নির্বাচনি বছরে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি ব্যাংকখাত
২০২৬ সালেও অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে পারে ব্যাংকখাত
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরবর্তী চাপ এবং ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের বোঝা— সব মিলিয়ে দেশের আর্থিক ব্যবস্থা চরম ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, নির্বাচনি বছর ২০২৬ সালে কি ব্যাংকখাত স্থিতিশীল নাকি আরও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবে।
ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে তারল্য সংকট, অনিয়ম, দুর্বল প্রশাসন ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আমানতকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কয়েকটি ব্যাংক উচ্চসুদের প্রলোভন দিয়ে আমানত সংগ্রহ করলেও সেই অর্থ কার্যকরভাবে বিনিয়োগ করতে না পারায় সুদ পরিশোধের চাপই শেষ পর্যন্ত নতুন সংকট তৈরি করছে। বর্তমানে মানুষ নতুন করে সঞ্চয় গড়ছে না বরং প্রয়োজন মেটাতে আগের সঞ্চয় ভেঙে ব্যয় করছে। ফলে এ অবস্থায় টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অর্জন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ
ব্যাংকখাতের সবচেয়ে বড় ও গভীর সংকট হিসেবে ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকখাতে মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকখাতে মোট ঋণস্থিতি ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এক বছর আগে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে।

দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং বাজেট ব্যয় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বৈঠক, ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন:
অর্ধেকের বেশি খেলাপি ঋণ ১৭ ব্যাংকে, ছয়টির অবস্থা ভয়াবহ
২৪ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা
ব্যাংকখাত সংস্কারের উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ?
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার চিত্র এক নয়। সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ২৩টির খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। অন্যদিকে, ১৩টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে, আটটি ব্যাংকের ২০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও ১৭টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
‘ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করে বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রাহকদের মুনাফা দেয়। এ প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে শুধু আমানত সংগ্রহে জোর দেওয়া ব্যাংকের জন্য উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।’ —আরিফ হোসেন খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র
আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, ৯০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকের সংখ্যা ছয়টি। এর মধ্যে সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বিদেশি মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। ব্যাংকটির মোট ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৮৪ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি।
এছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ১১৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ ৫৯ হাজার ৯৮৮ কোটি, অর্থাৎ মোট ঋণের ৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ১৪ হাজার ১৪ কোটি বা ৯৫ দশমিক ৭০ শতাংশ ঋণ এরইমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯৪ দশমিক ১৭ এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৯১ দশমিক ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
আরও পড়ুন:
বেশি সুদে আমানত টানছে দুর্বল ব্যাংক, বাড়ছে ঝুঁকি
‘গলার কাঁটা’ খেলাপি ঋণ, ৫ বছরে বেড়েছে ৪ লাখ কোটি টাকা
ব্যাংক খাত নিয়ে অস্বস্তিতে সরকার
বিশ্লেষকদের মতে, যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, সেগুলো পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্যই বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
ব্যাংকের সামগ্রিক চিত্র
২০২৫ সালের জুন মাসের শেষে দেশে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৩১ হাজার ১১৯ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে ব্যাংকখাতে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। তবে এ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বিনিয়োগের চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। চলতি বছরের অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৩ শতাংশে, যেখানে সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এক বছর আগে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি, ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। ফলে একদিকে আমানত বাড়লেও অন্যদিকে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার প্রবণতাকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে ‘বর্তমান ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ: ঋণগ্রহীতাদের দৃষ্টিকোণ’ শীর্ষক সেমিনার, ছবি: জাগো নিউজ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, সাধারণভাবে ব্যাংকে আমানত বাড়লে গ্রাহকদের সুদ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সেই অর্থ যদি বিনিয়োগে ব্যবহার করা না যায় এবং অলস অবস্থায় রেখে সুদ দিতে হয়, তাহলে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। কারণ ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করে তা বিনিয়োগের মাধ্যমে আয় করে গ্রাহকদের মুনাফা দেয়। এ প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে শুধু আমানত সংগ্রহে জোর দেওয়া ব্যাংকের জন্য উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
‘অর্থনীতির বড় শত্রু অনিশ্চয়তা। মানুষ যদি নিশ্চিত থাকে যে তাদের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হবে না, তবে অর্থনীতি সচল থাকতে পারে। কিন্তু অনিশ্চয়তা থাকলে কোনো উদ্যোগই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।’ —অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুল বায়েস
বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কেন থমকে আছে?
অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুল বায়েস বলেন, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, দেশীয় চাহিদা এবং রপ্তানিসহ অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো বর্তমানে নিম্নমুখী। যদিও মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তবে বিনিয়োগ ও ভোগব্যয় কম থাকায় সেই রিজার্ভ কার্যকর চাহিদা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না।
আরও পড়ুন:
মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ ব্যাংক খাত, অর্থনীতিতে অশনিসংকেত
ব্যাংক খাতে আস্থা ফেরাতে আংশিকভাবে সফল হয়েছি: গভর্নর
লুটপাট হলে দায় ওই ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিতে হবে: গভর্নর
তিনি আরও বলেন, যারা ঋণখেলাপি হয়েছেন, তারা সাধারণত আর্থিকভাবে দুর্বল নন বরং তারা দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে উল্লেখযোগ্য সম্পদ গড়ে তুলেছেন। প্রয়োজন হলে তারা আরও বড় সম্পদ কেনার সক্ষমতাও রাখেন, অথচ ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে আগ্রহী নন।
আব্দুল বায়েসের ভাষ্যমতে, অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু হলো অনিশ্চয়তা। মানুষ যদি নিশ্চিত থাকে যে তাদের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হবে না, তবে অর্থনীতি সচল থাকতে পারে। কিন্তু অনিশ্চয়তা বিরাজ করলে কোনো উদ্যোগই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
নির্বাচন ও অনিশ্চয়তার প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। সামনে কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

১৫ বছরে ব্যাংক খাতে লোপাট ৯২ হাজার কোটি টাকা: সিপিডি, ছবি: জাগো নিউজ
তাদের মতে, নির্বাচন না থাকার চেয়ে দুর্বল নির্বাচনও তুলনামূলকভাবে ভালো, কারণ অন্তত একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
ড. বায়েস বলেন, ‘অনিশ্চয়তা কাটানোর একমাত্র পথ হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।’ তার মতে, ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনও নির্বাচন না থাকার চেয়ে ভালো, কারণ একটি নির্বাচিত সরকার থাকলে মানুষ অন্তত জানবে, আগামী পাঁচ বছরে দেশ কোন পথে এগোতে পারে।
ইসলামী ব্যাংক ও সংস্কারের প্রশ্ন
চলমান সংস্কার কার্যক্রমে কিছু অগ্রগতি দেখা গেলেও তা এখনো পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকগুলো, যার মধ্যে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক রয়েছে, কীভাবে পরিচালিত হবে, গ্রাহকদের আস্থা কীভাবে ধরে রাখা যাবে এবং বিনিয়োগ বাড়ানো আদৌ সম্ভব হবে কি না- এসব বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।
২০২৬ সালে কি সংকট আরও বাড়বে?
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৬ সাল ব্যাংকখাতের জন্য হবে এক ধরনের রূপান্তরকাল। স্বল্পমেয়াদে খেলাপি ঋণের চাপ কমার সম্ভাবনা কম, কারণ অনেক ঋণই পুরোপুরি আদায়যোগ্য নয়। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও গড়ে উঠবে না। তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, কার্যকর সংস্কার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা গেলে ২০২৬ সাল সংকট কাটিয়ে ওঠার প্রস্তুতির বছর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এ বিষয়ে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ এম. হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, শুধু আর্থিক খাত নয়, সামগ্রিকভাবেই দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তবে আশার বিষয় হলো, ব্যাংকখাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রমে কিছু অগ্রগতি দৃশ্যমান।
তার মতে, গত কয়েক বছরে তারল্য সংকট, অনিয়ম ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে আমানতকারীদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং খেলাপি ঋণ (এনপিএল) বাড়তে থাকায় ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ২০২৬ সালের মধ্যে ব্যাংকখাত পুরোপুরি সংকটমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বজায় রাখা, চলমান সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে এগোনো সম্ভব।
২০২৬ সাল হবে ব্যাংকখাতের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার সময়। সঠিক নীতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে আস্থা ফিরতে পারে, আর তা না হলে খেলাপি ঋণ ও অনিশ্চয়তা ব্যাংক ব্যবস্থাকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ড. বায়েসও মনে করেন, নতুন বছরটি ব্যাংকখাতের জন্য পুরোপুরি সংকটমুক্ত হবে না। ব্যাংকখাতে সৃষ্ট ক্ষত পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
ইএআর/এসএনআর/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম