গাছের ভাষায় প্রকৃতির পাঠশালা

ভাবুনতো এমন এক পাঠশালা, যেখানে নেই কোনো খাতা-কলম, নেই পরীক্ষার চাপ বা শ্রেণিকক্ষের চার দেয়াল। তাহলে কেমন হয়! ঠিক এমনই এক পাঠশালার সন্ধান মিলেছে সিরাজগঞ্জে। যেখানে শিক্ষার্থীরা শেখে গাছের পাতা গোনা, মাটির গন্ধ শোঁকা, বাতাসে কান পেতে প্রকৃতির ভাষা বোঝা। এই পাঠশালায় বইয়ের বদলে গাছই শিক্ষক, আর প্রকৃতিই পাঠ্যবিষয়।
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট গ্রামে গড়ে ওঠা এ পাঠশালার নাম ‘পরিবেশ ও প্রকৃতির পাঠশালা’। পাঠশালাটি গড়ে তুলেছেন বৃক্ষপ্রেমী মাহবুবুল ইসলাম পলাশ। এই ব্যতিক্রমী শিক্ষালয় কেবল প্রকৃতিকে জানা বা গাছ লাগানোই নয়। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃতি-সচেতন, দায়িত্বশীল ও মানবিক করে গড়ে তোলার এক আত্মবিশ্বাসী প্রয়াস।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
প্রকৃতির পাঠশালা শুরুর গল্প
মাহবুবুল ইসলাম পলাশ একজন পরিচিত বৃক্ষপ্রেমী। তিনি ২০০০ সাল থেকেই বৃক্ষরোপণ, বিরল প্রজাতির গাছ সংরক্ষণ ও বিনামূল্যে গাছ বিতরণ করে আসছিলেন। তার শুরুর সেই ছোট্ট প্রচেষ্টাই সময়ের সঙ্গে রূপ নিয়েছে এক পরিপূর্ণ আন্দোলনে। পরে তার এই আন্দোলনের সঙ্গে যোগ হয় এই পাঠশালা।
২০২০ সাল। পুরো পৃথিবী তখন মহামারি করোনার আতঙ্কে থমকে গেছে। ঠিক তখনই পলাশ শুরু করলেন একটি নিরীক্ষাধর্মী কাজ। মাত্র ৪ থেকে ৫ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে তার নিজস্ব গাছে ভরা বাগানে শুরু করলেন প্রকৃতির পাঠশালা। উদ্দেশ্য ছিল শিশুরা প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে উঠুক, গাছকে ভালোবাসুক, আর পরিবেশের প্রতি তাদের মধ্যে গড়ে উঠুক সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে সবুজ গবেষণাগারে ৭০ শিক্ষার্থী। পলাশের পাঠশালা মাত্র ৪-৫ জন দিয়ে শুরু হলেও আজ সেই পাঠশালার শিক্ষার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০ থেকে ৮০ জনে। শুধু তাই না, বয়সের কোনো বাধা নেই এখানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই তার প্রকৃতির পাঠশালার ছাত্র। তাদের শেখানো হয় কীভাবে গাছের যত্ন নিতে হয়, কীভাবে একটি বৃক্ষ পরিবেশে ভূমিকা রাখে এবং কীভাবে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা গাছের জন্ম, বৃদ্ধি, রোগ-বালাই, পরিচর্যার প্রক্রিয়া সবকিছু হাতে-কলমে শিখে নেয়।
বিজ্ঞাপন
পাঠশালাটি পরিচালিত হচ্ছে পলাশের নিজের হাতে গড়া ৪ হাজার গাছের বাগানে। আর এ বাগানে রয়েছে ৩৪৫ প্রজাতির গাছ। এদের মধ্যে অনেক গাছই বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল প্রজাতির। যেমন গুটগুটিয়া, রক্তন, রাতা, তুন, বৈলাম, সিভিট, মাল্লাম, বাজনা, মনিরাজ, সুন্দরী কাকড়া, বরুন, গরান, চাপালিশ ইত্যাদি।
পলাশের সবুজ সংগ্রাম
মাহবুবুল ইসলাম পলাশ এখন পর্যন্ত বিনামূল্যে প্রায় ৫০ হাজার গাছ রোপণ ও বিতরণ করেছেন। পরিচালনা করছেন সিরাজগঞ্জের প্রথম জিরা চাষ, গড়ে তুলেছেন ‘বিরল বৃক্ষ ও নবান্ন কৃষি খামার’ নামের একটি সফল কৃষি উদ্যোগ।
তার সংগ্রহে রয়েছে ৪৫টির বেশি বিলুপ্তপ্রায় গাছ, যেগুলোর অনেকগুলোই সরকারি নথিতে ‘লুপ্তপ্রায়’ হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু তার প্রচেষ্টায় এসব গাছ এখন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে, বেড়ে উঠছে সুস্থভাবে।
বিজ্ঞাপন
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে মাহবুবুল ইসলাম পলাশ বলেন, ‘আমি ৬৪ জেলায় বৃক্ষরোপণের লক্ষ্যে কাজ করছি, এরইমধ্যে ১৩টি জেলায় সম্পন্ন হয়েছে। আমি চাই, একদিন গড়ে তুলবো একটি কৃষি জাদুঘর এবং গাছের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগার, যাতে এসব গাছ নিয়ে গবেষণা হয়, নতুন প্রজন্ম আরও শিখতে পারে।’
কেএসকে/এএসএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন