ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ইতিহাসের সাক্ষী ১৩০ বছরের পুরোনো ‘জিয়া বাড়ি’

নিজস্ব প্রতিবেদক | বগুড়া | প্রকাশিত: ০৭:৩১ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের বাগবাড়ীতে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে বদলে যাওয়া পরিবেশ। মসৃণ সড়ক, সারি সারি লম্বা পিলার, রাতে আলোকিত করার জন্য বসানো সোলার লাইট। সবমিলিয়ে এটি আর দশটি গ্রামবাংলার চিরচেনা দৃশ্য নয়। পরিকল্পিত অবকাঠামো আর পরিচ্ছন্নতার ছাপ স্পষ্ট।

এই আধুনিকতার মাঝখানেই নীরবে দাঁড়িয়ে আছে হলুদ রঙের দোতলা একটি বাড়ি, যেটি স্থানীয়দের কাছে বহুদিন ধরে পরিচিত ‘জিয়া বাড়ি’ নামে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি আজও প্রায় আগের অবস্থাতেই আছে।

মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটির ভেতরে কেয়ারটেকাররা নিয়মিত পরিচর্যার কাজ করছেন। উঠান ঝাড়ু দেওয়া, ঘরের ভেতর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, দেওয়ালের রঙের যত্ন—সবকিছুই চলছে নিয়ম মেনে। রঙে কিছুটা নতুনত্ব থাকলেও কাঠামোগতভাবে বাড়িটিতে কোনো বড় পরিবর্তন আনা হয়নি। জানালা, দরজা, সিঁড়ির বিন্যাস কিংবা ঘরের অবস্থান—সবই আগের মতো রাখা হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে বরাবরই চেষ্টা করা হয়েছে, এই স্মৃতির জায়গাটি যেন অযথা আধুনিক রূপান্তরের শিকার না হয়।

ইতিহাসের সাক্ষী ১৩০ বছরের পুরোনো ‘জিয়া বাড়ি’

বাড়ির ভেতরে এখনো জিয়াউর রহমানের ব্যবহৃত কিছু আসবাবপত্র সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি খাট, ড্রেসিং টেবিল, একটি সোফা ও সীমিতসংখ্যক দৈনন্দিন আসবাব। এসবের মাধ্যমেই ঘরটির ভেতরে তখনকার জীবনযাপনের ছাপ স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়। তবে জিয়াউর রহমান যে খাটে ঘুমাতেন, সেই খাটের সঙ্গে থাকা বোতাম লাগানো মশারি এবং জমিদার আমলের কিছু কাচের গ্লাস নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের স্বার্থে অনেক আগেই চট্টগ্রাম জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঐতিহাসিক এসব নিদর্শন ক্ষতির ঝুঁকি এড়াতেই জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

বাড়িটিতে একটি বিশেষ কক্ষ রয়েছে, যা একসময় নিরাপত্তার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো। ওই কক্ষে মূল্যবান সামগ্রী রাখা হতো বলে জানান পরিবারের সদস্যরা। বাড়ির পেছনে ঘাটসহ একটি পুকুর রয়েছে, যা তখনকার গ্রামীণ বসতবাড়ির জীবনযাপনের অংশ হিসেবেই নির্মিত। বাড়ির সামনের দিকে রয়েছে বড় পরিসরের খোলা জায়গা, যা এখনো আগের কাঠামো ও পরিসর ধরে রেখেছে।

ইতিহাসের সাক্ষী ১৩০ বছরের পুরোনো ‘জিয়া বাড়ি’

বাড়ির পূর্ব পাশে অবস্থিত খালটি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় নিজ উদ্যোগে খনন করা হয়। স্থানীয় কৃষকদের সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতেই এই খাল খনন করা হয়েছিল বলে জানান এলাকাবাসী। আজও ওই খাল এলাকার কৃষিজমিতে সেচের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জিয়াউর রহমানের স্মৃতি সংরক্ষণের কথা বিবেচনা করেই বাড়িটিকে নতুনভাবে নির্মাণ বা আধুনিক রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উদ্দেশ্য ছিল, স্মৃতিবাহী স্থাপনাটি যেন তার মূল চরিত্র হারিয়ে না ফেলে।

এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ রফিকুল ইসলাম জানান, বাড়িটি জিয়া পরিবারের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে দেওয়াল রং করা হয়েছে, ছাদ ও কাঠের অংশে মেরামত করা হয়েছে, তবে স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রাখার বিষয়ে কোনো আপস করা হয়নি। বাড়ির ভেতরে একসময় থাকা আসবাবপত্র, নথিপত্র ও স্মৃতিচিহ্নের একটি অংশ আগেই নিরাপত্তার স্বার্থে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

ইতিহাসের সাক্ষী ১৩০ বছরের পুরোনো ‘জিয়া বাড়ি’

তিনি বলেন, ‌‘এটা আমাদের কাছে শুধু একটি বাড়ি নয়, এটা আবেগ আর ইতিহাসের জায়গা। আমরা চাই না স্মৃতিটা বিকৃত হোক বা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হোক। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ হলে সেটি আরও সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ হবে।’

বাগবাড়ী গ্রামের তালুকদার পরিবারের বড় ছেলে মন্তেজার রহমান তালুকদার জানান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবার মূলত মণ্ডল বংশের। জিয়ার দাদা কামাল উদ্দিন মণ্ডল পাশের মহিষাবান গ্রাম থেকে বাগবাড়ীতে এসে তৎকালীন জমিদার পরিবারের কন্যা মিছিরুন নেছাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর মিছিরুন নেছা পৈতৃকসূত্রে প্রায় ৫০০ বিঘা জমির মালিক হন। জমিজমার কারণে কামাল উদ্দিন মণ্ডল স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বাগবাড়ীতেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই দম্পতির সংসারে সাত ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয়। ছেলেদের মধ্যে পঞ্চম সন্তান ছিলেন মনসুর রহমান। মনসুর রহমান পরবর্তী সময়ে জাহানারা বেগম রানীকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে জন্ম নেয় চার পুত্রসন্তান।

পরিবারের বর্ণনা অনুযায়ী, মনসুর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি। দাদা কামাল উদ্দিন মণ্ডল শখ করে নাতির নাম রাখেন জিয়াউর রহমান কমল। ‘কমল’ নামটি ছিল জিয়াউর রহমানের পারিবারিক ডাকনাম, যা পরিবারের ভেতরেই বেশি ব্যবহৃত হতো।

ইতিহাসের সাক্ষী ১৩০ বছরের পুরোনো ‘জিয়া বাড়ি’

শৈশব ও কৈশোরের শুরুতে জিয়াউর রহমান বাগবাড়ী গ্রামেই বড় হন। তিনি স্থানীয় বাগবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তবে এসময় তার বাবা মনসুর রহমান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাকরিসূত্রে পরিবারের সঙ্গে তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। এর ফলে দীর্ঘ সময় গ্রাম, আত্মীয়-স্বজন ও শৈশবের পরিচিত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জিয়াউর রহমান বাগবাড়ীতে এলে দীর্ঘদিন পর গ্রামের মানুষ ও আত্মীয়-স্বজন তাকে সরাসরি দেখার সুযোগ পান। সেসময় গ্রামে ব্যাপক আগ্রহ ও আবেগের সৃষ্টি হয় বলে জানান প্রবীণরা।

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জিয়াউর রহমানের পূর্বপুরুষরা ১৮৯৫ সালে বাগবাড়ী গ্রামে একটি একতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করেন। প্রায় ১৩০ বছরের পুরোনো এই বাড়িটিই বর্তমানে ‘জিয়া বাড়ি’ নামে পরিচিত। বাড়িটির স্থাপত্য এখনো সেই সময়ের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালে বাড়িটিতে দ্বিতীয় তলা নির্মাণ করা হয়।

বর্তমানে বাড়ির প্রবেশমুখে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে ‘জিয়া বাড়ি, বাগবাড়ী, বগুড়া’। বাড়ির ভেতরের পশ্চিম পাশে থাকা দোতলা পাকা ঘরের সামনের দেয়ালে এখনো নির্মাণকালীন শিলালিপি দৃশ্যমান। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, ‘২২শে আষাঢ় ১৩০২ সন, ১৮৯৫ সাল’। এই শিলালিপিই বাড়িটির ঐতিহাসিক বয়স ও গুরুত্বের নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ইতিহাসের সাক্ষী ১৩০ বছরের পুরোনো ‘জিয়া বাড়ি’

বাড়িটির সামনে দিয়ে যাওয়া সড়কটি এখন পুরো এলাকার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে এই সড়কে কার্পেটিং ও ঢালাই কাজ সম্পন্ন করেছে। রাস্তার দুই পাশে বসানো হয়েছে লম্বা পিলার। সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে সোলার লাইট। সন্ধ্যার পর এই এলাকায় আলো-ছায়ার যে দৃশ্য তৈরি হয়, তা গ্রামীণ সড়কে সচরাচর দেখা যায় না।

স্থানীয়রা জানান, বিগত প্রায় ১৭ বছর এই সড়কের দিকে কার্যত কোনো দপ্তরের নজর ছিল না। বর্তমানে উন্নয়ন হওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি তৈরি হয়েছে। নশিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আমির আলী বলেন, ‘আগে এই রাস্তায় চলাচল করাই কষ্টকর ছিল। এখন সুন্দর হয়েছে, বাইরের মানুষও আসছে। এলাকায় একটা প্রাণ এসেছে।’

এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘এটি নিয়মিত উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ। আগেও রাস্তাটি কার্পেটিং করা ছিল। তবে এবার এটি সৌন্দর্যবর্ধনে আরও কিছু অতিরিক্ত কাজ করা হয়েছে। আগামীতেও এটি চলমান থাকবে।’

স্থানীয়দের ধারণা, ঐতিহাসিক একটি স্থাপনার আশপাশে এমন উন্নয়ন কাজ হওয়ায় জায়গাটির গুরুত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। তারা মনে করছেন, এই সড়ক উন্নয়ন ভবিষ্যতে দর্শনার্থী ব্যবস্থাপনাতেও ভূমিকা রাখবে।

শুধু সড়ক নয়, পরিবেশ উন্নয়নেও কাজ শুরু হয়েছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে রাস্তার পাশে ফুল ও ছায়াদানকারী গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া চলছে। এতে পুরো এলাকা আরও সবুজ ও নান্দনিক হয়ে উঠবে বলে আশা করছেন স্থানীয়রা।

ইতিহাসের সাক্ষী ১৩০ বছরের পুরোনো ‘জিয়া বাড়ি’

কৃষক আমরুল আলী বলেন, ‘আগে ধুলাবালি ছিল। এখন রাস্তা ভালো হয়েছে। গাছ লাগালে জায়গাটা দেখতে আরও সুন্দর হবে।’

উপজেলা বন কর্মকর্তা দেল আবরার বলেন, ‘সৌন্দর্য রক্ষায় কাজ চলছে। এটি পর্যায়ক্রমে সড়কের দুইপাশেই করা হবে।’

কথা হয় ধুনট থেকে আসা দর্শনার্থী মনির হোসেনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাবতাম এখানে বড় কোনো জাদুঘর থাকবে। এসে দেখি খুব সাধারণভাবেই রাখা হয়েছে। এটা ভালো লেগেছে। তবে ইতিহাস জানার মতো তথ্যফলক বা নির্দেশনা থাকলে নতুন প্রজন্ম আরও উপকৃত হতো।’

দর্শনার্থীদের বড় একটি অংশই মনে করেন, বাড়িটিকে বড় আকারে রূপান্তর না করে পরিকল্পিতভাবে তথ্যভিত্তিক সংরক্ষণই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ। এতে করে বাড়ির ঐতিহ্যও থাকবে, আবার ইতিহাস জানার সুযোগও তৈরি হবে।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি সাদেক আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই বাড়ি আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী। সরকারিভাবে সংরক্ষণ হলে দেশের মানুষ উপকৃত হবে।’

গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রোকন তালুকদার বলেন, বর্তমানে বাগবাড়ীর ‘জিয়া বাড়ি’ কোনো বড় প্রকল্পের আওতায় আসেনি। তবে চারপাশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দর্শনার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক তৎপরতা মিলিয়ে একটি সম্ভাবনার ইঙ্গিত স্পষ্ট। পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া হলে এখানে ইতিহাস সংরক্ষণ ও জনসম্পৃক্ততার একটি ভারসাম্যপূর্ণ মডেল তৈরি করা সম্ভব।

এসআর/জেআইএম