কুষ্টিয়া
মনোনয়ন পেয়েও স্বস্তি নেই, ‘টেনশনে’ বিএনপির তিন প্রার্থী
প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মনোনয়নবঞ্চিতদের কর্মী-সমর্থকদের বিক্ষোভ
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে ২৩৭টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় কুষ্টিয়ার চারটি আসনও রয়েছে। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার দিন থেকেই প্রার্থী বদলের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
শুরুতে কুষ্টিয়ার চারটি আসনেই প্রার্থী বদলের দাবি জানান তারা। বর্তমানে একটি আসন বাদ দিয়ে তিনটিতে প্রার্থী বদলের দাবিতে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ-প্রতিবাদ মিছিলসহ রাজপথে নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় কুষ্টিয়ার তিনটি সংসদীয় আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীরা চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন।

অন্যদিকে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ জামায়াত অনেক আগেই তাদের একক দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে ভোটের মাঠে জোর প্রচারণায় নেমে অনেকটাই নির্ভার অবস্থায় রয়েছে।
কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত সংসদ সদস্য আহসানুল হক পচা মোল্লার ছেলে সাবেক বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লা, কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী, কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সদস্য সচিব প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকার এবং কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমীকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি।
প্রার্থী ঘোষণার দিন থেকেই মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের কর্মী-সমর্থকরা প্রার্থী বদলের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসন ছাড়া বাকি তিনটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি এনে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন স্ব-স্ব আসনের নেতাকর্মীরা।
প্রার্থী বদলের দাবি জানিয়ে এই তিনটি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের কর্মী-সমর্থকরা সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশ, মানববন্ধন, মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, মশাল জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, সংবাদ সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।
কুষ্টিয়া-১ আসনে রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লার মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের আহ্বায়ক শরিফ উদ্দিন জুয়েলের কর্মী-সমর্থকরা। প্রতিদিনই তার সমর্থকরা মিছিল, গণসংযোগ, বিক্ষোভ সমাবেশ, মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। সমর্থকদের দাবি, দীর্ঘ ১৬ বছর দলের চরম দুঃসময়ে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকার কারণে জুয়েলের নামে ৩১৭টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। তাদের দাবি, সীমান্ত অধ্যুষিত দৌলতপুর উপজেলাকে সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতি মুক্ত উপজেলা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জুয়েলের বিকল্প নেই।
কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরীকে। তার বাবা প্রয়াত আব্দুর রউফ চৌধুরীও এ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। রাগীব রউফ চৌধুরীকে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তার মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে রাজপথে নানা আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী এ আসনের তিনবারের নির্বাচিত বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক শহীদুল ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা। শহীদুলের কর্মী সমর্থকদের দাবি, ব্যারিস্টার রাগীব ঢাকায় থাকেন। বিগত ১৬ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে তাকে তেমন একটা দেখা যায়নি। এরকম ‘বসন্তের কোকিলকে’ মনোনয়ন দেওয়ায় নিশ্চিত এই আসনটি হারাতে হবে। ফসল চলে যাবে জামায়াতের ঘরে।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকেই অশান্ত হয়ে উঠেছে কুমারখালী উপজেলা। মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে প্রায় প্রতিদিন বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ, সংবাদ সম্মেলন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র নুরুল ইসলাম আনসার প্রামানিকের কর্মী-সমর্থকরা। আনসার প্রামানিক ছাড়াও এ আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন চাচ্ছেন কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী শেখ সাদী এবং কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সদস্য হাফেজ মঈনউদ্দীন।
আনসার প্রামানিকের কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, নেতা-কর্মীদের চরম দুঃসময়ে দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর মেহেদী রুমী বেশিরভাগ সময় এলাকা ছেড়ে ঢাকায় থেকেছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই তার ওঠা-বসা নেই। এ অবস্থায় মেহেদী রুমীকে মনোনয়ন দেওয়ায় এ আসনটি নিশ্চিতভাবে হাতছাড়া হয়ে যাবে।
অন্যদিকে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকারকে মনোনয়ন ঘোষণা করা হলে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিনের কর্মী-সমর্থকরা রাজপথ অবরোধসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।
দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে বিএনপির হাইকমান্ড কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেও মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের কর্মী-সমর্থকদের কোনোভাবেই নিবৃত করতে পারছে না।
দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র নুরুল ইসলাম আনসার প্রামানিকের ছেলে কুমারখালী উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক জাকারিয়া আনসার মিলনকে গত ৮ নভেম্বর যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। তিন দিনের মধ্যে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তাকে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। কিন্তু এরপরও থেমে নেই নেতাকর্মীরা।
তবে মনোনয়ন ঘোষণার পরও দলের স্বার্থে এক জোট হয়ে কাজ না করে রাজপথে আন্দোলন করাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না মনোনয়ন প্রাপ্ত সংসদ সদস্য প্রার্থীরা।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী বলেন, “যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে তারা জ্বলে-পুড়ে মরবে। কে কী বিক্ষোভ করলো ‘আই ডোন্ট কেয়ার’।” তবে নির্বাচনের সময় সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন দলটির বর্ষীয়ান এই নেতা।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কুতুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যারা দাবি করছেন তারাও দলের ত্যাগী নেতা। আমি এটাকে খুব একটা নেগেটিভ হিসেবে দেখছি না। বিএনপি একটি অনেক বড় দল। এখানে একাধিক যোগ্য নেতা রয়েছেন। তাই ক্ষোভ-অভিমান থাকতেই পারে। এগুলো নিরসনে দলের পক্ষ থেকে আমরা কাজ করছি। সবার সঙ্গে কথা বলছি। আশা করছি রাগ-ক্ষোভ যাই থাকুক না কেন, দিন শেষে নেতাকর্মীরা সবাই একজোট হয়ে ধানের শীষের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন।’
আল-মামুন সাগর/এসআর/জিকেএস