ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

সংসদ ভবন: সৃষ্টিশীল ও কাব্যিক প্রকাশের অনন্য নিদর্শন

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:১৫ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২৩

মো. মামুন হাসান

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন আইনসভা ভবনের একটি। বলা যায়, এটি আধুনিক যুগের স্থাপত্যরীতির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন এবং এর মাধ্যমে সূচিত হয় আধুনিকোত্তর যুগের স্থাপত্যরীতির। বিশ্বস্তরে বাংলাদেশের পরিচয়সূচক প্রতীকী ভবন এটাই। রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে ২১৫ একর জায়গাজুড়ে স্থাপিত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিশ্ব স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন, বাংলাদেশের এই আইনসভা যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি।

গোড়ার কথা
১৯৫৯ সালে প্রথম ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটি তৈরির পরিকল্পনা গৃহীত হয়। তৎকালীন সামরিক সরকার- পাকিস্তানের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় রাজধানী শেরে বাংলা নগরে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে বর্তমান সংসদ ভবনটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখনকার খ্যাতনামা স্থপতি লুই ইসাডোর কান (১৯০১-১৯৭৪) কমপ্লেক্সটির নকশা প্রণয়নের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এটি তৈরির দায়িত্ব পান এবং এর ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে এর নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয়।

লুই কানের মতো একজন স্থপতির নিয়োগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। পাকিস্তান আমলে শুরু হওয়া কাজটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় একযুগ পরে শেষ হয়। বিশ্বের স্থাপত্যের ইতিহাসে বাংলাদেশ এই অসাধারণ স্থাপত্য কর্মের বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। আর এই স্থাপত্য কর্মটির মহিমা বোঝানোর জন্য স্থপতি মীর মোবাশ্বের আলী তার ‘সমতটে সংসদ-বাংলাদেশ স্থাপত্য সংস্কৃতি, লুই কান ও সংসদ ভবন’ গ্রন্থে বলেন,‘এই স্থাপত্য কর্মটির মহিমা বোঝানোর জন্য বলা যেতে পারে যে, পাঁচ হাজার বছরের এই মানব সভ্যতার প্রথম দিকে অর্থাৎ মিশরের পিরামিড থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত স্থপতিদের একশটি শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কর্মের তালিকা তৈরি করলে সংসদ ভবন এর মধ্যে একটি হবে। লুই কান যত কাজ করেছেন তার মধ্যে এটা সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের স্থাপত্যের ইতিহাসের প্রতিক্রিয়াও সবচেয়ে বেশি।’

আরও পড়ুন: চার ফুট থেকে যেভাবে ৩ বছরেই সাত ফুট হন অ্যাডাম

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মাণাধীন প্রধান অবকাঠামোটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ভবনের মূল নকশায় কোনো রকম পরিবর্তন না এনে নির্মাণ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সব সুবিধাদিসহ ১২৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকার নির্মাণ ব্যয়ে সংসদ কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এগারোটি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় নির্বাচনের পর গঠিত সংসদের অধিবেশনগুলো অনুষ্ঠিত হয় পুরনো সংসদ ভবনে, যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের অষ্টম (এবং শেষ) অধিবেশনে প্রথম সংসদ ভবন ব্যবহৃত হয়। তখন থেকেই আইন প্রণয়ন এবং সরকারি কার্যক্রম-পরিচালনার মূল কেন্দ্র হিসেবে এই ভবন ব্যবহার হয়ে আসছে।

অবস্থান
ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সকে ঘিরে রয়েছে চারটি প্রধান সড়ক। উত্তর দিকে লেক রোড; পূর্ব দিকে রোকেয়া স্মরণী; দক্ষিণ দিকে মানিক মিয়া এভিনিউ এবং পশ্চিম দিকে মিরপুর রোড। ফলে সংসদ অধিবেশন চলাকালে যানবাহন চলাচল ও সহজে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হয়।

