মর্যাদাপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী
ফাইল ছবি
এক দশকেরও বেশি সময় আগে আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গ স্বীকৃতি পাওয়ার পরও রাজশাহীর হিজড়া জনগোষ্ঠী আজও স্বাস্থ্যসেবায় গভীর বৈষম্য, অপমান এবং পদ্ধতিগত বর্জনের মুখোমুখি। এমনই চিত্র উঠে এসেছে ইন্টারডিসিপ্লিন: জার্নাল অফ কোয়ালিটেটিভ অ্যান্ড কোয়ান্টিটেটিভ রিসার্চে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের ৭৯ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার এবং সম্প্রদায় নেতাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরের হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ফার্মেসিতে তারা নিয়মিত অপমান, বর্জন এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ফলে অনেকেই চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে হাতুড়ে ডাক্তারের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালের কর্মীদের বৈষম্যমূলক আচরণ, ফার্মেসিতে মৌখিক নির্যাতন, ব্যবস্থাপনার অভাব এবং সরকারি সেবা গ্রহণকালে হয়রানির আশঙ্কায় প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসকের বদলে হাতুড়ে ডাক্তার বা নিজে নিজে ওষুধ সেবনের পথ বেছে নেন। ফার্মেসিতে গেলে অনেককে উপহাসের মুখোমুখি হতে হয়, কর্মীদের অসম্মানজনক আচরণ এবং লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে কটূক্তির শিকার হতে হয়।
তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি জানান, ‘তিনি কথা না বলে ইশারায় ওষুধ কিনে নেন। যাতে তাকে চিনে অপমান না করা হয়।’
২০১৩ সালে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও রাজশাহীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনো কঠোরভাবে পুরুষ-মহিলা বিভাগ চলছে। আলাদা টিকিট কাউন্টার, লাইন এবং ওয়ার্ড থাকলেও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কোনো স্বতন্ত্র ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা বাধ্য হন পুরুষ বা নারীদের লাইনে দাঁড়াতে, আর তাতে প্রায়শই ধমক, ধাক্কাধাক্কি বা সরিয়ে দেওয়ার ঘটনার মুখোমুখি হন। টিকিট কাউন্টার, অপেক্ষা কক্ষ, অভ্যর্থনা ডেস্ক এবং জুনিয়র কর্মীদের আচরণে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও অনেকে অভিযোগ করেছেন যে তারা রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না, তাড়াহুড়ো করেন, কিংবা লিঙ্গ পরিচয়ের ওপর অসুস্থতার দায় চাপান।
অবহেলার কিছু ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক হিজড়া রোগী জানান, ‘একজন আত্মীয় এসে না ডাকা পর্যন্ত নার্সরা তার বিছানার পাশে যেতেই অস্বীকৃতি জানান।’
অন্যদিকে বেসরকারি সেবা কিছুটা সম্মানজনক হলেও উচ্চ ব্যয়ের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা এসব চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন না। মাত্র চার শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত চিকিৎসা পান। জরুরি পরিস্থিতিতে বিল পরিশোধ করতে না পেরে ঋণগ্রস্ত হওয়াটাও নতুন নয়।
এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে লাইট হাউজের কাজকে সবচেয়ে কার্যকর ও সম্মানজনক হিসেবে বর্ণনা করেছেন ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা। তবে তাদের সেবা সীমাবদ্ধ এইচআইভি পরীক্ষা, কাউন্সেলিং এবং ছোটখাটো শারীরিক সমস্যায়। দীর্ঘমেয়াদি রোগ, মানসিক স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য বা গুরুতর আঘাতের মতো বিষয়ের চিকিৎসা দেওয়ার মতো সক্ষমতা এনজিওগুলোর নেই।
গবেষণায় বলা হয়েছে, আইনি স্বীকৃতি স্বাস্থ্যসেবায় বাস্তব সুরক্ষা তৈরি করতে পারেনি। হাসপাতালের ফরমগুলোতে এখনো ‘পুরুষ’ বা ‘মহিলা’ উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কর্মীদের লিঙ্গ বৈচিত্র্য সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই। লিঙ্গ সমতা সেবা বা হয়রানি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কোনো সরকারি নির্দেশনাও নেই।
গবেষকরা বলেন, এসব কাঠামোগত সমস্যা বৈষম্যের চক্রকে আরও শক্তিশালী করছে। অপমানের ভয় অনেককে চিকিৎসা থেকে দূরে রাখছে, ফলে গুরুতর রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব হচ্ছে এবং অনিরাপদ চিকিৎসার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য পৃথক হাসপাতাল কাউন্টার, লিঙ্গ-সমেত নিবন্ধন ফরম, বিশেষ প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও নার্স, সরকারি হাসপাতালের ভেতরে নিরাপদ যোগাযোগের স্থান এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা হিজড়াদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত বা বিনামূল্যের চিকিৎসা সুবিধা চালুর দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি কলঙ্ক দূর করতে সচেতনতা কর্মসূচি এবং মেডিকেল ও নার্সিং শিক্ষায় হিজড়া-স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন গবেষকরা।
প্রতিবেদনটি সতর্ক করে দিয়েছে যে এসব জরুরি পদক্ষেপ না নিলে হিজড়া জনগোষ্ঠী রাজশাহীতে প্রতিরোধযোগ্য অসুস্থতা, মানসিক আঘাত এবং পদ্ধতিগত বর্জনের মধ্যে পড়েই যাবে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা তাদের মৌলিক অধিকার হওয়া সত্ত্বেও তারা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এফএ/জেআইএম