ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

বলছেন বিশ্লেষকরা

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৯:২৩ পিএম, ০২ অক্টোবর ২০২৫

দক্ষ মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। যখন কোনো দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা যায়, তখন তারা প্রাকৃতিক ও মূলধনী সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে পারে। যা বেকারত্ব দূর করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনীতিকে টেকসই ও শক্তিশালী করে তোলে।

এমনটিই বলছেন বিশ্লেষকরা। তবে তাদের মতে, বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে বস্তুগত সম্পদের চেয়ে মেধাসম্পদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই অর্থনীতির প্রতিটি খাতের জন্য মেধাভিত্তিক মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক বিশ্বে মেধাভিত্তিক সম্পদ যাদের বেশি রয়েছে তারা কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবাসহ সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে। যার কারণে অনেক শিল্পোন্নত দেশের কৃষি উৎপাদন কৃষিভিত্তিক দেশের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ৩৭ শতাংশ অবদান রাখছে মেধাভিত্তিক সম্পদ। বর্তমানে চীন ও ভারত মেধাভিত্তিক সম্পদ গড়ে তোলার জন্য জাতীয় পর্যায়ে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে বেশ খানিকটা পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং যুগোপযোগী করা দরকার।

বিশ্লেষকরা জানান, দেশে মানবসম্পদের ৯০ শতাংশই এখনো কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। তাদের যদি মেধাভিত্তিক সম্পদে পরিণত করা যায়, তাহলে সত্যিকার টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এজন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আমূল পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। যদিও দেশে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সৃজনশীলতা বাড়ানোর কোনো সংযোগ নেই। যার কারণে উচ্চশিক্ষার হার বাড়লেও মেধাবী মানবসম্পদের পরিমাণ বাড়ছে না।

তাদের অভিমত, বাংলাদেশে ডিজিটাল রূপান্তরে যাওয়ার পথে বড় বাধা ও কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- আধুনিক প্রযুক্তি ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল তৈরি না হওয়া, শিক্ষাব্যবস্থাকে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর অভাব, সঠিক দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের অভাব, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ এবং বেকারত্ব। এছাড়া মেধাভিত্তিক সম্পদ তৈরি ও শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ার প্রয়োজনীয়তাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে রয়েছে প্রচলিত ও বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে
মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ (বাঁ থেকে) এম মাসরুর রিয়াজ, ফজলে শামীম এহসান ও সাকিফ শামীম/ছবি: সংগৃহীত

এসব চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সরকারি-বেসরকারি খাতে সমন্বিত উদ্যোগ, বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে ১৫-২০ বছরের জন্য কর্মকৌশল নির্ধারণ, কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু এবং একটি স্থায়ী আন্তমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘দক্ষ মানবসম্পদ ও কর্মসংস্থান টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলছি কিন্তু সেভাবে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারছি না। মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক খাতে হচ্ছে, অথচ এ খাতে আরও ভ্যালু যোগ হতে পারে।’

তিনি জানান, রপ্তানির প্রধান প্রধান খাতগুলো চিহ্নিত করে সেখানে দক্ষ জনবল সরবরাহ করতে হবে। এজন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে বৈশ্বিক চাহিদা মাথায় রেখেই ১৫-২০ বছরের জন্য কর্মকৌশল নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন।

মাসরুরের মতে, দক্ষতা নেই এমন মানবসম্পদ বেকারত্ব বাড়বে। আর একদিকে অর্থনীতির যা প্রয়োজন তা হলো নতুন খাত বা খাতের আধুনিকায়ন। সুতরাং দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া কর্মসংস্থান সম্ভব না। টেকসই এবং অর্থনৈতিক উপকারীতামুখী কর্মসংস্থান দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া সম্ভব না।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি আয় পোশাক খাত নির্ভর হয়ে পড়েছে, এর পেছনেও দক্ষ মানবসম্পদ একটি বড় কারণ। অন্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য যে ধরনের দক্ষ কর্মীবাহিনী দরকার সেটি যথেষ্ট পরিমাণে নেই।’

বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী আমরা লোকবল পাই না। অথচ পোশাকসহ সব খাতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল প্রয়োজন। এই সংকট উত্তরণে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যারা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে চাকরিতে প্রবেশ করতে চান তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আবার এখন শিল্পকারখানাসহ সর্বক্ষেত্রে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। এ অবস্থায় অদক্ষ জনবল আরও অযোগ্য হয়ে পড়বেন। এ কারণে আমরা প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছি।’

শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, স্নাতক-স্নাতকোত্তর বা শুধু সনদধারী শিক্ষিত না হয়ে কর্মমুখী শিক্ষা নিয়ে চাকরির বাজারে নিজেকে যোগ্য করে তুলুন। বেকারত্ব দূরীকরণ এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী করতে অবশ্যই দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। দেশে এখন সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশকিছু উদ্যোগ থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। আরও বেশি তৎপরতা ও বাস্তবমুখী কর্মসূচি নিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।

ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশাল জনশক্তির একটি বড় অংশ এখনো কাঙ্ক্ষিত দক্ষতার স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। বৈশ্বিক শ্রমবাজারের তুলনায় আমাদের শ্রমের উৎপাদনশীলতা তুলনামূলকভাবে কম থাকায় প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখাটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সুতরাং, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কেবল গতিশীল রাখাই নয়, বরং একে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। সর্বক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এটা সত্য, এমন অনেক চাকরিপ্রার্থী আমরা পাই যারা ভালোভাবে বাংলাও বলতে পারেন না।’

আরও পড়ুন
জাপানের সঙ্গে ইপিএ চলতি বছরই, খুলবে সম্ভাবনার দ্বার
মালয়েশিয়া: জনশক্তি রপ্তানিতে ৪০ কোটি টাকা প্রতারণা, ১৪ জনের নামে মামলা
বাংলাদেশি শ্রমিকরা আধুনিক মালয়েশিয়ার নীরব নায়ক: তুন্কু হামজাহ

তিনি জানান, বর্তমানে এআই, অ্যাডভান্সড রোবটিক্স, ব্লকচেইন এবং গ্রিন টেকনোলজির মতো উচ্চ-মূল্য সংযোজনকারী খাতগুলোতে বিশেষজ্ঞ কর্মীর তীব্র অভাব রয়েছে। দেশের অর্থনীতি যখন কৃষি-নির্ভরতা থেকে উৎপাদন এবং সেবা খাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে (যা জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ৫৩ শতাংশ অবদান রাখে), তখন এ খাতগুলোতে দক্ষতা বৃদ্ধি ছাড়া টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, তৈরি পোশাক শিল্পে, যা দেশের রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়লেও মধ্যম ও উচ্চ স্তরের ব্যবস্থাপকীয় ও কারিগরি পদগুলোতে প্রায়ই বিদেশি কর্মীর ওপর নির্ভর করতে হয়। যা দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে নিয়ে যায়। এ নির্ভরতা কমাতে হলে টিভিইটি (কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ) এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলামকে অত্যাধুনিক শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী ‘রিয়েল-টাইম’ আপডেটেড করার জন্য একটি স্থায়ী আন্তমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের পর থেকে কর্মক্ষম জনসংখ্যার আনুপাতিক হার কমতে শুরু করবে। এ সময়সীমার মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের লক্ষ্য পূরণে এই সুযোগ কাজে লাগানোর কৌশলগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সাকিফের মতে, শিল্পকারখানার চাহিদা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে এফবিসিসিআই প্রতিষ্ঠিত এফবিসিসিআই বিজনেস স্কুল এবং এফবিসিসিআই এন্টারপ্রেনারশিপ সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষতা উন্নয়নে শিল্পকে সরাসরি যুক্ত করার পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যা কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল ও টেকসই করবে। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা কাজে লাগানোর এই শেষ সুযোগে দক্ষতা ও কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে একটি সুদূরপ্রসারী জাতীয় এজেন্ডা অনুসরণ করা অপরিহার্য।

তিনি বলেন, নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে তাৎক্ষণিকভাবে একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ স্থাপন করা, যা রিয়েল-টাইমে দেশীয় শিল্প ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চাহিদা বিশ্লেষণ করবে এবং সেই অনুযায়ী টিভিইটি কারিকুলাম ও বিনিয়োগের খাত নির্বাচন করবে। পাশাপাশি টিভিইটি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিল্পের অংশগ্রহণে বাস্তব-ভিত্তিক শিক্ষানবিশ কর্মসূচি চালু করে এবং আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন মানদণ্ড (যেমন-আইএসও) অনুসরণ করে টিভিইটির গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে।

সাকিফ আরও বলেন, নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে এসএমইর (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) আনুষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। যা কর্মীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করবে এবং প্রবৃদ্ধিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবে। এই তথ্য-চালিত পদ্ধতি এবং কৌশলগত নীতি সংস্কারের মাধ্যমেই বাংলাদেশ বর্তমান জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা থেকে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক লভ্যাংশ আহরণ করতে সক্ষম হবে এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি সুদৃঢ় হবে। এ সুযোগ হাতছাড়া হলে, ভবিষ্যতে বিশাল অদক্ষ কর্মক্ষম জনশক্তির বোঝা দেশের অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।

এমএএস/একিউএফ/জেআইএম