সাইবেরিয়ার তুষারপাতে কী কী হতে পারে জানেন?
সাইবেরিয়ার ওয়মিয়াকন গ্রামকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম গ্রাম
রাশিয়ার সাইবেরিয়া বিশ্বের অন্যতম শীতপ্রধান অঞ্চল, যেখানে শীতকাল শুধু ঠান্ডাই নয় জীবনযাত্রার প্রতিটি অংশে চরম প্রভাব ফেলে। এখানে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, আর কিছু এলাকায় তো ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও দেখা যায়। ওয়মিয়াকন নামে সাইবেরিয়ার এক গ্রামে শীতকালে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ৭০ ডিগ্রিতে।
সাইবেরিয়ার ওয়মিয়াকন গ্রামকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম গ্রাম। এখানে সচরাচর এতোটাই ঠান্ডা পড়ে যে, মঙ্গলগ্রহ থেকেও বেশি শীতল মনে করা হয় এই অঞ্চলটিকে। যেখানে মঙ্গলে তাপমাত্রা কম থাকার কারণে, মানুষের বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করা যাচ্ছে না। সেখানে আমাদের পৃথিবীতেই ওয়মিয়াকন নামে তারচেয়েও বেশি শীতল একটা জায়গা আছে। ১৯২৪ সালে এখানে একবার তাপমাত্রা মাইনাস ৭১ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ৮৮ ডিগ্রিতে।
যখন এখানকার তাপমাত্রা ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে এমন পরিস্থিতিতে মানুষের শ্বাস নেওয়া পর্যন্ত কষ্টকর হয়ে ওঠে। বাইরে কয়েক মিনিট দাঁড়ালেই চুল, ভ্রু ও দাড়ি বরফে জমে যায়। গাড়ির ইঞ্জিন জমে যাওয়ার কারণে বিশেষ হিটার ছাড়া চালু করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আকাশে কখনো কখনো বরফকণার মতো ঝলমলে ‘ডায়মন্ড ডাস্ট’ ভেসে বেড়ায়, যা এই অঞ্চলের তীব্র ঠান্ডারই এক অনন্য দৃশ্য।

তুষারপাত হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক রূপ নেয়। ঘর, রাস্তা, গাড়ি সবকিছুই ঘন বরফে ঢেকে যায়। অনেক সময় দরজাও খোলা যায় না। বরফের কারণে রাস্তাঘাট অচল হয়ে পড়ে, ট্রেন ও বাস চলাচল ব্যাহত হয় এবং বিমানবন্দর কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তীব্র ঠান্ডায় পাইপলাইন জমে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বন্যপ্রাণীর খাদ্যাভাব দেখা দিলে তারা মানুষের বসতিতেও চলে আসে। তুষার জমে স্কুল বন্ধ থাকে এবং শিশুদের বাইরে বের হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা মূলত ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করেই চলে। তারা পশমের কোট, ভারী বুট, ডাবল গ্লাভস ও থার্মাল টুপি ছাড়া বাইরে পা ফেলতে পারে না। ঘরবাড়িতে থাকে শক্তিশালী হিটার এবং থার্মাল ইনসুলেশন, যাতে বাইরে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও ঘরের ভেতর উষ্ণতা বজায় থাকে।
পরিবহনে ট্রেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, কারণ ট্রেন বরফের কারণে কম থেমে যায়। গাড়ি ব্যবহারের আগে ইঞ্জিন হিটার দিয়ে গরম করতে হয় এবং শীতকালে জমে যাওয়া নদী ও হ্রদের ওপর দিয়ে ‘আইস রোড’ তৈরি করে চলাচল করা হয়।

এই অঞ্চলের গাড়ি চলন্ত অবস্থায় না থাকলেও, বেশিরভাগ সময় ইঞ্জিন চালু করে রাখতে হয়। তা না হলে অকেজো হয়ে যেতে পারে গাড়ি। এমনকি কিছু বছর আগেও এখানে দুজন মানুষ ঠান্ডায় জমে মারা যান। তাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথ হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর তাতেই ঘটে এই দুর্ঘটনা। বাইরে এতো ঠান্ডা যে, কিছুক্ষণের মধ্যে তারা বরফের মতো জমে মারা যান।
ফসল উৎপাদন এখানে অত্যন্ত কঠিন। শীতকালে সূর্যালোক দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টা থাকে, ফলে কৃষিকাজ কার্যত অসম্ভব হয়ে যায়। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ২-৩ মাসের গ্রীষ্মেই সব ফসল ফলানো হয়। বার্লি, গম, রাই এবং আলু প্রধান ফসল। সবজি উৎপাদনে গ্রীনহাউস ব্যবহারের ওপর নির্ভর করতে হয়, যেখানে কৃত্রিম আলো ও গরম বাতাস দিয়ে উদ্ভিদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়।
এত ঠান্ডায় শরীর গরম রাখতে উচ্চ ক্যালরির খাবার প্রয়োজন হয়। তাই সাইবেরিয়ার মানুষ সাধারণত মাংস, আলু, স্যুপ, বাটার ও চিজ বেশি খায়। ‘পেলমেনি’,‘বোরশ্চ’ এবং হিমায়িত মাছ দিয়ে তৈরি নানা খাবার তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। খাবার শুধু স্বাদ নয় বেঁচে থাকার উপায় হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বলগা হরিণ পালন করার কারণে মাংস আর স্যুপ এখানকার মানুষের প্রধান খাদ্য। তবে এসব খাবার ফ্রিজে রাখার কোনো বালাই নাই। মাইনাস ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় খাবার নষ্ট হওয়ার ভয় নেই কোনো।
এখানে মৃতদের ভর্তি কফিন সমাধিস্থ করার আগে কবর খননের জন্য আগুন জ্বালিয়ে বরফযুক্ত মাটি কাটা হয়। আর এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় লেগে যায় অন্তত তিন-চার দিন। শত শত বছরেও এখানে সমাধিস্থ মৃতদেহে পচন ধরে না।
তুষারপাতের প্রভাবে সাইবেরিয়ার বন্যপ্রাণীর জীবনে কষ্ট আরও বাড়ে। নেকড়ে, রেইনডিয়ার, শেয়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী বরফের মধ্যে খাদ্যের সন্ধানে দীর্ঘ পথ হাঁটে। নদী ও হ্রদ জমে যাওয়ায় মাছ ধরতে বিশেষ বরফকাটা যন্ত্র লাগে। কিছু এলাকায় ওয়াইমিয়াকন বিশ্বের সবচেয়ে ঠান্ডা বসতি হিসেবে পরিচিত।

ঠান্ডায় এখানে নানান উদ্ভট সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় বাসিন্দাদের। যেমন প্রচণ্ড ঠান্ডায় এখানে কিছুক্ষণ বাইরে থাকলেই চোখের উপর বরফের আস্তরণ জমে যায়। এছাড়া কলমের কালি, গ্লাসে রাখা পানিও কিছুক্ষণ পর আর তরল থাকে না। জমে যায় একদম। বাইরে ফুটন্ত গরম পানি নিয়ে গেলেও সেটি জমে বরফে পরিণত হতে সময় লাগে মিনিট খানিক।
সব মিলিয়ে সাইবেরিয়া প্রকৃতির শক্তি আর মানুষের সংগ্রামের এক বাস্তব চিত্র। বরফে মোড়া এই ভূমিতে জীবন কঠিন হলেও, মানুষের শক্ত মনোবল, অভিযোজন ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন তাদেরকে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার সাহস দেয়।
আরও পড়ুন
পাঁচ শতাব্দীর ভূকম্পনের ইতিহাস
ইতিহাসে বিশ্ব নেতাদের আলোচিত উত্থান, পতন ও পরিসমাপ্তি
কেএসকে/জেআইএম