ধর্ষণের কোনো আলামতই পায় না হাসপাতাল!
বাক প্রতিবন্ধী, আবার শারীরিকভাবেও প্রতিবন্ধী ১৮ বছরের তরুণীকে ধর্ষণ করেছে নেশাগ্রস্ত যুবক। এমন অভিযোগ ওঠে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার পল্লীতে। বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ মামলা করতে হলে ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়ে আনার কথা বলে। ১২ ডিসেম্বরের ঘটনা এটি। পরিবারের লোকজন ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যান প্রতিবন্ধী ওই তরুণীকে।
২৩ ডিসেম্বর হাসপাতাল থেকে দেওয়া (১৮ ডিসেম্বর তারিখ উল্লেখ করে) লিখিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
ধর্ষিতার চাচাতো ভাই ২ জানুয়ারি জাগো নিউজের কাছে বলেন, রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের গাজিনগর গ্রামের বাসিন্দা মৃত লালু মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম নেশাগ্রস্ত। আমার বোন নিজে নিজে বাথরুমে যেতে পারে না, তাকে খাইয়ে না দিলে খেতে পারে না, কথাও বলতে পারে না। ঘরে কেউ না থাকার সুযোগে এমন মানুষটির সঙ্গে জোর করে খারাপ কাজ করেছে। আমরা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে পুলিশকে অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু তারা মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে যেতে বলেছেন। ২৩ ডিসেম্বর আমাদেরকে মেডিকেল রিপোর্ট দেওয়া হয়, ওখানে নেগেটিভ উল্লেখ করায় আমরা কোথাও অভিযোগ জানাতে পারিনি।
মেয়েটির গ্রামের মসজিদের ইমাম মো. কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, মেয়েটি ইশারায়ও কথা বলতে পারে না। ঘটনার পর সবাই জড়ো হয়েছেন, আমিও গিয়েছি, আলামত দেখে হাটির সকলেই বলেছেন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিচার তো পেলো না।
অভিযুক্ত রফিকুলের চাচাতো ভাই মো. রোকন মিয়া অবশ্য ঘটনার পরই দাবি করেছেন, এই অভিযোগ সত্য নয়।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তের আদিবাসী পল্লীর নববিবাহিত তরুণী (২৩) পাহাড়ি ছড়ায় গোসল করতে গিয়ে ১৪ আগস্ট ধর্ষণের শিকার হন। ওই দিনই তরুণীর মা তাহিরপুর থানায় মামলা (নম্বর-জিআর ১২/২১২) করেন। পরদিন ১৫ আগস্ট ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে আসেন ওই তরুণী।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ আদিবাসী পল্লীর বাসিন্দারা সুনামগঞ্জ শহরে এসে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন। ধর্ষিতার মামা জানান, ১০ দিন পর ডাক্তারি পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট হাতে পান তারা।
তাহিরপুর থানা পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক মেডিকেল রিপোর্টে নেগেটিভ আসার কথা উল্লেখ করে ‘ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের চেষ্টা’র কথা উল্লেখ করে আদালতে ২১ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
নির্যাতিত তরুণীর মামা ০৪ জানুয়ারি জাগো নিউজকে বলেন, ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের কথা উল্লেখ না করায় আমরা হতাশ হয়েছি। এমন সত্য ঘটনা আমরা প্রমাণ করতে পারছি না। আমার ভাগনি আদালতে ভয়ে ধর্ষণ চেষ্টার কথা বলেছে।
ওই তরুণীর আইনজীবী গত ১০ নভেম্বর অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজী দাখিল করেন। নারাজীর আবেদনে আইনজীবী অ্যাডভোকেট মতিয়া বেগম উল্লেখ করেন, তাহিরপুর থানা পুলিশ ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষায় সময় ক্ষেপণ করেছে। ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষার সময় কাপড়চোপড় সঙ্গে না দিয়ে থানা হেফাজতে রেখে নষ্ট করা হয়েছে। নির্যাতিতার বাংলা ভাষা সম্পর্কে ধারণা কম। বলতে পারে না, বুঝতেও পারে না। এ কারণে না বুঝে ২২ ধারার জবানবন্দি দিতে ভুল করে সে ধর্ষণের কথা উল্লেখ না করে ধর্ষণের চেষ্টার কথা উল্লেখ করেছে। ওখানে দোভাষী নিয়োগ করা জরুরি ছিল। ন্যায় বিচারের স্বার্থে আসামির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনী ২০০৩’এর ৯ (১) ধারায় অপরাধ আমলে নিয়ে বিচারকার্য গ্রহণ করে সুবিচার প্রার্থনা করেন আইনজীবী।
এই মামলার আসামি তাহিরপুর সীমান্তের রাজাই গ্রামের আব্দুল রশিদ (৪৫) গত ১২ ডিসেম্বর আদালত থেকে জামিন লাভ করেন।
তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ তরফাদার অবশ্য বলেছেন, তাহিরপুর সীমান্তের আদিবাসী তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। ভিকটিম আদালতে ২২ ধারার জবানবন্দিতে ধর্ষণের কথা উল্লেখ না করে ধর্ষণের চেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে পুলিশের কোনো অবহেলা ছিল না। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ।
একইভাবে শাল্লা উপজেলার বাক প্রতিবন্ধী তরুণী গৃহপরিচারিকার কাজ করার সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। এক পর্যায়ে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। ১৭ নভেম্বর দিরাই হাসপাতালে নিয়ে ভিকটিমের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভপাতও ঘটানো হয়। মেয়েটি পরে পরিবারের লোকজনকে ইশরায় জানিয়ে দেয় হবিবপুর ইউনিয়নের মার্কুলী গ্রামের এলাছ মিয়া ধর্ষণ করে গর্ভপাত ঘটিয়েছে তার।
এ বিষয়ে ২২ নভেম্বর শাল্লা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (৯) (১)সহ ৩১৩ ধারায় মামলা হয়। মামলা দায়েরের পরদিন ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা হয় সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. লিপিকা দাস জাগো নিউজকে বলেন, মেয়েটি মুখে কথা বলতে পারে না। কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি। ইউরিন টেস্টেও নেগেটিভ এসেছে। গর্ভপাত কোথায় ঘটিয়েছে, কোনো কাগজপত্র নেই। এই অবস্থায় আমাদেরকে নেগেটিভ রিপোর্টই দিতে হয়েছে।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, শাল্লার বাকপ্রতিবন্ধী ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে।
শাল্লা থানার সাব-ইন্সপেক্টর আবুল বাশার গত বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) জানান, এই মামলা তদন্তাধীন আছে, আসামিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে হাসপাতাল থেকে পাঠিয়েছে বলে জানালে তিনি বলেন, আমরা পাইনি।
এদিকে সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার রফিকুল ইসলাম বললেন, না পেলে জানানো উচিৎ ছিল, বিষয়টি দেখছি আমি।
শুধুমাত্র এই তিনজনই নয়, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে নিরীহ, হতদরিদ্র নারী ও শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলেও ফরেনসিক প্রতিবেদনে প্রমাণ পাওয়া যায় না। গেল ৬ মাসে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করতে আসে ৬২ জন নারী ও শিশু। ডাক্তারি পরীক্ষায় তাদের কারও শরীরেই ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। অথচ ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ডাক্তারের রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ। এর ভিত্তিতেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্তকারী সংস্থা।
ডাক্তারি প্রতিবেদন তৈরিসহ পুরো প্রক্রিয়ায় অব্যবস্থাপনা চলছে বলে অভিযোগ নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের। তাদের দাবি, সাধারণত ফরেনসিক বিভাগে জবাবদিহিতার জায়গাটা শিথিল। এ কারণে অনেক সময় দায়সারা গোছের প্রতিবেদন দেয় তারা। এতে তদন্ত ঠিকমতো এগুতে পারে না। ঘুরে যায় মামলার গতিপথ। তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পার পেয়ে যায় অপরাধীরা।
তবে এ বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি, জনবল সংকটসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয় ফরেনসিক বিভাগকে। এরপরও যেসব যন্ত্রপাতি আছে তা দিয়েই সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
তাদের দাবি, বেশিরভাগ ভিকটিমই সচেতন নন। তাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতাই আলামত নষ্ট হয়ে যওয়ার প্রধান কারণ।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. লিপিকা দাস বললেন, ভিকটিমকে যদি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনা যায় তাহলে ধর্ষণের আলামত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাৎক্ষণিক করা গেলে আর ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেলে সমস্যা তৈরি হয়। কারণ ওই সময়ের মধ্যে ভিকটিম গোসলসহ অন্যান্য কাজে পানি ব্যবহার করলে তখনই আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া ছোয়াব পরীক্ষার মাধ্যমে যেটি করা হয়, সেটিও তিনদিনের বেশি থাকে না। নির্যাতনের শিকার প্রতিবন্ধী কিশোরী ও আদিবাসী নারীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে।
কিছু সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসিতে) স্বয়ংসম্পূর্ণ টিম নেই। রেডিওলজি বিভাগও সক্রিয় নয়, এ কারণে ভিকটিমের বয়স নির্ধারণে সমস্যা হয়।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আনিসুল হক বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিকটিমের অজ্ঞতার কারণে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে নেগেটিভ রিপোর্ট দিতে হচ্ছে। গেল ৬ মাসে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে, এভাবেই হয়েছে। ডাক্তার, কর্মচারী শূন্যতায় কাজে সমস্যা হওয়ার কথাও জানালেন তিনি।
সুনামগঞ্জ মহিলা পরিষদের সভাপতি গৌরি ভট্টাচার্য বলেন, ধর্ষণ একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। তাই ফরেনসিকের প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রেও সতর্কতা প্রয়োজন। সদর হাসপাতালের গত ছয় মাসের সবগুলো প্রতিবেদনই ধর্ষণের আলামত মেলেনি। এতে কি প্রশ্ন জাগে না? ঘাটতিটা আসলে কোথায়?
তিনি আরও বলেন, ধর্ষণের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রভাবশালীদেরও চাপ থাকে। যা প্রতিবেদনকে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।
সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। দেরি হলে আলামত পাওয়া কষ্টকর। ধর্ষকের ও ভিকটিমের ডিএনএ টেস্ট করেও রিপোর্ট পাওয়া যায়। সামাজিক-পারিপার্শিক বাস্তবতায় এখনো আলামত নষ্টের কারণেই ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ হয়। অজ্ঞতা, প্রত্যন্ত এলাকা, ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা, ধর্ষণকারী প্রভাবশালী ইত্যাদি নানা কারণে আলামত নষ্ট হতে পারে। তাই বলে সুনিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে ধর্ষণ হয়নি। ভিকটিমের স্বাস্থ্য, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যসহ অন্যন্য আনুষঙ্গিক বিষয় থেকেও যদি প্রমাণ করা যায় যে ধর্ষণ হয়েছে, তাহলেও ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।
তিনি বলেন, এখনকার মতো আধুনিক ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার ব্যবস্থা একসময় ছিল না। দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের বিচার হতো। এক্ষেত্রে প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশের কাছে এ ধরনের অভিযোগ গেলেই তাদের দায়িত্ব হচ্ছে দ্রুত ডাক্তারের কাছে ভিকটিমকে পাঠানো। মোটকথা ভিকটিমের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, সুনামগঞ্জের সভাপতি ফৌজিআরা শাম্মী বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিম থাকে দুর্বল। প্রভাবশালী ধর্ষকের চাপে একসময় ভিকটিম প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে ফেলে। কাউকে এক পর্যায়ে পাশেও পায় না। পাশে থাকার প্রবল আগ্রহ থাকে না আমাদের কারোরই। এই পর্যায়ে আপোসের দিকে যেতে বাধ্য হয় ভিকটিম।
সদর হাসপাতালের গাইনি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ডা. তাহমিনা ইয়াছমিন চৌধুরী জানান, গেল পহেলা জুলাই থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আসা ৬২ জনের মধ্যে সকলেরই ফরেনসিক প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে জুলাই মাসে ৯, আগস্ট ১০, সেপ্টেম্বর ১৯, অক্টোবর ৬, নভেম্বর ৮ এবং ডিসেম্বরে ১০ জন নির্যাতিতার ডাক্তারি পরীক্ষায় রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শামছুল ইসলাম বলেন, আমাদের সমাজে ধর্ষণের ঘটনায় ভিকটিমকে বেশিরভাগ সময় সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হয়। এ কারণে ঘটনার আকস্মিকতায় তারা প্রথমে করণীয় ভুলে যায়। আলামত নিয়ে আসতে দেরি করে ফেলে। আসামি যদি প্রভাবশালী হয় সেক্ষেত্রে চাপটা আরও বেড়ে যায়। আপস মিমাংসা, মামলা তুলে নিতে হুমকি নানা ধরনের চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয় ভিকটিমের পরিবারকে। আলামত নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বীর্যের জীবনকাল ৭২ ঘণ্টা থাকে, ভিকটিম বুঝতে বুঝতে এই সময় পার হয়ে যায়। অনেক ধর্ষকের মাইন্ড সেটআপ থাকে, তারা নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে যাতে পরীক্ষার সময় আলামত না পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, ল্যাব না থাকায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ডিএনএন টেস্টে সমস্যা হচ্ছে। যেমন সিলেটে চুল, ছোয়াব বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংরক্ষণের সুযোগ আছে, কিন্তু ডিএনএ ল্যাব না থাকায় পরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই।
ডিএনএ রিপোর্টের জন্য নমুনা ঢাকায় পাঠাতে হয়। ওখান থেকে রিপোর্ট আসতে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগে। ততদিনে ভিকটিম পিছু হঠে এবং ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। এ বিভাগটির প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। কেননা ডিএনএ ল্যাব ছাড়া দ্রুত রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব নয়।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ধর্ষণ মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ সাজানো মামলা। গ্রামাঞ্চলে জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে অনেক সময় ধর্ষণ মামলা দেওয়া হয়।
জেলার জগন্নাথপুরে এক প্রবাসী দখলকারীকে বাড়ি ছাড়তে বলায় ধর্ষণ মামলা নিয়ে এসেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, বিষয়গুলো যাচাই করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে কোনটি আসল কোনটি নকল বোঝা যায় না। এ কারণে অনেক সময় প্রকৃত ভিকটিম বিপদে পড়ে যায়। বিষয়গুলো আসলে গভীর তদন্তের দাবি রাখে।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় অনেক সময় ঘটনা ঘটলে পরীক্ষায় আসতে আসতে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আলামত নষ্ট হয়ে গেলেই মামলা হবে না বা ভিকটিম ন্যায়বিচার বঞ্চিত হবে এমনটা আমার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় হবার সুযোগ নেই। ঘটনার পর পর পুলিশ বা মহিলা পুলিশ প্রাথমিক যাচাই করেও ঘটনার সত্যাসত্য অনেকটা জানতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল রিপোর্টের জন্যও পাঠাতে পারে। আমার জানা অবস্থায় কোন অধস্তন পুলিশ অফিসারের এই বিষয়ে অবহেলার সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, গেল ছয় মাসে তারা ৪৬টি ধর্ষণ মামলা নিয়েছেন। অভিযোগ দাখিল হয়েছে ২২টিতে, তদন্তাধীন আছে ২১টি মামলা, ৩টি অভিযোগের ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।
এফএ/এএসএম