জাপানের সঙ্গে ইপিএ চলতি বছরই, খুলবে সম্ভাবনার দ্বার

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:২৬ পিএম, ০২ অক্টোবর ২০২৫
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) চলতি বছরই সম্ভব হবে বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দুই দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল করবে এই ইপিএ। এটি বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দেবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি বা ইপিএ হলো দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য এলাকা বা এফটিএ তৈরির পরিকল্পনা। মুক্ত বাণিজ্য এলাকায় বিভিন্ন বাণিজ্যে বাধা, আমদানি কোটা, শুল্ক কমাতে এবং একে অন্যের সঙ্গে পণ্য ও পরিষেবার বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য এ ধরনের চুক্তি দুটি দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখে।

এ চুক্তির জন্য ২০১৫ সালে যৌথ সমীক্ষা শুরু হয়েছিল। জাপানের সঙ্গে ইপিএ করতে গত ৩ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর দরকষাকষি শেষ করেছে বাংলাদেশ। জাপানের রাজধানী টোকিওতে ওই আলোচনা হয়।

আরও পড়ুন
ইপিএ বাস্তবায়নে বিকেএমইএর সহযোগিতা চায় জাপান
নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে বিনা খরচে কর্মী নেবে জাপান
বছরের শেষদিকে হবে বাংলাদেশ-জাপান ইপিএ চুক্তি
টোকিওতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরলো বেপজা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ অনুবিভাগের যুগ্মসচিব ফিরোজ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘১০ দিনের আলোচনায় আমাদের নেগোসিয়েশন হয়ে গেছে। এখন দুই দেশের কিছু অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম বাকি। এরপর শিগগির চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে।’

এর আগে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছিলেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগামী বছরের নভেম্বরের মধ্যে জাপানসহ আরও বেশ কিছু দেশ ও জোটের সঙ্গে ইপিএ, এফটিএসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করার প্রক্রিয়া চলছে। জাপানের বিষয়টি এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।

জাপানের সঙ্গে ইপিএ এ বছরই, খুলবে সম্ভাবনার দ্বার

ইপিএর জন্য এখন পর্যন্ত জাপানের সঙ্গে দরকষাকষির সাত দফা আলোচনা করেছে বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাপানের সঙ্গে সর্বপ্রথম ইপিএ করতে চায় সরকার। বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত কোনো দেশের সঙ্গে ইপিএ কিংবা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নেই।

আরও পড়ুন
‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে জাপানের আরও বিনিয়োগ চান প্রধান উপদেষ্টা
জাপানের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দেবে
জাপানে রপ্তানি ৪৫ শতাংশ বেড়েছে: বাণিজ্য সচিব
ভাষা জানলে জাপানে কাজের অভাব নেই

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির মাধ্যমে দেশ দুটির মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের পরিকল্পনা নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উভয় দেশ লাভবান হয়। জাপানের সঙ্গে চুক্তি হলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে। বহু আগে থেকে বাংলাদেশের বন্ধু দেশ হিসেবে জাপান নানান ভূমিকা রেখেছে। দুই দেশের সম্পর্কও স্বচ্ছ এবং বিশ্বাসের। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে আমদানি ছিল ১ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ও রপ্তানি ১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের জন্য ১২তম বৃহত্তম বাজার জাপান।

অর্থাৎ জাপান-বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানির মধ্যে অল্প বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। রপ্তানিতে এর পরিমাণ ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানিতে ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার, যা ইপিএর মাধ্যমে খুব সহজে দূর করা সম্ভব। মূলত ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাওয়ার পরও শুল্ক সুবিধা ধরে রাখতে এ চুক্তি প্রয়োজন।

ইপিএ না হলে ২০২৬ সালের পর পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ১৮ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে পণ্য রপ্তানিকালে শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা হারালে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণভাবে আরোপিত শুল্কের সম্মুখীন হতে হবে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার সংকোচনের শঙ্কা তৈরি হবে। তাই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দেশগুলোর কাছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে শুল্ক সুবিধা নিতে হলে ইপিএ চুক্তির বিকল্প নেই। সেটা না হলে বাণিজ্যে সুবিধা হারিয়ে প্রতিটি আমদানি পণ্যের অতিরিক্ত খরচের কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে।

আরও পড়ুন
জাপান-বাংলাদেশের অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জাইকা
জাপানে শিক্ষাবৃত্তি ও বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে জাপানের আগ্রহ প্রকাশ
জাপান বাংলাদেশের জন্য একটি অমিত সম্ভাবনার বাজার

জাপান-বাংলাদেশ চুক্তির মধ্যে পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় ছাড়াও বাণিজ্য সহজীকরণ, বিনিয়োগ এবং ইলেকট্রনিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পণ্য বাণিজ্য, বাণিজ্য প্রতিকার, রুলস অব অরিজিন, কাস্টমস প্রসিডিউর অ্যান্ড ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন, স্যানিটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানিটারি, শ্রম, স্বচ্ছতা, মেধাস্বত্ব ও ই-কমার্সসহ ১৭টি খাতের রূপরেখা চূড়ান্ত হয়েছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, এ দেশে নির্মাণ, টেক্সটাইল, সার, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামসহ বিভিন্ন খাতে জাপানের বিনিয়োগ এরই মধ্যে ৫০৭ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তবে জাপানের বৈদেশিক বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ১৮৪ বিলিয়ন ডলার হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য আরও বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ রয়েছে। এ ইপিএ তারই একটি পদক্ষেপ।

জাপানের সঙ্গে ইপিএ এ বছরই, খুলবে সম্ভাবনার দ্বার

এছাড়া দুই দেশ চুক্তি করলে মেশিনারি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামো, লজিস্টিকস ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে জাপানের প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া সহজ হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, বস্ত্র এবং চামড়াজাত পণ্যের বাজার আরও প্রসারিত হবে। ওই দেশে জনশক্তি রপ্তানি করা যাবে। পাশাপাশি ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং খাদ্যশিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি জাপানের
এনডিসিতে জাপানের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা কৌশল
জাপানে ৩০০০ শিক্ষার্থী ভাষা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন: প্রেস সচিব
ওষুধখাতে দক্ষতা বাড়াতে বাংলাদেশ-জাপান যৌথ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশের বহু সুবিধা অর্জিত হতে পারে। এই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য নতুন বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করবে এবং রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হওয়ার ফলে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত হবে।

এর মাধ্যমে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। প্রযুক্তি হস্তান্তর ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়বে। পাশাপাশি, বাণিজ্য ভারসাম্য উন্নত হবে এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

সার্বিকভাবে, এই চুক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল ও বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পটভূমিতে যা বাংলাদেশের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে অসাধারণ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।

গত মে মাসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরের সময় বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৩০ মে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। 

ওই বৈঠকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করছে। সম্পর্ক আরও গভীর করতে দুই বন্ধুপ্রতিম দেশ চলতি বছরের শেষ নাগাদ একটি অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) সম্পন্ন করবে, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক হবে।

এনএইচ/এমএমএআর/এমএফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।