ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

পণ্যের মানের আওতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন

নাজমুল হুসাইন | প্রকাশিত: ১১:১০ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশে পণ্য বা সেবার সুনির্দিষ্ট মান নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি কেমন- এ প্রশ্নের জবাবে ভোক্তার কাছে সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া দুরূহ। কারণ পণ্যের প্রত্যাশিত মান বা সেবা না পেলে বেশিরভাগ ভোক্তাই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন। নকল ও নিম্নমানের পণ্য ও সেবায় প্রতারিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে আহরহ। 

এদিকে দেশে হাজার হাজার পণ্য থাকলেও বাধ্যতামূলক মানসনদ আছে মাত্র ৩১৫টির। পণ্যের মানের আওতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশে পণ্য, সেবা বা প্রক্রিয়ার মান নির্ধারণ করে থাকে একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। মান প্রণয়নের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির কাজ হলো পণ্যের গুণাগুণ পরীক্ষা, বাধ্যতামূলক মানসনদের আওতাভুক্ত পণ্যগুলো পরীক্ষার পর সনদ দেওয়া ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সার্টিফিকেট দেওয়া। পাশাপাশি যেসব পণ্যের মানসনদ দেওয়া হয়েছে সেগুলো নিয়মিত তদারকি করা, পণ্য সংক্রান্ত ম্যাট্রিক পদ্ধতির প্রচলন, বাস্তবায়নসহ ওজন ও পরিমাপের সঠিকতা তদারকি করা। মানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ফোকাল পয়েন্ট হিসেবেও বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্ব করে এই সংস্থাটি।

মানের আওতায় মাত্র ৩১৫টি পণ্য

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যের সম্ভার যেভাবে বাড়ছে, তাতে পণ্যের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। শুধু খাদ্যপণ্যের সংখ্যায়ই হাজার ছাড়াবে। সব মিলিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রকৃত সংখ্যা অনেক। সেগুলো বাধ্যতামূলক মানসনদের আওতায় না থাকায় অথবা কোনো মান না থাকায় উৎপাদনের সময় যত্রতত্র উপাদান ব্যবহার হয়, যা ভোক্তার জন্য ক্ষতিকর। যেখানে দেশে হাজার হাজার পণ্য সেখানে বর্তমানে বাধ্যতামূলক মানসনদের আওতাভুক্ত পণ্য রয়েছে ৩১৫টি। এরমধ্যে খাদ্যপণ্য ১১৫টি, ক্যেমিক্যাল ৭৫টি, যন্ত্র ৪৪টি, পাট ও বস্ত্র পণ্য ৩১টি, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য রয়েছে ৫০টি।

এদিকে, যেসব পণ্যের মান বাধ্যতামূলক করতে পারছে না বিএসটিআই, যেগুলোর মান তৈরি করছে তারা। সংস্থাটি বলছে, এখন প্রণীত মানের সংখ্যা সাড়ে চার হাজার, যেখানে খাদ্যপণ্য ৬৯১টি।

আরও পড়ুন:
ভোক্তার মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া নিশ্চিতে কাজ করছে বিএসটিআই
বিএসটিআইর অযৌক্তিক সার্টিফিকেশন মার্ক ফি, ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা
বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড না থাকায় বিপদে কোম্পানি

অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিএসটিআই চার দশকে সাড়ে চার হাজারের মতো পণ্যের মান নির্ধারণ করতে পেরেছে। যার মধ্যে মাত্র ৩১৫টি পণ্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাকি পণ্যগুলো স্বেচ্ছামূলক পণ্য হিসেবে সনদ দেওয়া হয়েছে।

যেভাবে নির্ধারণ হয় পণ্যের মান

বিএসটিআই পণ্যের মান নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন (আইএসও) মান অনুসরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের (এফএও) দেওয়া নীতিমালাও অনুসরণ করে থাকে। কোডেক্স হলো মূলত খাদ্যপণ্য সংশ্লিষ্ট। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেশি পণ্যের জন্য এসব নীতিমালা সামঞ্জস্য না হওয়ায় মান প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রতা হয় বলে দাবি সংস্থাটির।

বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মান প্রণয়নের জন্য আমরা যেসব আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করি অনেক সময় সে ধরনের পণ্যের মান আমরা আইএসও বা কোডেক্সেও পাই না। যেমন ধরুন, ঝালমুড়ি কিংবা একটি স্থানীয় যন্ত্র, যা অন্য কোনো দেশে নেই। তখন সেসব পণ্যের মান নিয়ে আমরা সমস্যায় পড়ি। দীর্ঘসূত্রতা হয়।’

দেশে হাজারো পণ্য, বাধ্যতামূলক মানসনদ আছে মাত্র ৩১৫টির

তিনি বলেন, ‘আইএসও পুরো পৃথিবীর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে একটি মান নির্ধারণ করে। কিন্তু বিএসটিআই আবহাওয়া, ক্রেতাসহ এ দেশের অনেক বিষয় বিচার–বিশ্লেষণ করে সেগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পারে না। তাই সব পণ্যের আইএসও মান মেনে চলা যায় না। মান তৈরি করতেও সময় লাগে।’

মান প্রণয়ন কমিটি নামে বিএসটিআইয়ের একটি পৃথক কমিটি আছে। এই প্রতিষ্ঠানে প্রণীত সাড়ে চার হাজার মানের অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক মানের আলোকে প্রণীত হয়েছে। এ মান প্রণয়ন কমিটি দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ওইসব আন্তর্জাতিক মানকে বাংলাদেশি মান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ওইসব মানের ওপর ভিত্তি করে কিছু পণ্যকে বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতায় আনা হয়।

নজরদারি দুর্বল, বলছে ক্যাব

পণ্যের মান ও বাধ্যতামূলক মানের আওতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন সাধারণ ভোক্তা ও পণ্য সংশ্লিষ্টরা। তবে তাদের বক্তব্য, শুধু মান প্রণয়ন কিংবা বাধ্যতামূলক মান সনদ দিলেই হবে না, সেই সঙ্গে ওই মান সনদ সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তার নজরদারিও বাড়াতে হবে। তা না হলে মান নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

আরও পড়ুন:
বিএসটিআইয়ে হালাল পণ্যের প্রদর্শনীতে প্রাণসহ ১০ প্রতিষ্ঠান
আরও ১৬ পণ্যকে মান সনদের আওতাভুক্ত করেছে বিএসটিআই
পণ্য পরীক্ষা ছাড়াই বন্দর খালাসে সাময়িক ছাড়পত্র দেবে বিএসটিআই

ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মান প্রণয়ন ও মান বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে আমরা খুবই পিছিয়ে আছি। যে কারণে নিম্নমানের পণ্য ও নকল-ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব। পণ্যের মানের আওতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।’

‘পাশাপাশি তারা যেসব পণ্যের মান দিচ্ছে বা বাধ্যতামূলক করেছে, সেগুলো সার্ভিলেন্স খুব দুর্বল। পরবর্তী সময় সেগুলোর মানও ঠিকঠাক দেখা হচ্ছে না। মান নিয়ন্ত্রণের মূল কাজটিই হলো, ভোক্তারা যেন প্রতারিত না হন, প্রবঞ্চিত না হন এবং সঠিক জিনিসটি ক্রয় করতে পারেন সেটা দেখা। যা বিএসটিআইয়ের সঠিক তদারকির অভাবে ঠিকমতো হচ্ছে না।’ বলেন নাজের হোসাইন।

তবে বিএসটিআইয়ের দাবি, বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত যেসব পণ্যের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে পরবর্তী নজরদারি ব্যবস্থা চালু আছে। বাজার ও কারখানাভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থাও চালু আছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমও চলে। সে ক্ষেত্রে কেউ সঠিক মান প্রয়োগে ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া থেকে শুরু করে লাইসেন্স বাতিলসহ বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

‘ফুড সেফটি প্যারামিটার’ চালু হচ্ছে

যেহেতু ক্রমবর্ধমান খাদ্যপণ্যের সঙ্গে মান প্রণয়ন ও বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত পণ্য বাড়ানোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সে কারণে সব খাদ্যপণ্যের জন্য ফুড সেফটি প্যারামিটার করছে বিএসটিআই।

দেশে হাজারো পণ্য, বাধ্যতামূলক মানসনদ আছে মাত্র ৩১৫টির

ফুড সেফটি প্যারামিটারগুলো খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের প্রতিটি ধাপে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পরিমাপক, যেমন, তাপমাত্রা, পিএইচ, আর্দ্রতার পরিমাণ, রাসায়নিক উপাদান (যেমন কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ, তেলের গুণমান) এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্য (যেমন রঙ, গঠন, গন্ধ) পরীক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রা। এই প্যারামিটারগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে খাদ্যকে ভোক্তা পর্যন্ত নিরাপদ রাখা যাবে।

আরও পড়ুন:
বিএসটিআই সনদ না থাকায় আইসক্রিম ও বেকারি ফ্যাক্টরিকে জরিমানা
আজ বিশ্ব মান দিবস

বিএসটিআইয়ের পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ প্যারামিটার হলে সব খাদ্যপণ্যের সঠিক মান পাওয়া যাবে। এরমধ্যে কৃষি, মৎস্য, দুগ্ধ থেকে শুরু করে সব খাদ্যপণ্যের সব উপাদানের সেফটি প্যারামিটার থাকবে। এটির কার্যক্রম এরইমধ্যে শুরু কয়েছে।

এর আগে প্রসাধনীর জন্য একটি সেফটি প্যারামিটার করে বিএসটিআই।

বিশ্ব মান দিবস আজ

পণ্য ও সেবার মানের বিষয়ে ভোক্তাদের সচেতন করতে প্রতি বছর ১৪ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব মান দিবস পালিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে বিএসটিআই বেশ কিছু কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। ৫৬তম বিশ্ব মান দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘সমন্বিত উদ্যোগে টেকসই উন্নত বিশ্ব বির্নিমাণে-মান’।

এনএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/এএসএম