বগুড়ায় দেড় বছর ধরে একঘরে পাঁচ পরিবার
বগুড়ার সোনাতলার পাকুল্লা ইউনিয়নের ঘোষপাড়া গ্রামে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে দেড় বছর ধরে পাঁচটি পরিবারকে একঘরে করে রাখার অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। ওই গ্রামের সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের সভাপতি মন্টু চন্দ্র ঘোষ ও তার ভাতিজা গ্যাঁদা চন্দ্র ঘোষের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে।
একঘরে করে রাখায় এ পাঁচটি পরিবার গ্রামের অন্য বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাবার্তা-চলাফেরা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও ধর্মীয় উপাসনায় অংশ নিতে পারেন না। এ নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চারবার লিখিত নোটিশ দিয়েছেন। এছাড়া পুলিশ একাধিকবার ওই প্রভাবশালীদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরও প্রভাবশালীরা তাদের কথা অমান্য করে পরিবারগুলোকে একঘরে করে রেখেছেন।
২০২২ সালের এপ্রিলে পাকুল্লা ইউনিয়নের ঘোষপাড়া গ্রামের বাসিন্দা পরিমল চন্দ্র ঘোষ ও তার ভাই শিশির চন্দ্র ঘোষসহ তাদের চাচাতো ভাই নির্মল ঘোষ, নরেশ ঘোষ ও গয়েশ্বর ঘোষের পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয় বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাকুল্লা ইউনিয়নের ঘোষপাড়া গ্রামের বাসিন্দা পরিমল চন্দ্র ঘোষ ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রতিবেশী গ্যাঁদা ঘোষের কাছে চার শতক পৈতৃক জমি বিক্রি করেন। এর কয়েকদিন পর পরিমলের ভাই শিশির চন্দ্র ঘোষ একই স্থানে থাকা ছয় শতক জমি গ্যাঁদার ভাই সুজয় ঘোষের কাছে বিক্রির জন্য তিন লাখ টাকা বায়না নেন। ওই টাকা শিশির তার চাচাতো ভাই নির্মল ঘোষের কাছে রেখে দেন। পরে শিশির চাকরির জন্য পাবনায় তার কর্মস্থলে চলে যান। গ্যাঁদা ও সুজয় জমির বাকি টাকা নিয়ে শিশিরকে দলিল লিখে দিতে বলেন। তবে পাবনায় থাকায় তিনি কয়েকদিনের জন্য সময় চান।
এদিকে বায়নার টাকা নির্মলের কাছে থাকায় পাকুল্লা বাজারে গ্যাঁদা তাকে আটকিয়ে ওই ছয় শতক জায়গার দলিল লিখে নিতে চান। এতে তিনি অস্বীকৃতি জানালে গ্যাঁদা কিছু যুবকদের নিয়ে নির্মলকে মারধর করেন। পরে এ নিয়ে গ্রামের মধ্যে উভয়পক্ষ সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়লে হতাহতের ঘটনা ঘটে। গ্যাঁদার চাচা মন্টু ঘোষ দুর্গা মন্দিরের সভাপতি হওয়ায় এলাকায় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। এ নিয়ে তিনি সালিশ বসিয়ে ওই পাঁচ পরিবারকে একঘরে করে দেন।
সালিশে গ্রামের বাকি ২৮টি হিন্দু পরিবারকে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা-চলাফেরা, সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ও একসঙ্গে ধর্মীয় উপাসনায় অংশ নিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর থেকেই ওই পাঁচটি পরিবার গ্রামের মন্দিরে পূজা-অর্চনায় অংশ নিতে পারছে না। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে পাশের মাঝিপাড়া হিন্দুপাড়া গ্রামে গিয়ে তাদের ধর্মীয় উপাসনা করতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘোষপাড়া গ্রামের এক দোকানি বলেন, ‘মন্টুর জন্য গ্রামের বাকি হিন্দু পরিবার নির্মলদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে না। তাদের দীর্ঘদিন ধরে একঘরে করে রেখেছে। আমি নাম প্রকাশ করলে ২৮টি পরিবারকে আমার দোকানে আসতেও বাধা দেবে।’
পাকুল্লা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুর সাত্তার বলেন, ‘নির্মলসহ তাদের পাঁচ পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে অনেকবার সালিশ বৈঠক হয়েছে। তবে মন্টুরা কোনো সমাধানে আসেন না। নির্মলরা বাধ্য হয়ে হিন্দুদের বাদে শুধু মুসলমানদের সঙ্গে চলাফেরা করতে পারেন।’
ভুক্তভোগী নির্মল ঘোষ বলেন, ‘বিষয়টি তুচ্ছ। তারা আমাকে মারধর করেছে। পরে এ নিয়ে উভয়পক্ষে ঝামেলা হয়েছে। তবে এর এলাকাভিত্তিক বা আইনগত সমাধান আছে। কিন্তু মন্টু ও গ্যাঁদা কিছু মানে না। তারা আমাদের পাঁচ পরিবারকে একঘরে করে রেখেছে।’
এ বিষয়ে জানতে গ্যাঁদা ঘোষের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ওরা আমাদের মারধর করেছে। আপনি নিউজ করবেন, করেন।’ এরপর তিনি কল কেটে দেন।
ঘোষপাড়া সার্বজনীন মন্দির কমিটির সভাপতি মন্টু চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘জমিজমার জন্য নির্মলরা বাইরে থেকে লোকজন এনে আমাদের মারধর করেছে। গ্রামের ২৮ ঘরের বাসিন্দা আমাদের পরিবারের সদস্য, তাই কেউ ওদের সঙ্গে চলাফেরা করে না। এলাকায় হট্টগোল করায় তাদের একঘরে হয়ে থাকতে হচ্ছে। তবে আমরাও চাই মীমাংসা হোক।’
পাকুল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম লতিফুল বারী বলেন, ‘ঘোষপাড়া গ্রামে দুই পক্ষের জমি নিয়ে দ্বন্দ্বে পাঁচ পরিবারকে একঘরে রাখা হয়েছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য কয়েক দফা চিঠি দিলেও মন্টু ঘোষেরা সাড়া দেননি। এরপরও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
সোনাতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈকত হাসান বলেন, লিখিত অভিযোগ না থাকলেও পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে উভয়পক্ষ একসঙ্গে তাদের ধর্মীর রীতিনীতি ও সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করতে পারেন।
এসআর/জিকেএস