সুন্দরবনে নষ্ট হচ্ছে জব্দ হাজারো নৌকা-ট্রলার
অযত্ন নষ্ট হচ্ছে সুন্দরবনের নৌকা-ট্রলার/ ছবি: জাগো নিউজ
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সুন্দরবনের বিভিন্ন স্টেশনে পড়ে আছে হাজারো নৌকা ও ট্রলার। কখনো অবৈধভাবে বনাঞ্চলে প্রবেশ, কখনো নিষিদ্ধ জাল বা মাছ ধরার অভিযোগে এসব নৌযান জব্দ করেছে বন বিভাগ। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও আদালতের রায় বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত না হওয়ায় অচল হয়ে পড়ে আছে যানগুলো। এছাড়া অযত্ন ও আবহাওয়ার কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ।
বন বিভাগের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, শতশত কাঠের নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলার খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। কোথাও নৌকার কাঠ পচে যাচ্ছে, কোথাও ট্রলারের ইঞ্জিনে মরিচা পড়ে অকেজো হয়ে গেছে। একই চিত্র দেখা যায় কদমতলা, কৈখালী ও মুন্সিগঞ্জ বন স্টেশনেও।

বন বিভাগের তথ্যমতে, সাতক্ষীরা রেঞ্জে গত এক দশকে তিন হাজারেরও বেশি ছোট-বড় নৌযান জব্দ করা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই এখনও বিভিন্ন স্টেশনে খোলা মাঠে পড়ে আছে।
‘বন বিভাগ যখন নৌকা ধরে তখন আমরা কিছু বলতে পারি না। কিন্তু মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বছর পর বছর নৌকা পড়ে থাকে। তখন সেটি আর ব্যবহার করা যায় না। ৬ থেকে ৭ বছর পরে দিলে বা নিলামে তুললেও কোনো দাম থাকে না।’
বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনের বনকর্মীরা বলেন, প্রায় সময় অভিযানে কোনো না কোনো জেলে বা বাওয়ালির নৌকা আটক হয়। সেগুলো মামলা চলা পর্যন্ত এখানে রাখা হয়। কিন্তু রায় না হওয়ায় বছরের পর বছর এভাবেই পড়ে থাকে। এখন অনেক নৌকা পচে গেছে, ইঞ্জিনগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।

জেলে-বাওয়ালিরা সাধারণত ভাড়ায় নৌকা নিয়ে বনাঞ্চলে যান। এদের মধ্যে অনেকে বন বিভাগের নিয়ম অমান্য করায় তাদের নৌকা জব্দ হয়। ফলে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েন মালিকেরা।
নৌযানের মালিক শরিফুল ইসলাম বলেন, বন বিভাগ যখন নৌকা ধরে তখন আমরা কিছু বলতে পারি না। কিন্তু মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বছর পর বছর নৌকা পড়ে থাকে। তখন সেটি আর ব্যবহার করা যায় না। ৬ থেকে ৭ বছর পরে দিলে বা নিলামে তুললেও কোনো দাম থাকে না।
‘সুন্দরবনের ভেতরে যারা অবৈধ প্রবেশ বা অপরাধ করে, আমরা তাদের নৌকাসহ আটক করি। পরে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত থেকে নির্দেশ না এলে আমরা কিছু করতে পারি না। নৌকা বিক্রি, নিলাম বা মালিকের জিম্মায় দেওয়া সবই আদালতের বিষয়।’
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের নৌযান মালিক আসাদুল গাজী বলেন, একটি মাঝারি নৌকার দাম এক লাখ টাকার মতো। বড় ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের দাম ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। এত দামের যান পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গরিব মানুষ কষ্ট করে নৌকা বানায়, পরে মামলা হলে সব শেষ।
আরও পড়ুন:
কাগজে-কলমে উৎপাদন বাড়লেও হাওরে মিলছে না মাছ
পর্যটনে অপার সম্ভাবনায়ও উপেক্ষিত সাতক্ষীরা
মামলায় জব্দ শত শত গাড়ি এখন ভাঙাড়ি
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জব্দ নৌযান ছেড়ে দেওয়া বা বাজেয়াপ্ত করার এখতিয়ার তাদের নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের ওপর নির্ভরশীল।
সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, সুন্দরবনের ভেতরে যারা অবৈধ প্রবেশ বা অপরাধ করে, আমরা তাদের নৌকাসহ আটক করি। পরে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত থেকে নির্দেশ না এলে আমরা কিছু করতে পারি না। নৌকা বিক্রি, নিলাম বা মালিকের জিম্মায় দেওয়া সবই আদালতের বিষয়।
তিনি আরও বলেন, এত সংখ্যক নৌযান রক্ষণাবেক্ষণের মতো পর্যাপ্ত জায়গা, জনবল ও বাজেট আমাদের নেই। ফলে অনেক নৌকা খোলা মাঠে থেকে নষ্ট হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে নৌযান জব্দকরণ, সংরক্ষণ ও নিষ্পত্তি নিয়ে কোনো একক নীতিমালা না থাকায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে। কখনো বছরখানেক পর আদালত রায় দিলেও বাস্তবায়ন করতে বিলম্ব হয়। অনেক সময় মালিক মারা যান বা ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলেন। ফলে জব্দকৃত সম্পদের নিষ্পত্তি ঝুলে যায়।
পরিবেশবাদী সংগঠন সুন্দরবন সুরক্ষা রক্ষা কমিটির স্থানীয় প্রতিনিধি গাজী ইমরান বলেন, নৌকা-ট্রলারগুলোও আমাদের সম্পদ। এগুলো পড়ে থাকতে থাকতে শুধু নষ্টই হচ্ছে না, বর্ষায় অনেক সময় ভেসে গিয়ে নদীতে তেল ছড়িয়ে দূষণও ঘটাচ্ছে। প্রশাসনিক উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত নিলাম বা ফেরতের ব্যবস্থা করা উচিত।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বন সংরক্ষণের নামে সম্পদ নষ্ট হওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। জব্দকৃত নৌযান যদি মামলা চলাকালীন রক্ষণাবেক্ষণ করা না যায় তবে সরকার বা আদালতের একটি আলাদা তহবিল গঠন করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে গরিব জেলে ও বাওয়ালিদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত না হলে বন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
সাতক্ষীরা জর্জ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. বদিউজ্জামান বলেন, আদালত চাইলে দ্রুত শুনানির মাধ্যমে জব্দ নৌযানগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে। যেমন- নিলাম, ক্ষতিপূরণ বা মালিকের জিম্মায় ফেরত দেওয়া। কিন্তু এসব বিষয়ে বন বিভাগ, প্রশাসন ও আদালতের সমন্বিত উদ্যোগ এখনো অনুপস্থিত।
সুন্দরবন শুধু জীববৈচিত্র্যের নয়, উপকূলের অর্থনীতিরও প্রাণকেন্দ্র। অথচ এখানেই অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার নৌযান যা হতে পারত স্থানীয় জীবিকার শক্ত ভিত্তি। দ্রুত প্রশাসনিক উদ্যোগ ও আইনি সংস্কার না হলে সুন্দরবনের বুকে পড়ে থাকা এই নৌযানগুলো আরও এক নিঃশব্দ ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে থাকবে।
এনএইচআর/জেআইএম