রপ্তানির ৭০ শতাংশ আয় ১০ দেশ থেকেই, বাড়ছে ঝুঁকি
সীমিত সংখ্যক বাজারের ওপর অতি নির্ভরশীলতা বাড়ছে/জাগো নিউজ গ্রাফিক্স
বিশেষজ্ঞ ও শিল্পমালিকরা রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিচ্ছেন। ঠিক একই সময়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশ এসেছে মাত্র ১০টি দেশ থেকে। এটা সীমিত সংখ্যক বাজারের ওপর অতি নির্ভরশীলতার প্রকাশ। নতুন বাজার বড় না করতে পারলে বাড়বে ঝুঁকি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৬৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ—অর্থাৎ প্রায় ৩৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার মাত্র ১০টি দেশে কেন্দ্রীভূত।
রপ্তানি আয়ের চিত্র
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৪ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ মোট রপ্তানির ৬৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ এসেছে মাত্র ১০টি দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, ভারত, নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ড থেকে।
এই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি বাজার, যেখানে মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় বেশি। মার্কিন বাজারে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ১৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানিতেই আয় হয়েছে ৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।
দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার জার্মানিতে রপ্তানি আয় ৫ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি এবং মোট রপ্তানির ১০ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
- আরও পড়ুন
- অপ্রচলিত বাজারে বেড়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি
- বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে কমেছে বাংলাদেশের হিস্যা
- বাধা পেরিয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে, প্রত্যাশা ছুঁতে পারেনি প্রবৃদ্ধি
যুক্তরাজ্যে রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার (৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ), স্পেনে ৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার (৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ), ফ্রান্সে ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার (৫ শতাংশ), ইতালিতে ১ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার (৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ) এবং কানাডায় ১ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার (৩ দশমিক ০৩ শতাংশ)।
নেদারল্যান্ডসে রপ্তানি হয়েছে ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার (৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ), পোল্যান্ডে ১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার (৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ) এবং ভারতে ১ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার (৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ)।
বিশেষজ্ঞদের মত
বছরের পর বছর ধরে রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণের আহ্বান জানিয়ে আসছেন সংশ্লিষ্টরা, যেন নির্দিষ্ট কিছু বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমানো যায়। কিন্তু সেই আহ্বান এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি প্রধান বাজার বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো এবং কঠোর বাণিজ্য নীতি গ্রহণ শুরু করেছে, যা বিকল্প বাজার খুঁজে না পেলে দেশের রপ্তানি খাতে বড় ধরনের চাপ তৈরি করতে পারে বলে মন্তব্য করেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এতে মোট শুল্কের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সামগ্রিক রপ্তানিতে চলতি বছর বড় প্রভাব পড়তে পারে।
রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রপ্তানিপণ্যের পরিসর সীমিত। গবেষণা ও নীতিনির্ধারণ সংস্থার (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি আয়ের বড় একটি অংশ এখনো কয়েকটি খাত—বিশেষ করে তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য ও চামড়ানির্ভর।’
তিনি বলেন, ‘নতুন বাজারে প্রবেশ করতে হলে আমাদের কাছে বিকল্প পণ্য থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ধরতে চাইলে শুধু প্রচলিত পোশাক পণ্য দিয়ে হবে না, বরং এর বাইরেও নতুন ধরনের পণ্য দরকার, যা ওই দেশের মানুষ ব্যবহার করে। খাদ্য ও কৃষিপণ্যের কিছু চাহিদা থাকলেও তা মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।’
ড. রাজ্জাক মনে করেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ এশিয়ার অন্য উদীয়মান এবং অপ্রচলিত বাজারে নজর দেওয়া হতে পারে একটি কার্যকর পথ। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা বাড়ানোর ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন, যাতে মাত্র কয়েকটি বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমানো যায়।
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক আরোপ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ড. রাজ্জাক বলেন, ‘বাংলাদেশের বেশিরভাগ রপ্তানিকারক এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল, যেটি আমাদের একক বৃহত্তম বাজার। এই শুল্ক কাঠামোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে আমাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ব্যবস্থা নিতে হবে।’
যা বলছেন ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি ফজলে এহসান শামীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কয়েকটি বড় বাজারের ওপর উচ্চ মাত্রায় নির্ভরশীলতা সব সময়ই উদ্বেগের বিষয়। কারণ সেখানে কোনো সংকট দেখা দিলে কিংবা শুল্কজনিত সমস্যা তৈরি হলে এর প্রভাব বড় আকারে পড়ে—যেমনটা আমরা যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপে দেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘তবে আমরা এখন বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি, বিশেষ করে অপ্রচলিত বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে। রপ্তানির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং রপ্তানি পরিমাণ বাড়াতে সরকারকে বাজার ও পণ্যের বহুমুখীকরণে নীতিগত সহায়তা জোরদার করতে হবে।’
এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘নতুন বাজারে প্রবেশে সরকারকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে যেতে হবে, যাতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা যায়।’ পাশাপাশি তিনি সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি ও ইউটিলিটি সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বর্তমানে প্রচলিত প্রণোদনা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন।
স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বলেন,
‘কোনো নির্দিষ্ট দেশে রপ্তানি বাড়ানো আমাদের একক নিয়ন্ত্রণে নয়। এটি মূলত ওই দেশের অর্থনীতির আকার ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স হলো বিশ্ব অর্থনৈতিক পরাশক্তি—এই দেশগুলোর অর্থনীতির আকার অনেক বড়। তাই তাদের উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। একটি নির্দিষ্ট দেশে রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের হাতে তেমন বিকল্পও নেই। তারপরও আমরা উদীয়মান বাজারগুলো অনুসন্ধান করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস