বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে ‘মিডা’
মাতারবাড়ী প্রকল্পের গ্রাফিক ডিজাইন/ছবি সংগৃহীত
দেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগ (মিডা) গঠন করেছে সরকার। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সভাপতি আশিক চৌধুরীকে চেয়ারম্যান এবং কমোডর তানজিম ফারুক ও সারওয়ার আলমকে সদস্য করে নতুন যাত্রা শুরু করেছে মিডা।
এর আওতায় লজিস্টিকস, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, উৎপাদনশিল্প এবং মৎস্যশিল্পকে একসঙ্গে আনা হবে। অর্থাৎ, গভীর সমুদ্রবন্দর সুবিধাকে জ্বালানি টার্মিনাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে—যেন শিল্পগুলো তাদের জ্বালানির উৎসের কাছে থেকে লজিস্টিকস সুবিধা নিয়ে পরিচালিত হতে পারে।
মিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যপত্র তুলে ধরেন। পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন তিনি।
আশিক চৌধুরী বলেন, কিছু প্রতিযোগিতামূলক কারণে মাতারবাড়ী-মহেশখালী অঞ্চলকে বহুমুখী প্রকল্পের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গভীরতা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি, উৎপাদন ও ভারী শিল্প, সামুদ্রিক ও মৎস্যশিল্পের সমন্বিত ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত জমি, আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনে সরাসরি প্রবেশাধিকার কাজে লাগিয়ে একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা—এগুলোই প্রতিযোগিতা বাড়ানো ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার মূল লক্ষ্য। এর সফল বাস্তবায়নে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) এক সমীক্ষার বরাতে তিনি জানান, আগামী ২০-৩০ বছরে এ অঞ্চলে ৬০-৬৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হতে পারে। এরমধ্যে প্রায় ৪৭-৪৮ বিলিয়ন ডলার আসবে বেসরকারি খাত থেকে; যার ১০ শতাংশ (প্রায় ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) হবে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)।
আরও পড়ুন
- ৩০ বছরে বিনিয়োগ ৬৫ বিলিয়ন ডলার, কাজের সুযোগ হবে ২৫ লাখ মানুষের
- মহেশখালী-মাতারবাড়ীতে নতুন শহরের জন্ম হবে: প্রধান উপদেষ্টা
- মাতারবাড়ী-মহেশখালীকে সাংহাই-সিঙ্গাপুরের মতো দেখতে চাই
এতে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার সংযোজন হবে। যার মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫ বিলিয়ন ডলার সরাসরি প্রভাব রাখবে। এ প্রকল্প ঘিরে দীর্ঘমেয়াদে প্রায় দেড় লাখ প্রত্যক্ষ ও ২৫ লাখ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ অঞ্চল কক্সবাজারের আঞ্চলিক অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উপাদানে পরিণত হবে এবং পর্যটকের সংখ্যা দেড়গুণ বাড়বে।
এ প্রকল্প ঘিরে আগামী ২০-৩০ বছরে এ অঞ্চলে ৬০-৬৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে প্রায় দেড় লাখ প্রত্যক্ষ ও ২৫ লাখ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ অঞ্চল কক্সবাজারের আঞ্চলিক অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উপাদানে পরিণত হবে এবং পর্যটকের সংখ্যা দেড়গুণ বাড়বে।- জাইকার সমীক্ষা
মূলত গভীর সমুদ্রবন্দর ও লজিস্টিকস, উৎপাদনশিল্প, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং মাছ ধরা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ—এ চারটি মূল খাতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে এ হাব। এ চারটি স্তম্ভকে সমর্থন দেবে সড়ক, রেল সংযোগ, টাউনশিপসহ সহায়ক অবকাঠামো। ভৌগোলিক সুবিধাকে অর্থবহভাবে কাজে লাগাতে এ স্তম্ভগুলোর পোর্টফোলিও নিয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা ও পরামর্শ চলছে।
বন্দর ও লজিস্টিকস
প্রথম স্তম্ভটি হলো গভীর সমুদ্রবন্দর ও সংশ্লিষ্ট লজিস্টিকস ব্যবস্থা। এ অংশে এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে যেন একসঙ্গে বাল্ক কার্গো ও কনটেইনার সামলানো যায়, যা বাংলাদেশের বর্তমান কোনো বন্দর পারে না।
মাতারবাড়ী বন্দর প্রাকৃতিকভাবে প্রায় ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর, যেখানে বড় জাহাজ সরাসরি ভিড়তে পারবে। এটি চট্টগ্রামের তুলনায় বড় পরিবর্তন, যেখানে ছোট জাহাজ ও একাধিক ধাপে পণ্য স্থানান্তর করতে হয়।
এসব পরিবর্তনের ফলে আগামী ৩০ বছরে বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে প্রায় ৫০ শতাংশ। প্রাকৃতিক গভীরতার সুবিধায় মাতারবাড়ী দেশের মোট বাল্ক ট্রাফিকের প্রায় ২৫ শতাংশ এবং কনটেইনার ট্রাফিকের ৪৫ শতাংশ সামলাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখানে খরচ সাশ্রয় অন্য জরুরি পণ্যের দামে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবহন খরচ কমে ১২ কেজির একটি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম প্রায় ৫০ টাকা কমতে পারে।

এ সংখ্যাগুলো ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে—যেমন কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন, চার লেনের সড়ক সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় ইন্টারমডাল কনটেইনার ইয়ার্ড ও ঢাকা পর্যন্ত ডাবল লাইন রেল সংযোগ ইত্যাদি উন্নয়ন। পাশাপাশি, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ পুনর্ব্যবহার ও ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাবনাও বিবেচনা করা হচ্ছে।
উৎপাদনশিল্প
গভীর সমুদ্রবন্দর বাল্ক ও কনটেইনার পণ্যে খরচ প্রতিযোগিতা এনে দিচ্ছে। তাই এর সঙ্গে উৎপাদন শিল্পকেন্দ্র গড়ে তোলা স্বাভাবিক। মাতারবাড়ী বন্দর দিয়ে শিল্পজাত পণ্যের বড় পরিমাণ বাণিজ্য হবে, যা উৎপাদনশিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ করবে।
তিন ধাপের মূল্যায়নের পর ৯টি উপযুক্ত শিল্প চিহ্নিত করা হয়েছে—যেমন ইস্পাত, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিকস ইত্যাদি। এছাড়া, রপ্তানি বৈচিত্র্যের জন্য ফার্মাসিউটিক্যালস ও এপিআই, সিন্থেটিক ফাইবার এবং জাহাজ নির্মাণকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদে এখানে প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক লেনদেন সাশ্রয় হতে পারে। গভীর সমুদ্রবন্দর লজিস্টিকস ও বিদ্যুৎ সুবিধার প্যাকেজ দিয়ে সঠিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এ হাব আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশের উৎপাদনশিল্পে প্রায় ১০ শতাংশ অবদান রাখবে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ
বিদ্যুতের চাহিদা বছরে গড়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আমদানিনির্ভর এবং বৈশ্বিক মূল্য ওঠানামার ঝুঁকিতে থাকায় দীর্ঘমেয়াদে ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ চাহিদা নিজস্বভাবে মেটাতে চায়। এজন্য একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা হয়েছে।
প্রচলিত ও নতুন বিদ্যুৎসূত্রের মিশ্রণ এখানে তৈরি করা হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর ও জমির প্রাপ্যতার সুবিধায় এ হাব বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানির জন্য স্বাভাবিক পছন্দে পরিণত হয়েছে। এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এ হাব বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির ৮০ শতাংশ এবং এলপিজি আমদানির ৬০ শতাংশ মেটাতে পারবে।
৩০ বছরে বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে প্রায় ৫০ শতাংশ। প্রাকৃতিক গভীরতার সুবিধায় মাতারবাড়ী দেশের মোট বাল্ক ট্রাফিকের প্রায় ২৫ শতাংশ এবং কনটেইনার ট্রাফিকের ৪৫ শতাংশ সামলাবে
মাতারবাড়ী-মহেশখালী এলাকা হয়ে উঠতে পারে দেশের জ্বালানি আমদানির প্রধান কেন্দ্র। বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম, অয়েল এবং লুব্রিকেন্টস (পিইএল) পরিশোধনের সুযোগও রয়েছে, যা আমদানিনির্ভরতা কমাবে। প্রস্তাবিত ৮ থেকে ১০ এমটিপিএ ক্ষমতা আগামী ৩০ বছরে মোট চাহিদার প্রায় ৩৫ শতাংশ পূরণ করবে। এতে আমদানি-রপ্তানির লজিস্টিকসে ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়বে।
মৎস্য আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ
গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ—যা এখনো বাংলাদেশে বড় পরিসরে অনাবিষ্কৃত। অথচ, এটি একটি বহু বিলিয়ন ডলারের বাজার। বিশ্বের প্রায় ৭ শতাংশ মাছ বঙ্গোপসাগর থেকে আসে এবং এর ওপর নির্ভরশীল ৪৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ। বর্তমানে মাত্র ১০০ মিটার গভীরতায় কারিগরি নৌকা ও ট্রলারের মাধ্যমে মাছ ধরা হয়।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) সদস্য, যার ফলে ভারত মহাসাগরের নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট কোটায় টুনা মাছ ধরার অনুমতি রয়েছে। অথচ, কোনো বছরই কোটা পূরণ হয় না। এ সমস্যার সমাধান ও গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণকে উৎসাহিত করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২৮টি লংলাইনার ফিশিং ভেসেল তৈরি বা আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
মাতারবাড়ী বন্দর চকরিয়া চিংড়ি শিল্পসহ বিদ্যমান (এবং নতুন) উদ্যোগকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ইত্যাদিতে দ্রুত রপ্তানির সুযোগ দেবে। এতে প্রক্রিয়াকরণ সময় ও খরচ কমবে এবং ভ্যালু-অ্যাডেড রপ্তানি যেমন- ফিলে, স্মোকড ফিশ, রেডি-টু-ইট সি-ফুড ইত্যাদির সুযোগ তৈরি হবে। উদাহরণস্বরূপ, স্ক্যালপ প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানির সম্ভাব্য বাজার ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা মিডার শক্তিশালী লজিস্টিকসের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন বৈদেশিক বিনিয়োগের ঢেউ আনতে পারে।
রোডম্যাপ
মূল শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে দীর্ঘমেয়াদি ভিশনকে তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে—ইনকিউবেশন, এক্সপ্যানশন ও ডাইভারসিফিকেশন। চলতি বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ১২০ দিনের কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এর শক্তিশালী সূচনা হবে।
১০টিরও বেশি সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এ বছরের চতুর্থ প্রান্তিকের শেষ নাগাদ মিডার মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপকে বাস্তবে রূপ দেবে, যা মিডাকে একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করতে সাহায্য করবে।
এমইউ/এমকেআর/এমএস