কাগজে-কলমে উৎপাদন বাড়লেও হাওরে মিলছে না মাছ

লিপসন আহমেদ লিপসন আহমেদ , সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০:০৪ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
হাওরে পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন জেলেরা। ছবি-জাগো নিউজ

হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে আবহাওয়া আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতিতে আমূল পরিবর্তন। সময়মতো হাওরে পানি না আসা, বিল-জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা এবং ক্ষতিকর জালে মাছ শিকারের কারণে হাওরে দেশীয় প্রজাতির মাছের আকাল চলছে। বিশেষ করে যে জেলাকে একসময় ‌‘মাছের ভান্ডার’ বলা হতো, সেই জেলা এখন মাছশূন্য। জাল ফেললে মিলছে না মাছ। অথচ জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যে দেখানো হচ্ছে, প্রতি বছরই মাছের উৎপাদন বাড়ছে।

জেলার শেয়ালমারা হাওরপাড়ের বাসিন্দা নজির উদ্দিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন হাওর ও নদীতে জাল ফেলে মাছ শিকার করেন তিনি। পরে সেই মাছ স্থানীয় হাট-বাজারে সর্বোচ্চ ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি করে কোনোরকমে সংসারের খরচ জোগান। তবে তার ৫২ বছর বয়সে মধ্যে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হাওর-নদীর রূপের বদল দেখেছেন। যে হাওর ও নদীতে আগে জাল ফেললে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের দেখা মিলতো, এখন সেখানে কেবল শূন্যতা।

নজির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘একসময় জলাশয়ে জাল ফেললেই চিতল, ট্যাংরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়তো। এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জাল ঠিকই ফেলি কিন্তু মাছের দেখা নেই। ফলে সংসার চলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

কাগজে-কলমে উৎপাদন বাড়লেও হাওরে মিলছে না মাছ

৩৭৪৭.১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জেলা সুনামগঞ্জের জীবন-অর্থনীতি ধান, মাছ ও সবজি—এই তিনটিকে ঘিরে। বিশেষ করে এই অঞ্চলে ছয় মাস যখন বষা মৌসুম থাকে, তখন হাওর এলাকার মানুষের প্রধান আয়ের উৎস থাকে মাছ উৎপাদনকে ঘিরে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেলায় দেশি ও চাষের মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় জেলা শহরের হাট-বাজার থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রামীণ বাজারে দেখা দিয়েছে মাছের সংকট।

সুনামগঞ্জের পৌর ওয়েজখালী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। এখানে আগে প্রতিদিন জেলার বিল ও জলাশয় থেকে বিভিন্ন প্রজাতির আসতো। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলতো বেচাকেনা। গড়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মাছ বেচাকেনা হলেও এখন বলতে গেলে জায়গাটিতে নীরবতা।

মাছের আড়তদার অলিক মিয়া ও নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি বছর জেলায় মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে ক্রেতারা এসে চাহিদা অনুযায়ী মাছ পাচ্ছেন না। মাছ না থাকায় আমরা যারা ব্যবসায়ীরা আছি, তারাও বিপাকে পড়েছি।’

আরও পড়ুন:
৪ বছরের ব্যবধানে ইলিশ উৎপাদন কমেছে ৯ শতাংশ
ময়মনসিংহে বিক্রি বেড়েছে নিষিদ্ধ সাকার ফিশের
পদ্মার এক পাঙাশ বিক্রি হলো সাড়ে ৬৩ হাজারে
মা ইলিশ রক্ষায় শুরু হচ্ছে ২২ দিনের বিশেষ অভিযান, মাঠে নৌ পুলিশ
হাওরে নির্মিত অলওয়েদার সড়কে পর্যাপ্ত কালভার্ট রাখা হয়নি
হাওরের দেশি হাঁসের স্বাদ বেশি কেন?

তথ্য বলছে, জেলার ১৩৭টি হাওর, ২৬টি নদী এবং ২০ হাজার ৭৬৯টি পুকুর রয়েছে। এরমধ্যে ২০ হাজার ২৪৯টি পুকুরে নিয়মিত মাছ চাষ হয়। জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা এক লাখ ২১ হাজার ৭৪৩ জন। চলতি অর্থবছরে এই জেলা থেকে ১৪০০ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও গত বছরের তুলনায় এটি কিছুটা কম।

কাগজে-কলমে উৎপাদন বাড়লেও হাওরে মিলছে না মাছ

জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সুনামগঞ্জ থেকে এক লাখ ৯ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক লাখ ১২ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক লাখ ১৪ হাজার ১৩০ মেট্রিক টন মাছের উৎপাদন হয়েছে। যেখানে মোট ১২৬ প্রজাতির দেশি মাছ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়। মূলত কাগজে-কলমে ভাটির এই জেলায় মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে দেখালেও বাস্তব চিত্র পুরো ভিন্ন।

আজিজ মিয়া নামের একজন জেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মৎস্য অফিস বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলে বছরে বছরে জেলায় মাছের উৎপাদন বাড়ছে। অথচ জাল ফেললে তো আমরা মাছ পাই না।’

জেলে কুদ্দুস মিয়া বলেন, ‘সারাদিন ৫০০ টাকার মাছও এখন নদী কিংবা হাওরে শিকার করতে পারি না। অথচ আগে ৩-৪ হাজার টাকার মাছ শিকার করতে পারতাম।’

আরেক জেলে আলাল মিয়া বলেন, ‘মাছ উৎপাদনের দিকে জেলার মৎস্য অধিদপ্তরের কোনো নজর নেই। নামমাত্র প্রশাসন কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করলেও তা অপ্রতুল। মাছের ভান্ডার খ্যাত এই জেলা এখন মাছশূন্য।’

কাগজে-কলমে উৎপাদন বাড়লেও হাওরে মিলছে না মাছ

তবে মাছের উৎপাদন বাড়াতে হাওর ও নদীতে মৎস্য আইন বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ডা. আল মিনাননুর। একইসঙ্গে বিল-নার্সারি স্থাপন ও দেশীয় মাছের পোনা উন্মুক্ত করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জে এসে এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হবে। নিষিদ্ধ জালের বিষয়েও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে।

এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।