ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

বই আলোচনা

পাপ ও পদ্মের পিঞ্জর: কৃষিজীবী জীবনের আখ্যান

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৪১ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

বঙ্গ রাখাল

কয়েকদিন ধরে পড়ছি কবি নাসির জুয়েলের কবিতা। তার কাব্যগ্রন্থ ‘পাপ ও পদ্মের পিঞ্জর’ পড়ে অন্যরকম স্বাদ পেয়েছি। তার কবিতায় রয়েছে লোকজ জীবন-যাপন আর প্রান্তিক গ্রামীণ মানুষের জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, হাহাকার-কষ্ট আর না-পাওয়ার বেদনা। গ্রামীণ-সংস্কৃতির বড় ধারা লোকসংস্কৃতি। যা হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হয়ে আসছে। কৃষি কেন্দ্রিক হাজারো উৎসব সমাজে বিরাজমান। আমাদের বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ। সেটিও কৃষিকে উপজীব্য করেই গড়ে উঠেছে। চৈত্রসংক্রান্তিও কৃষি কেন্দ্রিক উৎসব। আমরা ইচ্ছে করলেই আমাদের সংস্কৃতিকে জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি না। গ্রামীণ উৎসব বা লোকউৎসব হাজার বছরের সংস্কৃতিরই প্রতিফলিত রূপ। হাজার বছরের এই যে সম্প্রীতিময় সংস্কৃতির বিশাল স্থান দখল করে আছে লোকসংগীত। সেই লোকসংগীত সৃষ্টি করেছেন আউল-বাউল আর লোক কবি শিল্পীরা।

পুঁথিপাঠ, গাজীর গান, বিচারগান বা পালাগান কিংবা অন্যান্য গানের প্রথমেও বন্দনাসংগীত হয়। সেই বন্দনাসংগীত দিয়ে কবি তার কাব্যগ্রন্থ শুরু করেছেন। তাহলে পড়া যাক কবির কবিতা—
‌‘দক্ষিণে বন্দনা করি পাবক মাহেন্দ্র
উত্তরে বাও গাও সেতলা মন্ত্র।
পুবেতে দিরাং মাত সোনার প্রতিমা
অঞ্চলে বান্দি রাখিস কালা মনুয়া।
পশ্চিমে ছোঁয়াও কাঠি মরা ভানুশ্বরে
চন্দ্র আসুক নামি চন্দ্রেরো ঘরে।’ (বন্দনাভাষ)

কবি নাসির জুয়েলের কাব্যগ্রন্থের দিকে দৃষ্টিপাত করলে পাই—কবি কাব্যগ্রন্থকে তিনটি অংশে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগ ‘পদ্মার পলিস্তুতি’, দ্বিতীয় ভাগ ‘মাটির মদে ডুবল যে পা’ এবং তৃতীয় ভাগ ‘পাপ ও পদ্মের পিঞ্জর’। প্রথম ভাগের কবিতায় পদ্মায় যে পলি জমে তার স্তুতি বা বন্দনা ও কৃষকজীবনের নানা সংকট তুলে ধরেছেন। কেননা আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। তাদের জীবন কৃষিকেন্দ্রিক। যে জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে কৃষির নানা উপসর্গ। যত আনন্দোৎসব হয়; তাও কৃষিকে কেন্দ্র করেই। পদ্মায় যখন পলি জমে; তখন কৃষকেরা খুব খুশি হন। কারণ তারা মনে করেন, পলি জমলে ফসল ভালো হবে। যে কারণে তারা সব সময় পলির বন্দনা করে থাকেন। কৃষকের প্রধান হাতিয়ার লাঙল-জোয়াল আর বীজ। ফসলের ওপরই তাদের জীবন নির্ভর করে। চর্যাপদ কিংবা সহজিয়ার বিস্তৃত ক্যানভাসেও কৃষি ও কৃষক। এই জন্যই কবি বলেন—
‘...এসো ভাই, লাঙলের গান করি
আজ মাটি সম্বল মানুষের উৎসব। (আদি নিয়ম)

