আওয়ামী লীগে নেতাকর্মী বাড়লেও ভোট বাড়েনি বগুড়ায়
ফাইল ছবি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া জেলার ১২ উপজেলায় ভোট প্রদানের হার নিয়ে ভোটার, সাধারণ মানুষ এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মাঝেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। জেলায় সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনে ৩৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন বগুড়া-৬ (সদরে) আসনে ২১ শতাংশ।
বিএনপির দূর্গ হিসেবে পরিচিত বগুড়ায় আগের চাইতে নৌকার ফলাফল অনেক ভালো হলেও ভোটাহার মোটেও আশাব্যঞ্জক নয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বাড়লেও ভোট বাড়েনি। এই জেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৬০৪টি। কিন্তু ভোট পড়েছে মাত্র ৮ লাখ ১৯ হাজার ৬৪টি। যা শতকরা ২৯ দশমিক ৮০ ভাগ মাত্র। ক্ষমতায় থাকার পরও জেলার একটি বড় অংশের ভোটারকে কেন্দ্রমুখী করতে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। একইসঙ্গে তাদের নিজেদের সমর্থনকেও চোখ রাঙাচ্ছে এই অনুপস্থিতি।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন কবিরাজ। এ আসনের সংসদ সদস্য ও জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনকে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিগত ২০০৮ সাল থেকেই বগুড়া-৪ আসনটি জাসদকে ছেড়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এরমধ্যে ২০০৮ ও ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন জাসদের প্রার্থী রেজাউল করিম তানসেন। ২০১৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। তবে ২০১৮ সালে পরাজিত হন। পরে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যের পদত্যাগের পর ২০২৩ সালের উপ-নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য হন।
আসনটি বারবার শরিক দলকে ছেড়ে দেওয়ায় কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ। সেখানে ভোট চলাকালেই ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের অনেকে বলেন, দলীয় প্রার্থীকে সরিয়ে নেওয়ায় এবার নৌকার সমর্থক ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়া কঠিন হবে। তাদের অনেকে আবার সরাসরি বিএনপির বহিষ্কৃত প্রার্থী ডা. জিয়াউল হক মোল্লার হয়েও কাজ করেছেন। নেতাকর্মীদের এই অনীহা ভোটের রেজাল্টেও স্পষ্ট ছিল। সেখানে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৪টি ভোটের মধ্যে মাত্র ৯৩ হাজার ৭৪৯টি ভোট পড়ে।
বগুড়া-৩ আসনে (আদমদীঘি-দুপচাচিয়া) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। তিনি আদমদীঘি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। এখানেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম তালুকদারকে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রথমে সিরাজুল ইসলামকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেওয়ায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়ায় হতাশ হন তারা। এই হতাশা ছিল ভোটের মাঠেও। ৩ লাখ ২৪ হাজার ৪২৭ ভোটের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার ৫২৩ ভোট পেয়ে জামানত হারান তিনি। আর এ সুযোগে স্বতন্ত্র প্রার্থী খান মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ আল মেহেদী ৬৯ হাজার ৭৫০ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে।
এদিকে বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান। তিনি শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়রের পদ ছেড়ে সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়েছিলেন। এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হন বর্তমান সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। তিনি ২০১৪ সাল থেকে টানা দু’বারের সংসদ সদস্য। ২০১৮ মাহমুদুর রহমান মান্নাকে হারিয়ে আবার সংসদ সদস্য হন তিনি। এখানেও তৌহিদুর রহমানের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এরপর বিদ্রোহ করে বসেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা বিএনপির বহিষ্কৃত নেত্রী বিউটি বেগমের ট্রাক মার্কার পক্ষে সরাসরি মাঠে নামেন। তবে এই আসনে পরাজয় হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর। সেখানেও ৩ লাখ ২৬ হাজার ১৮৬ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র ২৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ ভোটার (৮৬,৬১৫) ভোট দেন। আওয়ামী লীগ বিরোধিতা করার পরও জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কা নিয়ে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ জয়লাভ করেন।
