প্রধানমন্ত্রীর কথা রাখলেন সলেমান
২০১৬ সালে জাতীয় কৃষি পুরস্কারে ভূষিত হন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মোলানী গ্রামের কৃষক সলেমান আলী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে পুরস্কার তুলে দেয়ার সময় বলেছিলেন, ‘কৃষকদের জন্য কাজ কর, তাহলে আবারো পুরস্কৃত হবা।’
তখন থেকেই সলেমানের মাথায় চিন্তা আসে কৃষকদের জন্য কিছু একটা করার। স্বল্প খরচে কৃষকদের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেই চিন্তা থেকেই তিনি ভ্রাম্যমাণ সৌর সেচযন্ত্র তৈরি করছেন।
ভ্রাম্যমাণ সৌর সেচযন্ত্রের উদ্ভাবক সলেমান আলী জাগো নিউজকে এসব কথা জানান।
তিনি বলেন, একটা সময় আমার খুব অভাব ছিল। এক বেলা খেলে আরেক বেলার খাবার নিয়ে চিন্তায় থাকতাম। তাই সংসারের তাগিদে সাইকেল মেকানিকের কাজ শুরু করি। তবুও সংসার চালাতে পারছিলাম না। জমি জায়গা না থাকায় সব সময় বিকল্প পেশা খুঁজতাম। দেশ স্বাধীনের পর কৃষক যখন জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য জাপানি শ্যালোমেশিন ব্যবহার করা শুরু করলো। তখন মনে হলো একটা শ্যালোমেশিন যদি ক্রয় করা যায় তাহলে ওই মেশিনের পানি বিক্রি করে সংসার ভালই চলবে। অর্থের অভাবে সেই শ্যালোমেশিনও কেনা হয়নি।
সলেমান আলী বলেন, সাইকেল মেকানিকের কাজ বাদ দিয়ে এবার শ্যালোমেশিন মেকানিকের কাজ শুরু করলাম। পরবর্তীতে আইপিএস তৈরির কাজ শুরু করলাম। আস্তে আস্তে কিছু জমি জায়গাও ক্রয় করলাম। তখন বাড়তি উপার্জনের জন্য মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদনের জন্য হ্যাচারি তৈরি করলাম। অবশেষে মাছের পোনা উৎপাদন করে ২০১৬ সালে জাতীয় কৃষি পুরস্কারে ভূষিত করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পুরস্কার হাতে তুলে দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘কৃষকদের জন্য কাজ কর তাহলে আবারো পুরস্কৃত হবা।’ তখন থেকেই মাথায় চিন্তা আসে কৃষকের জন্য কিছু একটা করার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা রাখতেই হবে। এরপর থেকে শুরু করলাম স্বল্প খরচে কৃষকদের জন্য কিছু করা যায় কি না। সেই চিন্তা থেকেই সৌরবিদ্যুৎ এর চিন্তা আসে আমার মাথায়। 
সলেমানের সৌর সেচযন্ত্র উদ্ভাবনের গল্প:
ঠাকুরগাঁওয়ে বোরো মৌসুম এলেই ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া নিয়ে কৃষকদের দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। কিন্তু, সেই দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব হয় সূর্যের আলো নির্ভর সেচ প্রযুক্তি ব্যবহারে। ডিজেল কিংবা বিদ্যুৎ নয়, সূর্যের আলোর ব্যবহারে ভূগর্ভের পানি উঠিয়ে সেচকাজ চালানো হয়। কিন্তু এই প্রযুক্তি বেশ ব্যয়সাধ্য। কৃষকের একার পক্ষে এই প্রযুক্তি নেয়া জটিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাটি কাজে লাগানোর জন্য সৌরবিদ্যুৎ-নির্ভর সেচযন্ত্রকে কৃষকবান্ধব করতে কাজ করছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষক সলেমান আলী। বাড়ি সদর উপজেলার মোলানী গ্রামে। ২০১৫ সালে শুরু করা প্রচেষ্টা অবশেষে সফলতার মুখ দেখেছে। তৈরি করেছেন সৌরবিদ্যুৎ-নির্ভর ভ্রাম্যমাণ সেচযন্ত্র। তার এই যন্ত্রের নির্মাণ ব্যয় কম হওয়ায় দাম কৃষকের সাধ্যের মধ্যেই রাখা হয়েছে। বহনযোগ্য বলে বিভিন্ন স্থানে, খেতে নিয়ে সেচ দেয়া সম্ভব বলে জানিয়েছেন উদ্ভাবক কৃষক সলেমান।
প্রথমদিকে ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই বা আইপিএস তৈরি করে বিক্রি করতেন সলেমান। দেশে সৌর সেচযন্ত্র চালু হওয়ার পর এই প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য করতে কাজ শুরু করেন তিনি। আগের অভিজ্ঞতা বেশ কাজে লাগে তার। বাজারে থাকা সৌর সেচযন্ত্রে একের পর এক সৌর প্যানেল, কন্ট্রোলারসহ নানা যন্ত্রপাতি লাগিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন সলেমান। দ্রুতগতিতে পানি তুলতে পাম্পে যোগ করলেন গিয়ার বক্স। সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সৌর প্যানেলটি সহজে নড়াচড়ার ব্যবস্থাও করলেন। পরে সৌর প্যানেলের অবকাঠামোতে চাকা লাগিয়ে তা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহনের উপযোগী করে তুললেন। তিনি এই সৌর সেচযন্ত্রটির নাম দিলেন ভ্রাম্যমাণ বা মুভিং সৌর সেচযন্ত্র।
সলেমান বলেন, ভ্রাম্যমাণ সৌর সেচযন্ত্রে সূর্যের তাপ সংরক্ষণ করার জন্য ১০টি সৌরকোষ একত্রে সংযুক্ত করে একটি সৌর প্যানেল তৈরি করেছেন তিনি। প্রতিটি সৌরকোষের ধারণক্ষমতা ২৫০ ওয়াট। ওই সৌর প্যানেলের ওপর সূর্যের আলো পড়লেই এতে ভোল্টেজ সৃষ্টি হয় এবং সংযুক্ত তারের মাধ্যমে এটি থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। সেই বিদ্যুৎ দিয়ে চলে তিন হর্স পাওয়ারের একটি পানির পাম্প। এই সেচযন্ত্র দিয়ে জমিতে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সেচ দেয়া যায়। দুই হাজার ৫০০ ওয়াটের সৌর প্যানেল দিয়ে মিনিটে ৭০০ লিটার পানি ওঠে অনায়াসে। এক দিনে অনায়াসে ১০ বিঘা জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব।
সলেমানের হিসাবে, এক ওয়াট সৌরকোষের দাম পড়ে ৫০ টাকা। সেই হিসাবে ২৫০০ ওয়াটের সৌর প্যানেলের দাম পড়ে সোয়া লাখ টাকা। পানির পাম্প কেনা ও প্যানেলের অবকাঠামো তৈরিতে খরচ পড়ে আরও ৬৫ হাজার টাকা। একটি ভ্রাম্যমাণ সৌর সেচযন্ত্র তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত ১৪টি সৌর সেচযন্ত্র তৈরি করেছেন তিনি। এর মধ্যে নয়টি বিক্রি করেছেন, পাঁচটি ভাড়ায় খাটছে। প্রতি বিঘা জমিতে পানি দিতে প্রতিটি সেচযন্ত্র দুই হাজার টাকায় ভাড়া দেন তিনি। প্রতিটি সেচযন্ত্রের দাম নেন দুই লাখ টাকা। পাশাপাশি দেন কারিগরি সেবা।
পাশেই রাণীশংকৈল উপজেলার কোচল গ্রামে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) মাধ্যমে কৃষকেরা সাড়ে তিন পাওয়ার হর্সের সৌর সেচযন্ত্র স্থাপন করেছেন। ওই সেচযন্ত্র দিয়ে ১০ একর জমিতে সেচ দেয়া যায়। স্থাপন করতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা।
ওই সেচযন্ত্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মো. মমতাজউদ্দিন বলেন, তাদের সৌর সেচযন্ত্রটি বসাতে গেলে ন্যূনতম ১০ শতক জমি লাগে। আর উদ্ভাবিত সেচযন্ত্র দখল করে মাত্র ১৬ ফুট জায়গা। সম্প্রতি গ্রিন টেকনোলজি সিস্টেম (জিটিএস) বাজারে স্মার্ট সৌর সেচযন্ত্র নিয়ে এসেছে। ওই সৌর সেচযন্ত্র দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৫ বিঘা জমিতে সেচ দেয়া যায়। কিন্তু সেচযন্ত্রটি বসাতে খরচ হবে তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা।
সৌর সেচযন্ত্রের উদ্ভাবক সমেলমান আরও জানান, সরকার যদি আমার সৌর সেচযন্ত্র কৃষকদের মাঝে ছড়িতে দিতে পারে তাহলে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের ওপর কৃষককে নির্ভর করতে হবে না। আমার এই সৌর সেচযন্ত্র প্রসারিত করার জন্য সরকার যদি কোনো প্রকার ঋণের ব্যবস্থা করে থাকে তাহলে আমি সারাদেশে কমমূল্যে সৌর সেচযন্ত্রটি বাজারজাত করতে পারবো।
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মাসুদুদুল হক বলেন, সলেমান আলীর উদ্ভাবনটা আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এই সৌর সেচযন্ত্রটি যদি কৃষক ব্যবহার করা শুরু করে তাহলে ডিজেল বা বিদ্যুৎ লাগবে না। কম খরচে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্যে পাবে। সলেমোনের এই সৌর সেচ উদ্ভাবনের বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয়ে আমরা লিখিতভাবে প্রেরণ করেছি।
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক আবদুল আওয়াল সলেমানের সৌর সেচযন্ত্র পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি বলেন, সৌর সেচযন্ত্রটি কৃষকবান্ধব করে তুলতে তার উদ্ভাবন সত্যিই প্রশংসনীয়। তার উদ্ভাবনটি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে।
আরএআর/এমএস