বই আলোচনা
চরিত্রহীন: মানবমনের গভীর উপলব্ধি
রেনেসাঁ জান্নাত
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয় এবং অপরাজেয় কথাশিল্পী হিসেবে পরিচিত ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। যিনি উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের প্রথমদিকে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁর লেখনীতে স্থান পেয়েছে গ্রাম ও শহরের বাঙালি পরিবার ও সমাজের জীবন। যা তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, মানব মনোবিজ্ঞানের গভীর উপলব্ধি, সহানুভূতি এবং সরল ও স্বাভাবিক লিখনশৈলীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
‘চরিত্রহীন’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আলোচিত ও যুগ যুগ ধরে বিতর্কিত হওয়া শরৎচন্দ্রের একটি উপন্যাস। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের দ্বন্দ্ব নিয়ে এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক অনন্য মানবিক চিত্র তুলে ধরেছেন। সতীশ, সাবিত্রী, কিরণময়ী ও উপেন্দ্র–এই চারটি চরিত্রের মাধ্যমে সম্পর্কের জটিলতা, সমাজের শাসন এবং নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির অদ্ভুত রূপ প্রকাশিত হয়েছে।
‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের মূল চরিত্র উপেন্দ্র–যার চারপাশেই আবর্তিত হয় টানাপোড়েন, প্রেম, দায়িত্ববোধ আর আত্মত্যাগের। কিরণময়ীর প্রতি তার নির্লিপ্ত, নির্বাক ভালোবাসা ও সতীশ-সাবিত্রী সম্পর্কের প্রতি তার আত্মবিসর্জন মিশ্র মনস্তত্ত্বের গভীরতা প্রকাশ করে। উপন্যাসটি সমাজের ভণ্ডামি, নারী-পুরুষের চরিত্র বিচার, মানবিকতার শক্তি ও দুর্বলতাকে গভীরভাবে তুলে ধরে। কিছু চরিত্রের জটিল সম্পর্কের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন—সমাজ যাকে ‘চরিত্রহীন’ বলে দোষারোপ করে, বাস্তবে সে অনেক সময়ই পরিস্থিতির শিকার এবং ভেতরে ভীষণ মানবিক।
উপন্যাসটি আবেগ, দ্বন্দ্ব, প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সামাজিক বাস্তবতার কারণে আজও সমান পাঠযোগ্য। শরৎচন্দ্রের লেখা যাদের পছন্দ; তারা ‘চরিত্রহীন’ দারুণভাবে উপভোগ করতে পারবেন।
আরও পড়ুন
মীরার গ্রামের বাড়ি: অনন্য পারিবারিক উপন্যাস
গাভী বিত্তান্ত: প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের মনস্তাত্ত্বিক দলিল
উপন্যাসের ভালো লাগার মতো কিছু উক্তি দেখে নিই:
>> শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা দাঁড়াতে পারে না।
>> সমাজ যে স্ত্রীকে তাঁর সম্মানের আসনটি দেয় না, কোন স্বামীরই ত সাধ্য নেই নিজের জোরে সেই আসনটি তার বজায় করে রাখেন।
>> যাহাকে ভালোবাসি, সে যদি ভালো না বাসে, এমন কি ঘৃণাও করে, তাও বোধ করি সহ্য হয়; কিন্তু যদি সে ভালো না বেসে আমাকে ঘৃণা করে তবে তা কিছুতেই সহ্য হয় না।
>> যেদিন বুঝবে রূপটাও মানুষের ছায়া, মানুষ নয় সেদিনই শুধু ভালোবাসার সন্ধান পাবে।
>> ধুঁয়া যেমন একটুখানি রন্ধ্রের সাহায্যে সমস্ত ঘর নিমিষে ব্যাপ্ত করিয়া ঘোলা করিয়া দেয়, তেমনি করিয়া একটিমাত্র নিষ্ফলতার ক্ষুদ্র দ্বার ধরিয়া নৈরাশ্যের গাঢ় অন্ধকারে তাহার সমস্ত মন পরিপূর্ণ হইয়া গেল।
>> সন্তান-ধারণের জন্য যে-সমস্ত লক্ষণ সবচেয়ে উপযোগী তাই নারীর রূপ। সমস্ত জগতের সাহিত্যে, কাব্যে এই বর্ণনাই তার রূপের বর্ণনা।
>> বুড়ো মানুষের কাছে কোনো যুক্তিই যুক্তি নয়। তাদের নিজের প্রয়োজনের বেশি সংসারে আর কিছু তারা দেখতেই পান না।
উপন্যাসটিতে চারটি নারী চরিত্র আছে। প্রধান দুটি নারী চরিত্রের নাম সাবিত্রী ও কিরণময়ী। ছোট দুটি নারী চরিত্রের নাম সুরবালা ও সরোজিনী। মূলত শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে কাহিনি নয়, চরিত্রই মুখ্য। তিনি চরিত্রবিকাশের প্রয়োজন অনুযায়ী কাহিনিকে সাজিয়ে তোলেন। কাহিনির নিপাট পারম্পর্যের নিটোল বুননকে রক্ষা করে চরিত্র নির্মাণ করেন না। ফলে তাঁর উপন্যাসে প্রায়ই ঘটনাপ্রবাহে নানা রকম অসংগতি বা অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়।
কাহিনির পূর্বাপর সংস্থাপন প্রসঙ্গে পাঠক মনে তৈরি হয় বিভিন্ন প্রশ্ন। ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানেও দেখা যায় ঔপন্যাসিক চরিত্রের প্রয়োজনেই কাহিনিকে সাজিয়েছেন, কাহিনির প্রয়োজনে চরিত্রের আমদানি ঘটাননি। জীবনদর্শন যে কোনো উপন্যাসেরই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চরিত্র বিচারে সমাজের প্রচলিত রটনানির্ভর মূল্যায়নের অযৌক্তিকতা এবং অন্তঃসারশূন্যতা প্রতিপাদন করাই ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের মূল সুর বা মেসেজ। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে জীবন ও জগতের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে। আশা করি উপন্যাসটি সবারই ভালো লাগবে।
বই: চরিত্রহীন
লেখক: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশনী: দূরবীণ
মূল্য: ৩৫০ টাকা।
এসইউ