ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

বন্ধু দিবস

বন্ধু মানে ব্যক্তিগত ডায়েরি

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৪৮ পিএম, ০৩ আগস্ট ২০২৫

তানজিদ শুভ্র

একেকটা সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধূসর হয়ে যায়। তবে কিছু সম্পর্ক থাকে, যেগুলো সময় নয়, টিকে থাকে হৃদ্যতায়। বন্ধুত্ব ঠিক তেমনই। বন্ধু, এমন একজন, যার সামনে ব্যর্থতা স্বীকার করতে লজ্জা লাগে না, যার কাঁধে মাথা রাখলে চোখের জল আটকে থাকে না। জীবনের প্রতিটি মোড়ে, সংশয়ে কিংবা আনন্দে এমন একজন প্রয়োজন, যে না কোনো শর্তে, না কোনো প্রশ্নে-শুধু পাশে থাকে। বন্ধু থাকার মানেই হলো, তুমি একা নও।

স্কুলে প্রথম বেঞ্চের সেই ছেলেটা, হোস্টেলের চুপচাপ রুমমেট, ক্যাম্পাসের ক্লাস ফাঁকি দেওয়া সহপাঠী কিংবা প্রথম চাকরির দিনে ক্যান্টিনে বিল ভাগ করে নেওয়া কেউ; সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, নাম বদলায়, কিন্তু অনুভবটা ঠিক একই থেকে যায়- ‘তুই আছিস তো, আমি একা নই।’

বন্ধুত্ব মানে কেবল সিনেমা দেখা, ঘুরতে যাওয়া, কিংবা কফিশপে সময় কাটানো নয়; বরং মাঝরাতে ফোন পেয়ে চুপিচুপি উঠে দাঁড়ানো, অপর প্রান্তের নিঃশব্দ কান্নার ভাষা বোঝা কিংবা দরকারে কেবল পাশে থাকার নামই বন্ধুত্ব। আমরা সবাই কোনো না কোনো সময়ে ভেঙে পড়ি। কারো কাছে বলা যায় না, এমন কিছু অনুভব জমে জমে পাথরের মতো ভারী হয়ে ওঠে। তখনই দরকার হয় এমন একজন, যার সামনে চোখ ভিজে গেলে লজ্জা নয়, বরং প্রশান্তি মেলে। যাকে বলা যায়, ‘শোন, মনটা ভালো নেই’।

তবে ব্যস্ত সময়, কর্পোরেট জীবন, ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের ভিড়ে আজ আমাদের বন্ধুত্ব কতটা বেঁচে আছে? বাস্তবতা হলো, আমরা অনেকেই নিজেদের বন্ধুদের জীবন থেকে কবে যেন হারিয়ে গেছি, টেরই পাইনি। প্রতিদিনই আমরা বন্ধুত্ব হারিয়ে ফেলছি। হয় ব্যস্ততায়, নয়তো ইগোতে। স্কুল-কলেজে প্রতিদিন দেখা হতো, আড্ডা, ঝগড়া, হাসি-তামাশা-সবকিছুই ছিল প্রাণবন্ত। এখন সে বন্ধুটাই হয়তো বিষণ্নতায় ভুগছে, জীবনসংগ্রামে হাঁপিয়ে উঠেছে, আর আমরা জানিই না। কারণ আমরা আর খবর রাখি না।

বন্ধুত্বের মূল সুরটাই যেন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে এই প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিযোগিতায়। এই ভার্চুয়াল যুগে ‘ফ্রেন্ডলিস্ট’ দীর্ঘ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ের তালিকাটি দিনদিন শূন্য হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে এত এত সময় আমরা দিচ্ছি যে সামনে বসে থাকা বন্ধুর সঙ্গেও দু চারটা ভালো মন্দ কথা বলি না। বন্ধুদের আড্ডাতেও দেখা যায় যে যার মতো ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ফেসবুকে হাজারো ফলোয়ার, ইনস্টাগ্রামে শত শত ‘স্টোরি ভিউয়ার’ তবু যখন রাত তিনটায় ঘুম আসে না, তখন কয়জনকে ফোন করে বলা যায়, ‘মনটা খারাপ আজ’?

বন্ধু মানে শুধু হাসির গল্প নয়, বন্ধু মানে চোখের জলও। বন্ধুর সফলতায় পরশ্রীকাতর না হয়ে বরং উচ্ছ্বাসিত হবে। যে ভালোবাসে এমনভাবে, যেন দোষগুলোও গ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজ এক ধরনের মানসিক চাপে ভুগছে; যার নাম একাকিত্ব। পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান কেউ হয়তো ঠিকঠাক শুনছে না, বুঝতেও পারছে না। তখন একজন শ্রোতা দরকার, যে শুনবে এমন মনোযোগে যেন নাড়ির টানেই বাঁধা। একটা কাঁধ দরকার, যেখানে মাথা রেখে চোখ ভেজানো যায় নির্দ্বিধায়। এই বন্ধুটা হতে পারে ভাই, বোন, সহপাঠী বা অফিস কলিগ কারো মুখে লেখা থাকে না ‘আমি তোর বন্ধু’।

বন্ধু মানেই যেন একটা জীবন্ত ডায়েরি, যেখানে সব অনুভব লেখা যায়। ব্যক্তিগত ডায়েরি যেমন অন্য কেউ পড়ে না, নিজের সব ছোট বড় ঘটনা লেখা থাকে তেমনি একজন বন্ধুও অপর বন্ধুর সব জানে ডায়েরির মত। বন্ধু মানে জীবনের অনিশ্চয়তার ভেতরে একটুকরো স্থিরতা। বন্ধু মানে হাজার ব্যস্ততার মধ্যে একটা খুদে বার্তা, ‘আমি আছি, চিন্তা করিস না।’

বন্ধুত্ব চর্চা করতে হয়। যত্ন নিতে হয়, মন দিয়ে শুনতে হয়, সময় দিতে হয়। শুধু নিজের কষ্টই শেয়ার করলে হয় না, বন্ধু কেমন আছে তাও জানতে হয়। আমরা অনেকেই বন্ধুকে শুধু ‘সময় কাটানোর সঙ্গী’ ভেবে ফেলি। কিন্তু বাস্তবতা হলো একটা সত্যিকারের বন্ধু জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এমনকি হতাশা থেকে বাঁচাতে পারে। কত আত্মহত্যা থেমে গেছে শুধু বন্ধু পাশে ছিল বলে।

বন্ধুত্ব একটি অদৃশ্য সেতু-যা আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে অন্যের হৃদয়কে জুড়ে দেয়। এই সেতু ভেঙে গেলে আর কিছুই ঠিকঠাক থাকে না। বন্ধুর পাশে থাকা মানে শুধু বড় বড় কাজ করা নয়; অনেক সময় সঙ্গে থাকাই সবচেয়ে বড় কাজ। কারণ মানুষ সব সময় উপদেশ চায় না, চায় একজন শ্রোতা, একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ, যে তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবে।

প্রকৃত বন্ধুত্ব বিনিময় নয়, অনুভবের জায়গা। সমাজের যে কোনো রকম সীমাবদ্ধতা, পেশা, অর্থনৈতিক পার্থক্য সবকিছু ছাপিয়ে বন্ধুত্ব টিকে থাকে হৃদয়ের টানে। আমরা অনেক সময় বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে চলি। ‘সে এখন কোথায় চাকরি করছে?’, ‘কে বেশি সফল?’-এই তুলনার খেলায় বন্ধুত্ব জেতা নয়, হারিয়ে যায়।

বন্ধু মানে এমন একজন, যে তোমার সঙ্গে দৌড়াবে না বরং হাঁটবে। যে তোমার ব্যর্থতায় রাগ করবে না, বরং বলবে ‘তুই পারবি’। যে ভুল ধরিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না, আবার তোমার স্বপ্নে সবচেয়ে আগে হাততালিও দেবে।

বন্ধু মানে নির্ভরতার এক চিলতে ছায়া। যার কাছে তুমি ঠিক যেমন, তেমনভাবেই থাকতে পারো-না কোনো মুখোশে, না কোনো পর্দায়। বন্ধুত্বের অনুভবটুকু যেন টিকে থাকে সব ব্যস্ততা, দূরত্ব, ইগো আর আধুনিক যন্ত্রমানবতার ঊর্ধ্বে। বন্ধুত্ব অমলিন থাকুক, নির্মল থাকুক। আর আমাদের হৃদয়ে অনুপমের সুরে যেন বাজতেই থাকুক ‘বন্ধু চল রোদ্দুরে, মন কেমন মাঠ জুড়ে, খেলবো আজ ওই ঘাসে, তোর টিমে তোর পাশে।’

আরও পড়ুন

লেখক: শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর।

কেএসকে/এমএস

আরও পড়ুন