রাজশাহী
হাজার ছাড়িয়েছে সাপে কাটা রোগী, আতঙ্কের নাম ‘রাসেলস ভাইপার’
ফাইল ছবি
- চলতি বছর রামেকে চিকিৎসা নিয়েছেন হাজারের বেশি রোগী
- মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জনের
- রাসেলস ভাইপারের আক্রমণ বেড়েছে চারগুণ
রাজশাহী অঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা। চলতি বছর হাজারেরও বেশি সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। মারা গেছেন ৩৮ জন। শুধু তাই নয়, রাসেলস ভাইপারের আক্রমণ বেড়েছে চারগুণ। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালুর উদ্যোগ নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সাপে কাটা রোগী বেশি হাসপাতালে ভর্তি হন। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ১৬৭ জন রোগী। এর মধ্যে বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত ছিলেন ২৪৭ জন। অবিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯২০ জন। আর মারা গেছেন ৩৮ জন রোগী।
গতবছর হাসপাতালটিতে ভর্তি হন এক হাজার ৩৭০ জন সাপে কাটা রোগী। এরমধ্যে বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত ছিলেন ৩১৪ জন। অবিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন এক হাজার ৩৭০ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। বিশেষ করে রাসেলস ভাইপার, কেউটে ও গোখরা সাপের কামড়েই বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শুধু রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা গেছেন ১০ জন।
তথ্য বলছে, গত আট বছরে রাসেলস ভাইপারের আক্রান্তের হার বেড়েছে চারগুণ। ২০১৮ সালে রামেকে রাসেলস ভাইপারের আক্রমণের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২১ জন। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ জন। ২০২০ সালে রামেকে রাসেলস ভাইপারের কামড় খেয়ে ভর্তি হন ৩৫ জন। ২০২১ সালে ভর্তির সংখ্যা ৩৭ জন। আর ২০২২ সালে ৩১ জন ভর্তি হন। ২০২৩ সালে ভর্তি হন ৫০ জন। ২০২৪ সালে রাসেলস ভাইপারের আক্রমণের শিকার হয়ে ৮৬ জন ভর্তি হন। আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হন ৫৩ জন। এই সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে গড়ে ২৩ শতাংশ।
সাপের আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চলতি মাসেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের জন্য ১২ শয্যার একটি বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালু হতে যাচ্ছে। সেখানে থাকবে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নার্স এবং পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম সরবরাহ। হাসপাতালের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সম্প্রসারিত অংশে সাপে কাটা রোগীদের জন্য ওয়ার্ড চালু করা হচ্ছে। এই ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকবেন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
আরও পড়ুন:
সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ‘অ্যান্টিভেনম’ রাখার নির্দেশ
মরার পরও যেসব সাপ কামড়াতে পারে
নামাজ পড়ছিলেন গৃহবধূ, প্রাণ গেলো সাপের কামড়ে
রাতে সাপ হয়ে কামড়াতে যান স্ত্রী, প্রশাসনের কাছে স্বামীর অভিযোগ
চাঁদপুরে অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পরও সাপে কাটা রোগীর মৃত্যু
আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জানান, এরইমধ্যে এই ওয়ার্ডের জন্য আট নার্স বাছাই করা হয়েছে। ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও নার্সদের স্নেক বাইটের ন্যাশনাল গাইড অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পাশপাশি কীভাবে রোগীদের ম্যানেজ করা যায়, সেটি তারা শিখবেন। এতে করে সাপে কাটা রোগীরা আলাদা যত্ন পাবের। দ্রুত তারা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালু হলে সমন্বিত চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ হবে। এতে মৃত্যুহার অনেকটা কমে আসবে। আমরা এখন সাপের ধরন শনাক্ত করতে পারছি। কারণ মানুষ সাপ মেরে অথবা ছবি দেখে চিনতে পারছেন। ফলে দ্রুত চিকিৎসা করানো যাচ্ছে।’
সাপের আক্রমণ থেকে বাঁচতে রাতে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, মাঠে কাজের সময় গামবুট ব্যবহার, বাইরে চলাফেরায় টর্চলাইট ও লাঠি রাখা এবং আবর্জনা পরিষ্কার করার সময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
চারঘাট উপজেলার কৃষক আমিরুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ধানক্ষেতে কাজ করার সময় হঠাৎ রাসেলস ভাইপার সাপে কামড় দেয়। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে শরীর ফুলতে শুরু করলে আমাকে হাসপাতালে আনা হয়। এখানে দ্রুত চিকিৎসা পেয়েছি, তাই বেঁচে গেছি।’
বাঘা উপজেলার গৃহবধূ রহিমা খাতুন বলেন, ‘রাতে ঘুমানোর সময় বিছানায় উঠে কেউটে সাপে কামড় দেয়। ভয় পেয়ে পরিবারের লোকজন দ্রুত হাসপাতালে আনে। এখন অনেকটা সুস্থ আছি। তবে এর আগেও আমাদের গ্রামে দুজন এই সাপের কামড়ে মারা গেছেন।’
সাপের আক্রমণের শিকার কলেজছাত্র রাজিব হোসেন বলেন, ‘বন্ধুদের সঙ্গে নদীর ধারে বসেছিলাম। হঠাৎ পায়ে সাপ কামড় দেয়। হাসপাতালে আনার পর স্যালাইন আর ওষুধ দেয়। পরে সুস্থ হই। তবে আমাদের এলাকায় প্রায়ই রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব দেখা যায়। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের দেখা উচিত।’
সারাদেশে যে পরিমাণ সাপের আক্রমণের শিকার হন, তার অর্ধেক রোগী রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নেন বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা কোম্পানির কাছে অর্ডার দিয়েও ওষুধ পাচ্ছি না। ফলে অ্যান্টিভেনম সংকট আমাদের থেকে যাচ্ছে। এখন এর ওর কাছে ধার চেয়ে অ্যান্টিভেনম সংগ্রহ করতে হচ্ছে।’
পরিচালক বলেন, ‘রোগী যেহেতু বেশি হচ্ছে তাই আমরা এখানে একটি বিষেশায়িত ওয়ার্ড চালু করবো। চলতি মাসেই এটি চালু করা হবে। এখানে সুস্থতার হার খুব বেশি। আমরা চাই, সবাই সুস্থ হয়ে ফিরুক।’
‘তবে কিছু রোগী ওঝার কাছে যাওয়া ও হাসপাতালে আসতে দেরি হওয়ার কারণেই মৃত্যু হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে ভালো কিছু করা যায়’, যোগ করেন এফএম শামীম আহমেদ।
এসআর/এএসএম