বগুড়ার ভিআইপি আসন বলা হয় বগুড়া-৬ (সদর) ও বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনকে। এই আসনগুলোতে ভোটাররা এবার নৌকাকে বিজয়ী করলেও ভোটের হার আশাব্যঞ্জক ছিল না। জেলার ৭টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে কম ২১ শতাংশ ভোট পড়ে সদর আসনে। অথচ এখানে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ২৮ হাজার ৪২টি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা স্বীকার করেন যে, এই মুহূর্তে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিভক্তি অনেকটাই স্পষ্ট। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জরুল আলম মোহন নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নানের ট্রাক মার্কার ভোট করেছেন। তার মতো হাইপ্রোফাইল এমন অনেক নেতাই আছেন যারা গোপনে নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন।
অন্য একজন নেতা বলেন, জেলার সুবিধা নিতে নেতাকর্মীর শেষ নেই। অথচ ভোটের মাঠ থাকে ফাঁকা। আমাদের ভোটার বের করতে ঘাম ঝরাতে হয়। সবাই শুধু রেডিমেড ক্ষমতার স্বাদ নিতে চায়।
তিনি দাবি করেন, এমন অনেক নেতাকর্মী আছেন যারা পরিবারসহ ভোটকেন্দ্রেই যাননি। তাদের অংশগ্রহণ থাকলে ভোট প্রদানের সংখ্যা কিছুটা হলেও বাড়তো।
ভোটের দিন সরেজমিন পরিদর্শনকালে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলার ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার আনাগোনা ছিল হতাশাজনক। অর্ধেক বেলায় কোনো কোনো স্থানে ১০ শতাংশের নিচে ছিল ভোট কালেকশন। কিন্তু দুপুরের পর হঠাৎ ভোট বাড়ার চিত্র ও প্রদত্ত ভোটের শতকরা হার বেড়ে যেতে থাকে।
গাবতলী ও সোনাতলা উপজেলার একটি কেন্দ্রে দায়িত্বপালনকারী সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা পরিচয় না প্রকাশের শর্তে জানান, তাদের কেন্দ্রে একজন প্রার্থীর কর্মীরা জাল ভোট দিয়েছে। এমনকি প্রকাশ্যে সিল মেরেছে। কিন্তু তারপরও ওই কেন্দ্রে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
একইভাবে শাজাহানপুর উপজেলার একটি কেন্দ্রে দায়িত্বপালনকারী পোলিং এজেন্ট জানান, ভোট শেষ হওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে কিছু সংখ্যক যুবক কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করে। বিষয়টি দায়িত্বশীলদের জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
৫৩ বছর পর আওয়ামী লীগের দখলে বগুড়া-৭
বগুড়া-০৭ (শাজাহানপুর-গাবতলী) আসনটি শহীদ জিয়ার জন্মস্থান। এটিকে বিএনপি তাদের ভিআইপি আসন বলে। এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. মোস্তফা আলম নান্নু নৌকা প্রতীকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। দেশ স্বাধীনের ৫৩ বছর পর আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী এই প্রথম আসনটিতে জয়লাভ করলেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় মহাজোট সরকারের শরীকদল জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট আলতাব আলী এমপি নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সারাদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও এই আসনটিতে আইনী জটিলতায় বিএনপির প্রার্থীশূন্য হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী সাংবাদিক রেজাউল করিম বাবলুকে বিএনপি সমর্থন দিলে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। এবার বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় ডা. মোস্তফা আলম নান্নু নৌকা প্রতীক নিয়ে ৯১ হাজার ২৯ ভোটে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী এটিএম আমিনুল ইসলাম লাঙ্গল প্রতীকে পান ৬ হাজার ৮০১ ভোট। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১২ হাজার ২৫৮ জন। এবার এই আসনে জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোট ১৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
এফএ/জিকেএস