বিশ্ব সাইকেল দিবস
এখনো গ্রামীণ জীবনে অনেকের ভরসা সাইকেল

সানজানা রহমান যুথী
সবুজ ধানের মাঠ, কাঁচা-পাকা রাস্তাঘাট, মেঠো হাওয়া আর মাটির ঘ্রাণে গড়া যে চিরচেনা গ্রামবাংলা, সেখানে এখনো একটি চেনা দৃশ্য চোখে পড়ে একজন কাঁধে স্কুলব্যাগ, গায়ে হালকা ধুলোর ছাপ, দু’পায়ে দৃঢ় ভর দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তার বিশ্বস্ত সঙ্গী, একটি বাইসাইকেল। শুধু সে নয়, পাশে দেখা যাবে একজন কৃষক যাচ্ছেন হাটে, পেছনে একটা ঝুড়িতে সবজি। এমন দৃশ্য যেন আজও বলে গ্রামে এখনো বাইসাইকেলই জীবনযাত্রার একটি অপরিহার্য অংশ।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
যেখানে শহরের মানুষ ট্রাফিক জ্যামে বিরক্ত হয়ে প্রাইভেট কার বা বাইকের পেছনে সময় আর জ্বালানি নষ্ট করে, সেখানে গ্রামের মানুষ জীবনের প্রয়োজনেই নির্ভর করেন বাইসাইকেলের উপর। এটি যেন এক নিরব সঙ্গী, যা প্রতিদিনের যাত্রায় সাহচর্য দেয় অগণিত মানুষকে।
গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে সীমিত। প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেলের মালিক হওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাছাড়া গ্রামের রাস্তাঘাট সবসময় মোটর যানবাহনের উপযোগীও নয়। সেখানে সবচেয়ে কার্যকর আর সহজলভ্য সমাধান সাইকেল।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
একটি সাইকেল মানেই এক ব্যক্তির স্বাধীন চলাচল। সেটা হতে পারে স্কুলে যাওয়া শিক্ষার্থী, বাজারে যাওয়া কৃষক, কিংবা গ্রামের কাছের কোন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ।
বাইসাইকেল অনেকটা পরিবারেরই সদস্য হয়ে যায়। বিয়েবাড়ি যাওয়া থেকে শুরু করে জমিতে কীটনাশক পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত প্রায় সব কিছুতেই তার ব্যবহার। একজন কৃষক তার বাইসাইকেলে শুধু নিজের শরীরটাই নয়, জীবনের দায়িত্বটুকুও বয়ে নিয়ে চলে।
বিজ্ঞাপন
বাইসাইকেল চালাতে না লাগে তেল, না লাগে লাইসেন্স। রক্ষণাবেক্ষণও কম খরচের। একজন দিনমজুরের বা কৃষকের পক্ষেও এটি একবার কিনে বহু বছর ব্যবহার করা সম্ভব। স্কুল পড়ুয়াদের জন্য যাতায়াতে সবচেয়ে সুবিধা এই সাইকেল। এই সাশ্রয়ী দিকটি গ্রামের মানুষের কাছে সাইকেলকে করে তুলেছে আরও গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশবান্ধব বলেও এর কদর কম নয়। যেখানে পরিবেশ দূষণ ও জ্বালানি সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ, সেখানে বাইসাইকেল চালিয়ে এক অর্থে গ্রামীণ মানুষই পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রেখে চলেছেন অবচেতনে হলেও।
বিশেষ করে গ্রামে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবনে বাইসাইকেল একটা বড় ভূমিকা রাখে। অনেক গ্রামে এখনো মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনেক দূরত্বে। প্রতিদিন সেই পথ পাড়ি দিতে বাইসাইকেল ছাড়া ভরসা নেই। হেঁটে যাওয়া যেমন কষ্টকর, তেমনি সময়সাপেক্ষও। একটি বাইসাইকেল মানেই সময় বাঁচানো, ক্লান্তি কমানো, এমনকি স্কুলে পৌঁছানোর আগ্রহটাও বাড়িয়ে দেওয়া।
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন সময়ে সরকার গ্রামীণ ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে সাইকেল বিতরণ করেছে। এতে স্কুলে উপস্থিতির হার যেমন বেড়েছে, তেমনি মেয়েদের আত্মবিশ্বাসও। একজন ছাত্রী জানে, তার স্বাধীন চলাফেরার একটি হাতিয়ার রয়েছে তা হলো তার নিজের বাইসাইকেল।
সাইকেল শুধু এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়ার বাহন নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু চলাচলের মাধ্যম নয়, এক ধরনের অর্জনও বটে। যখন কেউ নিজের উপার্জনে একটি বাইসাইকেল কেনে, সেটা তার জন্য গর্বের ব্যাপার। অনেকটা যেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রথম ধাপ।
সাইকেল কিনতে গিয়ে কেউ হয়তো গরুর দুধ বিক্রি করেছে, কেউ টিউশনি করে পয়সা জমিয়েছে। বাইসাইকেলটি তখন তার কাছে একটা আবেগ, একটা গল্প। তবে সবকিছুর মাঝেও সমস্যা থেকে যায়। গ্রামের অনেক রাস্তা এখনো চলাচলের উপযোগী নয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কোথাও কাদামাটি, কোথাও আবার উঁচু-নিচু পথ। এসব রাস্তায় বাইসাইকেল চালানো যেমন কঠিন, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও।
বিজ্ঞাপন
আরেকটি সমস্যা হলো বাইসাইকেল চুরি। যেহেতু অনেকের একমাত্র যানবাহন এটি, তাই চুরি হলে মানুষ কার্যত চলাচল বন্ধ করে দেয়। রক্ষণাবেক্ষণের খরচও কিছুটা বেড়েছে, বিশেষ করে যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধির কারণে।
সব সমস্যার মাঝেও বাইসাইকেল যেন গ্রামের মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী। হাঁটতে না চাইলে বাইসাইকেলই ভরসা। হঠাৎ কিছু দরকার হলে বাইসাইকেলই সঙ্গে নেওয়া হয়। কেউ অসুস্থ হলে, ঔষধ আনতে বাইসাইকেলই ছোটে বাজারে। এমনকি গ্রামে কোনো অনুষ্ঠানে যেতে যখন যানবাহন মেলে না, তখন পেছনে একজনকে বসিয়ে যাত্রা শুরু হয় সেই সাইকেলেই। যার দাম কম হলেও গ্ৰামের মানুষের কাছে এর কিন্তু মূল্য অসীম।
বিশ্ব বাইসাইকেল দিবসে যখন শহরে রোড শো হয়, বাইক র্যালি হয়, তখন গ্রামে এসব আয়োজন হয় না বটে, কিন্তু সাইকেলের গুরুত্ব সেখানে অনেক গভীর, অনেক বাস্তব। শহরে এটি হয়তো এখন ফিটনেসের প্রতীক, হবি বা স্টাইল স্টেটমেন্ট। কিন্তু গ্রামে, এটি এখনো জীবনযাত্রার অপরিহার্য অংশ একটি লাইফলাইন। সাইকেল হয়তো কথা বলে না, কিন্তু সে গ্রামবাংলার প্রতিদিনের চলাফেরার গল্প বলে নিরবে, অবিরত।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
কেএসকে/এমএস
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন