ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস

পৃথিবী বাঁচাতে ম্যানগ্রোভ বন রক্ষা করা অপরিহার্য

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ১১:৪৩ এএম, ২৬ জুলাই ২০২৫

ড. ফোরকান আলী
২৬ জুলাই। আর্ন্তজাতিক ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ দিবস। সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। এ ধরনের বন সুরক্ষা করা অপরিহার্য। প্রকৃতির এক অতুলনীয় রক্ষাকবচ ম্যানগ্রোভ বন। নদী-মোহনার কিনারে ছড়িয়ে থাকা সবুজ এই প্রাকৃতিক বেষ্টনী আমাদের অস্তিত্বেরও বড় ভিত্তি।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূল রক্ষা, জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এর ভূমিকা অপরিসীম। এ যেন উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্য একপ্রকার জীবন্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অথচ এই অমূল্য বনাঞ্চল আজ বিশ্বজুড়ে নানা হুমকির মুখে।

ম্যানগ্রোভ রক্ষার সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা রেখে ১৯৯৮ সালে জীবন দিয়েছিলেন পরিবেশকর্মী হেইহাও ড্যানিয়েল নানোটো। সে বছরের ২৬ জুলাই ইকুয়েডরে ম্যানগ্রোভ বন কেটে চিংড়ি চাষ করার প্রতিবাদে এবং ম্যানগ্রোভ জলাভূমি পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলনরত অবস্থায় প্রাণ হারান তিনি। তার এই আত্মত্যাগের স্মরণে এবং ম্যানগ্রোভ প্রতিবেশের গুরুত্ব বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ২০১৫ সালে ইউনেস্কো ২৬ জুলাইকে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ দিবস (ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য কনজারভেশন অব দ্য ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম) হিসেবে ঘোষণা করে। পরের বছর থেকে দিবসটি বিশ্বব্যাপী উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

এটি উপকূলীয় জীবনের টিকে থাকার লড়াই, টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের দায়িত্ব ও অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জল-জঙ্গল আর বাদাবনে ঘেরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ সুন্দরবন। সুন্দর এই বনে ম্যানগ্রোভ জাতীয় বাস্তুতন্ত্রের কারণেই মূল ভূখণ্ড সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস, ঝড়ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণাবর্ত এবং অন্যান্য সামুদ্রিক সমস্যা থেকে সুরক্ষিত থাকে। ম্যানগ্রোভ বা লবণাম্বু উদ্ভিদ একটি বিশেষ বাস্তুতন্ত্র তৈরি করে রাখে।

কর্দমাক্ত নোনা জলাভুমি আবাসে পরিণত হয় বহু পোকামাকড়, মাছ, সরীসৃপ কম্বোজ প্রাণী, পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর। ওই বিপুল সংখ্যক বাস্তুতন্ত্রকে খাদ্যের যোগান দেয় এই ম্যানগ্রোভ জাতীয় অরণ্য। শুধু তাই-ই, নয় প্রতি হেক্টর ম্যানগ্রোভ প্রতিবছরে বিপুল পরিমাণে কার্বন শোষণ করে। অথচ ভাবতে অবাক লাগলেও নির্মম সত্য হল এই যে প্রতিবছর ১ শতাংশেরও বেশি হারে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়ে চলেছে দুনিয়া জুড়ে।

ম্যানগ্রোভ এক বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ যা সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের নোনা পানিতে জন্মায়। এগুলো হচ্ছে শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদ। জোয়ারের সময় শ্বাসমূলের সাহায্যে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ শ্বসন কাজ চালায়। এদের মূল থেকে একটা ডালের মতো চিকন অংশ মাটি ভেদ করে উপরে উঠে আসে। জোয়ারের সময় যখন মাটির উপরে পানি জমে যায়, তখন এই শ্বাসমূলগুলো পানির উপরে ভেসে থাকে। এই শ্বাসমূলগুলোর মাথায় এক ধরনের শ্বাসছিদ্র থাকে, যাদের বলে নিউমাটাপো। এদের সাহায্যেই ম্যানগ্রোভ গাছেরা শ্বাস নেয়। ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং এর প্রতিবেশ সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস পালিত হয়।

পৃথিবীতে ১০২টি দেশে ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব থাকলেও কেবল ১০টি দেশে ৫০০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে। পৃথিবীর সমগ্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪৩ শতাংশ ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং নাইজারে অবস্থিত এবং এদের প্রত্যেকটি দেশে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ২৫ শতাংশ হতে ৬০ শতাংশ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চাল রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০,২৩০ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এ বন বিস্তৃত। বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬,০৩০ বর্গ কিলোমিটার।

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন প্রধান। কক্সবাজারে মাতামুহুরী নদীর মোহনায় ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে যা ‘চকোরিয়া সুন্দরবন’ নামে পরিচিত। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। অভ্যন্তরীণ নদী ও খালসহ এ বনের আয়তন প্রায় ৬৪৭৪ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের মোট বনভূমির ৪৭ ভাগই সুন্দরবন। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য খাল ও নদী। এসব নদীতে কুমির, ভোদর, ডলফিন, কাঁকড়া এবং চিংড়িসহ প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ রয়েছে।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দেখা গেল কাঠমূল্যের গাছগুলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তখন সবার চোখ পড়ল বনসমষ্টির মধ্যে হরিজন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের দিকে। তখন পর্যন্ত ম্যানগ্রোভের ওপর তেমন উল্লেখযোগ্য বিশ্বস্ত কোনো গবেষণা হয়নি। ম্যানগ্রোভ আমাদের কী কী উপকারে লাগে, এটা জানতে জানতেই পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক ম্যানগ্রোভ বন উজাড় করা হলো। জ্বালানি, মাছ-কাঁকড়া-চিংড়ির চাষের জন্য নির্বিচার ম্যানগ্রোভ কাটা হলো। আমরা যখন জানতে পারলাম আমাদের মতো সমুদ্র সমান্তরাল দেশের আবহাওয়া পরিবর্তনের রুদ্ররোষ সামুদ্রিক সাইক্লোন থেকে বাঁচার প্রথম কাতারের সৈনিক হচ্ছে ম্যানগ্রোভ। পৃথিবীর প্রায় ৩৪০ প্রজাতির খাদ্য উপযোগী মিঠা জল ও লবণ জলের মাছের আঁতুড়ঘর হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র। প্রায় হাজারো বড় জীব, অণুজীব আশ্রয় নেয়, পুষ্টি পায় ম্যানগ্রোভের উদার উৎপাদনশীলতায়।

একসময় জীববৈচিত্র্য বলতে একটা প্রতিবেশের সীমাবদ্ধ কিছু জীবজন্তু, গাছপালাকে বোঝাত। সেই অনুযায়ী ধরা হতো ম্যানগ্রোভের জীববৈচিত্র্য অন্যান্য জঙ্গলের চেয়ে অনেক সীমিত। আধুনিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ম্যানগ্রোভের জীববৈচিত্র্য অনেক মূল ভূখণ্ডের বনের চেয়ে সমৃদ্ধ। ম্যানগ্রোভের কার্বন সংরক্ষণ ক্ষমতা অন্যান্য জঙ্গলের চেয়ে দশ গুণ বেশি। গ্রামীণ জঙ্গল ছাড়া বাংলাদেশে তিন ধরনের লক্ষণযুক্ত জঙ্গল আছে। শুকনা পাতা ঝরা শালের জঙ্গল, পূর্বাঞ্চলের মিশ্র বৃষ্টিপাতের জঙ্গল আর চিরহরিৎ ম্যানগ্রোভ জঙ্গল।

আমাদের যদি কঠোর সত্যির মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে স্বীকার করে নিতে হবে শালের জঙ্গল, মিশ্র বৃষ্টিপাতে জঙ্গলের ভবিষ্যৎ সংশয় আচ্ছাদিত। সেগুলো জঙ্গল বলতে ছেঁড়াখোরা খুবলে নেওয়া বনভূমির কঙ্কাল। শৃঙ্খলচক্র প্রায় পোকায় খাওয়া। শালের বনভূমি নষ্ট হলে পঞ্চাশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় অনেকটা আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। মিশ্র বৃষ্টিপাতে বা রেইন ফরেস্টে শত শত বছরের চেষ্টায়ও ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু ম্যানগ্রোভ আয়ুষ্ময়ী। ফাঁকা হওয়া জঙ্গল ১৫ বছরের চেষ্টায় আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।

জীববৈচিত্র্যে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। তার পরই সুন্দরবনের অবস্থান। এককালে বাংলা অঞ্চলের গঙ্গার পুরো দক্ষিণ অঞ্চল ছিল ম্যানগ্রোভ বনে আচ্ছাদিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত এখনকার সুন্দরবনের এলাকার চেয়ে দ্বিগুণ এলাকায় বাদা জঙ্গল ছিল। আমাদের টেকনাফ অঞ্চলে, চকোরিয়ায় বেশ সমৃদ্ধ ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ছিল।

গত শতাব্দীর আশির দশকে বন বিভাগের কর্মতৎপরতায় উপকূলীয় বেষ্টনীর নামে চমৎকার বনভূমি গড়ে তোলা হয়েছিল। নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে ঢুকলে মনে হতো সুন্দরবনে ঢুকেছি। এখন সেসব অতীত হয়ে গেছে। চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের মারাত্মক কুফল ফলতে শুরু করেছে। ভয়ংকর বিষে মাছ-চিংড়ি মারতে গিয়ে শতাধিক প্রজাতির জীবসত্তাকে বিলুপ্তির পথে টেনে নেওয়া হচ্ছে। অথচ আমাদের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল একমাত্র বাঘের জঙ্গল, এত হরিণও আর কোনো ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে নেই। এখানে জঙ্গল সীমানার মধ্যে চার রকম ডলফিন-পরপয়েজ দেখা যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের করাল গ্রাসের শিকার পুরো বিশ্ব। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা। এ সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে ম্যানগ্রোভ বন। এ ধরনের বন প্রতি হেক্টরে অন্য যে কোনো বনাঞ্চলের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি কার্বন শোষণ করতে পারে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদে মাটিতে আটকে রাখতে সক্ষম। এ কারণে ম্যানগ্রোভ বনকে কার্বন সংরক্ষণের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর অনন্য উদাহরণ সুন্দরবন।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সঞ্চিত আছে। কেওড়াগাছ সর্বাধিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিজ শিকড়, কাণ্ড, ডালপালা ও পাতায় আটকে রাখতে পারে। ১ হেক্টর কেওড়া বন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখতে সক্ষম। বাইনগাছের ক্ষেত্রে তা দাঁড়ায় ১১৫ টনে। অপরদিকে গেওয়াগাছ ধরে রাখতে পারে ২৩ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড। তবে গাছের বয়সকালের সঙ্গে সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড ধারণ করার ক্ষমতাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, চিংড়িঘেরের জন্য বন উজাড়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, নদীদূষণ, প্লাস্টিকের প্রভাব প্রভৃতি মানবসৃষ্ট কারণে বর্তমানে সুন্দরবন নানা হুমকির মুখে রয়েছে। তবে এই প্রভাব যে বাংলাদেশের সুন্দরবনেই পড়েছে, তা কিন্তু নয়। বিগত কয়েক দশকে পৃথিবীর ২০-৩৫ শতাংশ ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো শিল্পায়ন, শহরায়ন, মৎস্য খামার সম্প্রসারণ, অপরিকল্পিত পর্যটন, বর্জ্য ও তেল নিঃসরণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং জ্বালানি কাঠের জন্য বৃক্ষনিধন।

আমাদের দেশের পাশাপাশি মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ভারতে এ ধ্বংসযজ্ঞ বেশ প্রকট। শুধু আন্তর্জাতিক ঘোষণা কিংবা দিবস পালনের মাধ্যমে এমন বন রক্ষা সম্ভব নয়; চাই কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। উপকূল রক্ষা, জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে ম্যানগ্রোভ বন বাঁচিয়ে রাখা অপরিহার্য। তাই একটি দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে চাই সারা বছরের সচেতনতা ও বাস্তব উদ্যোগ। সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে এই প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ সুরক্ষার জন্য। তবেই বাঁচবে উপকূল, বাঁচবে দেশ তথা পৃথিবী।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

কেএসকে/জেআইএম

আরও পড়ুন