বাধা পেরিয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে, প্রত্যাশা ছুঁতে পারেনি প্রবৃদ্ধি

ইব্রাহীম হুসাইন অভি
ইব্রাহীম হুসাইন অভি ইব্রাহীম হুসাইন অভি
প্রকাশিত: ১০:০৬ পিএম, ০২ জুলাই ২০২৫

নানাবিধ সমস্যার মধ্যেও সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। তবে এ অর্জন রপ্তানিকারকদের দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) বুধবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করেছে, যা আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৪৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।

ইপিবির মতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমসের কার্যক্রম পুরোপুরি সচল থাকলে রপ্তানির চিত্র আরও ভালো হতে পারতো। তাদের দাবি, জুনের শেষভাগে এনবিআরের কর্মকর্তাদের আন্দোলনের ফলে আমদানি-রপ্তানির স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে সামগ্রিক রপ্তানি আয় কিছুটা কম হয়েছে।

তৈরি পোশাক রপ্তানির চিত্র

জাতীয় রপ্তানির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের ৩৬ দশমিক ১৫ বিলিয়নের চেয়ে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। এরমধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি আয় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করেছে, যা আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৪৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।- ইপিবির তথ্য

এছাড়া, হোম টেক্সটাইল রপ্তানি ২ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়ে ৮৭২ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৮৫১ মিলিয়ন ডলার। বিশেষায়িত টেক্সটাইল পণ্যের রপ্তানি ১৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৩৮২ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

অন্যদিকে, চলতি বছরের জুন মাসে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ কম। এরমধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যা ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ কম।

বাধা পেরিয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে, প্রত্যাশা ছুঁতে পারেনি প্রবৃদ্ধি

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

‘রপ্তানি আয়ে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা ছিল, তবে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও খারাপ নয়—এটি আরও ভালো হতে পারতো, যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রপ্তানিতে বিঘ্ন না ঘটতো’—এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে গত বছরের জুলাই ও আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ফলে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটে। কোটা আন্দোলন একপর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। আন্দোলনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা ও প্রশাসনিক স্থবিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রপ্তানি কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়ে, বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—বিশেষ করে জ্বালানি সংকট ও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য শুল্কহার নিয়ে অনিশ্চয়তা—যা সরকারের দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে যথাযথভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারলে আমরা রপ্তানির এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবো না।- বিজিএমইএ সভাপতি

বিজিএমইএ সভাপতি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন অর্থবছরে আমরা ভালো দিনের আশা করছি। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—বিশেষ করে জ্বালানি সংকট ও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য শুল্কহার নিয়ে অনিশ্চয়তা—যা সরকারের দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে যথাযথভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারলে আমরা রপ্তানির এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবো না।’

‘তবে নতুন করে যদি আর কোনো সংকট তৈরি না হয়, তাহলে আমরা মনে করি অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এবং রপ্তানি খাত হবে এর প্রধান চালিকাশক্তি’- আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিজিএমইএ সভাপতি।

গত অর্থবছরে নানান চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ‘উৎসাহজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কহার বৃদ্ধি এবং আগামী বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন।’

jagonews24

তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত শুল্কহার ৯০ দিনের জন্য মুলতবি করা হয়েছিল, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৯ জুলাই। এরপর কী হবে, সে বিষয়ে আমরা এখনো অনিশ্চয়তায় রয়েছি। অন্যদিকে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা হচ্ছে। যদি নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক কোনো অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তাহলে তা ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

আগামী দিনের সম্ভাব্য এ অনিশ্চয়তা দেশের রপ্তানি খাতকে প্রভাবিত করতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘রপ্তানির বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে অবশ্যই বন্দরের সক্ষমতা বাড়িয়ে লিড টাইম কমাতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট দ্রুত সমাধান করতে হবে। এসব বিষয়ে বিলম্ব হলে রপ্তানি খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’

যে কারণে জুনে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি

সামগ্রিক রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকলেও সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অস্থিরতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত শুল্কহার ৯০ দিনের জন্য মুলতবি করা হয়েছিল, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৯ জুলাই। এরপর কী হবে, সে বিষয়ে আমরা এখনো অনিশ্চয়তায় রয়েছি।- ড. জাহিদ হোসেন

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে বাংলাদেশ ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ কম।

বাধা পেরিয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে, প্রত্যাশা ছুঁতে পারেনি প্রবৃদ্ধি

 

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, গত জুনের প্রথম সপ্তাহে ঈদুল আজহায় দীর্ঘ ছুটির কারণে পণ্য রপ্তানি হয়নি। আবার মাসের শেষ দিকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে ২৬ ও ২৭ জুন আমদানি-রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ ছিল। মূলত, এ দুই কারণে জুনে পণ্য রপ্তানি কমেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পোশাক রপ্তানিকারক জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুনের শেষ ভাগে পণ্য চালান দিতে আমাকে নানান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কারণ, এনবিআরের কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিলেন। এমনকি কিছু পণ্য সময়মতো পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছি। যেগুলো এখন জুলাইতে পাঠাতে হচ্ছে—এজন্য ক্রেতাকে ছাড়ও দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমার মতো অনেক রপ্তানিকারকই একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক রপ্তানির ওপর। শেষ পর্যন্ত রপ্তানি আয় দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি।’

আরও পড়ুন

‘আশা করি আগামী দিনগুলোতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হবে না। সমস্যা থাকতেই পারে, তবে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত—অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত করে বা রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়’- যোগ করেন এ রপ্তানিকারক।

প্রধান প্রধান খাতগুলোর রপ্তানি

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৯৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের ৯৬৪ মিলিয়নের তুলনায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪৪২ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।

বাধা পেরিয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে, প্রত্যাশা ছুঁতে পারেনি প্রবৃদ্ধি

 

২০২৪-২৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, আর প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি আয় ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৪ মিলিয়ন ডলারে।

বিদায়ী অর্থবছরে চামড়ার তৈরি জুতা রপ্তানিতে ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের ৫৪৪ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭২ মিলিয়ন ডলার। তবে চামড়াজাত অন্য পণ্যের রপ্তানি ২ দশমিক ২১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫৪ মিলিয়ন ডলারে। এছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ৪ দশমিক ১০ শতাংশ কমে ৮২০ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে।

নন-লেদার ফুটওয়্যার, যা দেশের একটি উদীয়মান খাত হিসেবে বিবেচিত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানিতে এ খাত ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ৫২৩ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪১৭ মিলিয়ন ডলার। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে ফার্মাসিউটিক্যালস খাত থেকে রপ্তানি আয় ৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৩ মিলিয়ন ডলারে।

আইএইচও/এমকেআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।