কবির কিছু কবিতা পাঠ করলে সহজেই অনুমান করতে পারবেন তার প্রধান প্রধান ঝোক বা প্রবণতা। যেগুলোকে আশ্রয় করে কবি চলতে চান এবং সাধনা করেন। কবি শত শাপে নিজের জীবনকে জর্জড়িত করে তুলেছেন। একদিন কবির সবকিছু থাকলেও সে সবকিছু থেকে দূরে এক পাথর সময় পার করছেন। ভুলতে পারেন না শিমুল, বকুল, কৃষ্ণচূড়াকে। সেই দিন যেন আজ সোনার খাঁচায় বাঁধা। কবি পৃথিবীতে অসহায় এক কাঙাল মন নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কৃষিজীবী মানুষেদের বহু সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। চাষ করতে গিয়ে খরা, বন্যা, ঝড় হলে ঘরে ফসল উঠবে না। কৃষকের গোলা খালি থাকবে। তাদের জীবন কাটাতে হবে না খেয়ে। পেট ভুক পড়ে থাকবে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাদের অভিমান হয়; তখন তারা বলে—‘মোরা কি মানুষ নই, কও দেহি আল্লা’। গরিবের হাহাকার কেউ শোনেন না। কেউ জানতেও চান না তার কষ্টের কারণ। সন্তানদের কী করে মা ভোলাবেন, তাই উনুনে জল দিয়ে বসে আছেন। সেসব গ্রামীণ চিত্র আর অন্নহীনের কষ্টের কথা, কৃষকজীবনের নানাচিত্র কবিতার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।

আমাদের জীবন কাদা-মাটির জীবন। কথাটা কৃষকদের কাছে বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সত্য। তাদের জীবনটা শুরু হয় মাঠের কাজ দিয়ে। আমরা যদি একটু পিতা কিংবা প্রপিতামহের দিকে ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাই যে আমাদের পিতারা সকাল না হতেই লাঙল-জোয়াল এবং গরু নিয়ে জমি চাষের জন্য মাঠে চলে যেতেন। সকালে কেউ কেউ পান্তা ভাত, পেঁয়াজ কিংবা মরিচ দিয়ে খেয়ে গেছেন। আবার বেলা হওয়ার সাথে সাথে কেউ তাদের ভাত মাঠে নিয়ে যেতেন বা তিনি বাড়িতে এসেও খেতেন। সেই প্রাচীন স্মৃতি কাব্যগ্রন্থ পাঠে ফিরে পাওয়া যায়। কবি এখানে সার্থক হয়ে উঠেছেন। পলির মাটিতে এই মানুষেরা কাজ করেন; জীবিকা নির্বাহ করেন। নানা বিপদ তাদের পিছু ছাড়ে না। তাই কৃষি লোকাচারও অধিক ফসল ফলার জন্য করে থাকেন। যেমন কুমারি কোনো নারীকে জমির আইলে স্নান করালে ফসল ভালো হয়, এমন অনেক লোকাচার তারা পালন করেন। ফসল ঘরে না আসা পর্যন্ত শঙ্কা কাটে না। বন্যা প্রতিবছর শস্য নষ্ট করে দেয়; তখন সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়। ফসল ওঠার সাথে সাথে নানা উৎসব করে থাকেন। তাদের জীবনই সংগ্রামময়। এ জীবনে নানা আনন্দ আর উৎসবের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। এ মাটিতেই তাদের আদিপিতার ঘামের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তারা পরিশ্রম করে যে শরীরের ঘাম ঝরাতেন, তার ঘ্রাণ আজ তাদের পরবর্তী প্রজন্মের লোকজন পেয়ে থাকে। এ দুঃখময় জীবনেও তাদের মধ্যে প্রেম আসে। পদ্মায় যখন জল আসে; তখন খরস্রোতা হয়ে ওঠে। যাকে একদিন সবাই ভালোবেসে মনে প্রেম জাগিয়ে তুলেছিল; তা আজ মৃত্যু ডেকে এনেছে। তারা আজ মাটির গান গায়, আজ তারা কাস্তের গান করে। কবির ভাষায়—
‘এসো কন্যা মাটির বন্দনা করি
আজ আমাদের মাটি উৎসব
এসো কুমার শস্যের গান করি
আজ আমাদের শস্য উৎসব
এসো ভাই কাস্তের গান করি
আজ মাটিসম্বল মানুষের উৎসব। (নতুন নিয়ম)

আরও পড়ুন
বেদনার জায়নামাজ: জীবনের গভীর জিজ্ঞাসা 
জলবায়ু কন্যা: পরিবেশের জ্ঞানভান্ডার 

কবি তার কবিতা দিয়ে অস্তিত্বের কথা বা শেকড়ের কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তিনি নাড়ীপোতা গ্রাম কিংবা দেশকে অস্বীকার করেননি। আধুনিকতার ছোঁয়ায়ও মেকি জীবনের জয়গান করেননি। ফিরে এসেছেন পৈতৃকভিটায়। সেখানকার জীবনের কথা তিনি বলার চেষ্টা করেছেন। সেই নাগ নাগেশ্বর, নারকেল বেলের মফস্বলকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মানুষ নাড়ীপোতা ইতিহাস একদিন আবিষ্কার করে ফেলেন। যে কারণে কবি বলতে পারেন—‘মানুষেরা জেনে যায় জন্মের গোপন জল’। আসলে মানুষের কাছে একপর্যায় অজানা বলে আর কিছুই থাকে না। আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর, প্রভু বলতে যাকে বোঝায়; তিনি সবার ত্রাণকর্তা। একজন গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষের অনুযোগ-অভিযোগ আকুতি শোনার বা বলার একমাত্র জায়গা তার কাছে। তাছাড়া কেউ শোনার নেই। প্রভুর কাছে বলে তারা প্রশান্তি পায়। যে কারণে পিতারা বা প্রপিতামহ পাথর কেটে জল এনে কৃষি শুরু করলেও নিজের অজান্তে হাত উঠে যায় তার প্রতি। কবি সেই সত্যতাকেই বলছেন—
‘আমাদের পিতা-প্রপিতামহ
এই পাথর খুঁড়ে জল এনেছিল একদিন...
ফুল নেই, শয্যা নেই, সুন্দর নেই
তবু কামিন শরীরগুলো হাত মেলে আছে আসমানে।’ (মাটির মদে ডুবল যে পা)

মানুষের চোখের ভাষায় সবাই বুঝে ফেলেন সে সুখী না দুঃখী। এই চোখের ভাষা বড় কঠিন। দেশের চাষির দিকে তাকালেই দেখতে পাই—তাদের হাড় ঝিরঝির শরীর আর চাপা ভাঙা মুখ। তবুও তারা মনে সুখ সঞ্চয় করে এবং দুঃখ লুকিয়ে সবার জন্য সুখ কেনার জন্য ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু আজ চুরি যায় মাঠে আমাদের জ্যোৎস্না সব। এই কৃষি সভ্যতার পতনের জন্য আমরাই দায়ী।

কবি বলেছেন—
‘মৃৃত্যু মানে
মধুর ধুলোয় তোমার
আর কোনো গল্প নেই।’
মৃত্যু এক অন্ধকারের নাম। যার মধ্য দিয়ে কোনো কিছুর সমাপ্তি। মৃত্যুটা আমাদের কাছে ভীতিকর বিষয়। মানুষের অবসরের পরেই জীবনের গল্প শেষ। ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় ধরা। পৃথিবী সবুজে ভরে যায়—মানুষ হারিয়ে যায় গভীর হতে গভীরে। এই জমিনের চাষি একজন সাধকরূপী কৃষক।

কবিতা কবিকে নানাভাবে উপস্থাপন করে থাকে। সাহসী কুমার বুক থেকে মধু নিয়ে ফিরে গেলেও বারবার ফিরে আসতেই হবে। এ ফেরার মধ্য দিয়েই কবি তার কৃষি এবং তার উপাদেয় শস্যকে নানাভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। কবির ভাষায়—
‘কুমারীর বুক থেকে মধু নিয়ে ফের ফিরে যায়
সাহসী কুমার; ঘাটে আসে বান। নাওয়ের
গলুই ধরে কেঁদে ওঠে মাঝি’

কবির কবিতা বলার ঢং পাঠককে কবিতার ভেতরে নিমগ্ন করতে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলেছে। কবির মাটি কেন্দ্রিক জীবন-যাপন হওয়া উচিত। সেই মাটি আর মায়ের কথা নাসির জুয়েলের কবিতার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে। যা আমাদের অতীত ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের জীবনে বা সভ্যতা সৃষ্টিতে যাদের অবদান; তাদের যেন কখনো ভুলে না যাই। এই কৃষি কেন্দ্রিক কবিতায় মিথ, পুরাণ কিংবা লোকজ উপাদানই যেন প্রধান হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। যা প্রকৃতি ও মানুষের গভীর সম্পর্কে শ্রেষ্ঠত্বকেই তুলে ধরে।

বই: পাপ ও পদ্মের পিঞ্জর
কবি: নাসির জুয়েল
প্রকাশনী: অনুভব প্রকাশনী
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: আইয়ুব আল আমিন
মূল্য: ৩০০ টাকা।

এসইউ

আরও পড়ুন