প্রকৃতির ঝাড়ুদার আজ বিপন্নপ্রায়

মোঃ রাসেদ হাসান সজিব
বাংলা ভাষায় ‘কা কা’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই সবার আগে যে পাখিটির ছবি মনে পড়ে, তা হলো কাক। কালো রঙের, কিছুটা কর্কশ স্বরের এই পাখিটি আমাদের পরিবেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাক শুধু আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো এক সাধারণ পাখিই নয়, বরং এটি প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপকারী বন্ধু, পরিচ্ছন্নতাকর্মীও বটে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
কাক শুধু একটি সর্বভুক, সর্বত্র বিচরণকারী পাখি নয়-এটি পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য পরিচ্ছন্নতাকর্মী। নর্দমা, রাস্তার ধারের ডাস্টবিন, বাজারের উচ্ছিষ্ট সব জায়গায় তাদের অক্লান্ত বিচরণ দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য যা এক অদেখা সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। তাই কাককে আমরা ভালোবেসে ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ বা ‘হেলথ ইন্সপেক্টর’ বলি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ সেই কাক ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। শহর কিংবা গ্রাম-সর্বত্র কাকের সংখ্যা দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে, যা আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত।
কাক কর্ভিডি গোত্রের অন্তর্গত একটি বুদ্ধিমান পাখি, যা উষ্ণমণ্ডলীয় প্রায় সব মহাদেশেই ছড়িয়ে রয়েছে। কাকের গড় আয়ুষ্কাল সাধারণত ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০টিরও বেশি প্রজাতির কাক থাকলেও বাংলাদেশে মূলত দুটি জাতের কাক দেখা যায় দাঁড় কাক ও পাতি কাক। দাঁড় কাক আকারে বড় ও অধিক কৃষ্ণবর্ণের হলেও পাতি কাকের ঘাড়, গলা, পিঠ ও বুক ছাই রঙের হয়। বাংলাদেশে সংখ্যায় পাতি কাকই বেশি দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে কাকের উপস্থিতি আগে বেশি থাকলেও আজ তার ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
প্রত্যহ ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত কাকের খাদ্যতালিকা মূলত আবর্জনা, বাসি খাবার, মৃত প্রাণীর দেহ, পোকামাকড় ও নানা উচ্ছিষ্টে ভরপুর। এই সর্বভুক স্বভাবের ফলেই তারা বর্জ্য অপসারণে পরোক্ষভাবে কাজ করে। পচনশীল জৈব বর্জ্য আর মৃতদেহ যত দ্রুত কাকের পাকস্থলিতে যায়, তত দ্রুতই জীবাণুর বিস্তার রোধ হয়; বাতাসে ভাসমান দুর্গন্ধ বা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া জমে ওঠে না। জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরিভাষায় এটি এক ধরনের ‘প্রাকৃতিক স্যানিটেশন সিস্টেম’। কাক অনিয়মিত, অসংগঠিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে শূন্যস্থান পূরণ করে, তা শহর-গ্রাম উভয় পরিবেশেই অমূল্য।
কাকের এই সংখ্যা হ্রাসের অন্যতম কারণ হলো মানুষের অসচেতনতা ও পরিবেশে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যাপক ব্যবহার। কাক প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে আমাদের সমাজে বর্জ্য খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। কিন্তু মানুষ খাবারে যে সব রাসায়নিক পদার্থ মেশায়, তা এখন কাকের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন, মাছ, ফল বা মাংস সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত ফরমালিন কাকের শরীরে প্রবেশ করলে তা তাদের জন্য প্রাণঘাতী হয়। এছাড়া কৃষিকাজে ব্যবহৃত কার্বোফিউরান, ডিডিটি, অ্যালড্রিন, ও এন্ড্রিন ইত্যাদি নিষিদ্ধ কীটনাশক ও বর্জ্য খাবারেও প্রবেশ করে। এইসব বিষাক্ত উপাদান কাক খেয়ে ফেললে দ্রুত বিষক্রিয়া শুরু হয় এবং অনেক সময় তারা হঠাৎ মারা যায়। শুধু তাই নয়, খাদ্যে উপস্থিত লিড, পারদ, ক্যাডমিয়াম জাতীয় ভারী ধাতুও দীর্ঘমেয়াদে কাকের স্নায়ুতন্ত্র ও প্রজননক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বিজ্ঞাপন
এই পরিস্থিতি আমাদের শকুনের বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একসময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় আকাশে সারি সারি শকুন দেখা যেত। কিন্তু পশুচিকিৎসায় ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক নামক ওষুধ মৃত গরুর দেহে থেকে যেত, যা খেয়ে শকুন বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেত। পরিণতিতে মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে ৯৯ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত হয়ে যায়। আজ তাদের শুধু খাঁচায় সংরক্ষিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। কাকের ক্ষেত্রেও সেই বিপর্যয়ের ছায়া ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে।
এছাড়াও নগরায়ন, গাছ কাটা, বাসার জায়গা সংকুচিত হওয়া এবং তাদের প্রতি মানুষের হিংস্রতা (যেমন: ঢিল ছোড়া বা বিষ মেশানো খাবার ফেলে দেওয়া) কাকের বসবাসের পরিবেশ ধ্বংস করছে। অনেক মা-কাক নিরাপদ বাসা খুঁজে পাচ্ছে না; ফলে ডিম পাড়তে পারছে না বা ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কাকের এমন হঠাৎ হ্রাস আমাদের বাস্তুতন্ত্রে এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করতে পারে। কারণ কাক পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা মৃত প্রাণী খেয়ে পচন রোধ করে, জীবাণু বিস্তার কমায় এবং খাদ্যচক্রে পরিস্কারক হিসেবে কাজ করে। যদি কাক না থাকে, তবে আবর্জনা জমে গিয়ে রোগজীবাণুর বিস্তার ঘটবে। শহরের ডাস্টবিন, হাটবাজার বা হাসপাতালের আশপাশে মৃতদেহ বা পচা বর্জ্য পড়ে থাকলে তা রোগের উৎস হয়ে উঠবে। মানুষ তখন সহজেই ডায়রিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগ কিংবা শ্বাসজনিত রোগে আক্রান্ত হবে।
বিজ্ঞাপন
সুতরাং কাকের সংখ্যা হ্রাসকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের উচিত পরিবেশবান্ধব নগরায়ন নিশ্চিত করা, গাছপালা সংরক্ষণ ও লাগানো এবং পাখির প্রতি সদয় হওয়া। কাকসহ অন্যান্য পাখির আবাসস্থল রক্ষা করলে আমরা শুধু একটি প্রজাতিকে রক্ষা করব না বরং নিজেদের বাস্তুসংস্থানকেও রক্ষা করব। কাক কমে যাওয়ার অর্থ শুধু একটি পাখির প্রজাতির ক্ষতি নয় বরং এটি পরিবেশের এক প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সংকেত।
পরিশেষে বলা যায়, কাককে আমরা যতটা অবহেলা করি, প্রকৃতপক্ষে তারা পরিবেশ রক্ষায় ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়লে আমাদের নিজেদেরও বড় মূল্য দিতে হতে পারে। তাই কাককে রক্ষা করা মানে প্রকৃতিকে রক্ষা করা, আর প্রকৃতিকে রক্ষা করা মানে নিজের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা।
লেখক: শিক্ষার্থী পরিবেশ বিজ্ঞান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বিজ্ঞাপন
কেএসকে/জেআইএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন