চলছে শুধু উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার দিয়ে। চিকিৎসা দেওয়া, ওষুধ বিতরণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নসহ সব কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
‘ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে জ্বর, সর্দি, পেট ও মাথাব্যথার মতো সাধারণ রোগের চিকিৎসা এবং ওষুুধ দেওয়া হয়। তবে রোগীদের অভিযোগ, অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়। আবার অনেক সময় চিকিৎসক পাওয়া যায় না। দেওয়া হয় না জটিল বা কঠিন রোগের চিকিৎসা। সামান্য ক্ষত বা হাত-পা ভাঙাসহ জটিল রোগের কোনো রোগী এলে পাঠানো হয় জেলা সদর বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।’
ইউনিয়ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা প্রীতি দত্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। বড় হাসপাতালে যেতে না পেরে বাড়ির কাছের হাসপাতাল আসি। কিন্তু এখানে ভালো চিকিৎসা পাই না। বড় ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও সে ডাক্তারকে পাই না।’

রোগী কামরুন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঠান্ডা, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথাসহ সাধারণ রোগের চিকিৎসা ছাড়া জটিল রোগের চিকিৎসা বা ওষুধ পাই না। অথচ শহরে গিয়ে টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা চাই এখানে বড় ডাক্তার থাকুক। সব ধরনের চিকিৎসা ও ওষুধ যেন এখান থেকে পাই।’
কথা হয় খানগঞ্জ ও জামালপুরের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রাসেল ও চন্দ্রা সাহার সঙ্গে। তারা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেডিকেল অফিসারের পদ থাকলেও পদায়ন নেই। অন্যান্য স্টাফও নেই। উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার হিসেবে সব কাজ আমাদের একাই করতে হয়।’
তারা আরও বলেন, ‘হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ৬০-৭০ জন রোগী দেখি, ওষুধ দেই আবার হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও করি। সব কাজ একা করতে গিয়ে সেবা কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে।’
আরও পড়ুন:
- চিকিৎসা বঞ্চিত চরের মানুষের দুঃখগাথা
- দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন
- যে কোনো মূল্যে আয়-ব্যয়ের দায়িত্ব ছাড়তে নারাজ পরিচালক
উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার চন্দ্রা সাহা জানান, এটা শুধু এই হাসপাতালের চিত্র না, রাজবাড়ীর প্রতিটি ইউনিয়ন হাসপাতালে একই চিত্র। কোথাও মেডিকেল অফিসার পদায়ন নেই।

মুকুন্দিয়া উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো. বাচ্চু মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে মেডিকেল অফিসারের পোস্ট থাকলেও দীর্ঘদিন তিনি থাকেন না। এলেও থাকতে চান না। যে কারণে সব রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হয়।’
‘হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ৬০-৭০ জন রোগী দেখি, ওষুধ দেই আবার হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও করি। সব কাজ একা করতে গিয়ে সেবা কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি দশম গ্রেড। কিন্তু সরকার অন্যান্য ডিপ্লোমাদের দশম গ্রেড দিলেও আমাদের দিচ্ছে না। অথচ আমরাই সারাদেশের প্রান্তিক জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছি।’

জনবল সংকটের বিষয়ে রাজবাড়ী সিভিল সার্জন ডা. এস এম মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৪ জন করে কনসালটেন্ট ও ১৯ জন করে মেডিকেল অফিসার পদায়ন করা হবে। এসব বিষয় নিয়ে কাজ চলছে। আশা করছি, খুব শিগগির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। উপজেলায় চিকিৎসক সংকট কেটে গেলে ইউনিয়নেও সমস্যা কমে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউনিয়ন হাসপাতালে সরকারিভাবে যে ওষুধ সাপ্লাই রয়েছে, সেগুলো অভিজ্ঞ উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ও ফার্মাসিস্টের মাধ্যমে বণ্টন করা হচ্ছে। তবে জটিল ও কঠিন রোগীদের আমরা উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে রেফার করার জন্য বলি।’
এসআর/এমএস