যে নকশা ভবনটিকে করেছে অনন্য
এই স্থাপনার স্থাপত্য দর্শনের মূলে ছিল স্থানের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা। এটি পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ স্থাপত্যকর্ম। ভবনের কোথাও কোনো কলাম নেই। শূণ্য স্থানের অংশ হিসেবে ফাঁপা কলাম রয়েছে ঠিকই কিন্তু তা শুধুই কাঠামো নকশায় ভারসাম্য রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। নির্মাণ মসলা হিসেবে কংক্রিট ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভেতরে ও বাইরের অংশে ব্যবহৃত হয়েছে ঢালাই কংক্রিট। ছাদ দিয়ে প্রবেশকৃত আলো বিভিন্ন জায়গাকে যেভাবে আলোকিত করেছে তাতে মনে হয় আলোকচ্ছ্বটা ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে।

জাতীয় সংসদ ভবনের নকশায় সূর্যের আলো এবং বৃষ্টির প্রতিরোধকে বিবেচনা করা হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। অন্যদিকে বাতাসের বাধাহীন চলাচলকে সম্ভব করেছে বহিস্থ ফাসাদের বিশাল জ্যামিতিক ত্রিভুজ, আয়তক্ষেত্র, সম্পূর্ণ বৃত্ত ও বৃত্তাংশ এবং সমতল খিলানসমূহ। দক্ষতার সঙ্গে আলোকে প্রয়োগ করার মাধ্যমেই লুই আই কানের নকশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। ভবন কাঠামোটি একটি অসাধারণ সৌধ হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে বাইরের দিকে গতানুগতিকভাবে জানালা স্থাপন পদ্ধতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং মূল দেওয়ালে ফাঁক সৃষ্টি করে বিশাল স্থাপত্যের অসুবিধাকে দূর করা হয়েছে। স্থাপত্যিক শৈলীতে ভবনটি ঢাকার আধুনিক ভবনসমূহ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

আরও পড়ুন: ভূমিকম্প হলে দ্রুত যা করবেন

কী আছে সংসদ ভবনের ভেতর
সংসদ কমপ্লেক্সটির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত আছে মূল সংসদ ভবন, সংসদ সদস্য, মিনিস্টার ও সেক্রেটারিদের হোস্টেল, অতিথি ভবন ও কমিউনিটি বিল্ডিং। প্রথম তলায় একটি গ্রন্থাগার, তৃতীয় তলায় সংসদ সদস্যদের জন্য লাউঞ্জ এবং উপর তলায় মিলনায়তন রয়েছে। ভবনটিকে সাধারণত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় যথাক্রমে মূল ভবন, মূল প্লাজা, দক্ষিণ প্লাজা, উত্তর দিকের রাষ্ট্রপতি প্লাজা।

মূল ভবন
সংসদ ব্লক,উত্তর ব্লক, উত্তর-পূর্ব ব্লক, পূর্ব ব্লক,দক্ষিণ-পূর্ব ব্লক,দক্ষিণ ব্লক, দক্ষিণ-পশ্চিম ব্লক,পশ্চিম ব্লক ও উত্তর-পশ্চিম ব্লক এর সমন্বয়ে মূলভবনটি নয়টি পৃথক ব্লক দিয়ে তৈরি।সংসদ ভবনের উচ্চতা ১৫৫ফুট ৮ইঞ্চি। মাঝের অষ্টভূজ ব্লকটির উচ্চতা ১৫৫ ফুট এবং বাকি আটটি ব্লকের উচ্চতা ১১০ ফুট। প্রতিটি ব্লকের জায়গাকে বিভিন্ন কাজের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে, করিডোর, লিফট, সিড়ি ও বৃত্তাকার পথ দিয়ে আনুভূমিক ও উলম্বিকভাবে ব্লকগুলোর মাঝে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। পুরো ভবনটির নকশা এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে সব ব্লকগুলোর সমন্বয়ে একটি ব্লকের অভিন্নস্থান হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ১০তলা বিশিষ্ট সংসদ ভবনের নিচতলার মেঝে এক লাখ ৫০ হাজার বর্গফুটের হলেও সমগ্র মেঝে আট লাখ ৩২ হাজার বর্গফুটের এবং ভবনের দেয়ালের পুরুত্ব ১২ থেকে ২৪ ইঞ্চি।

দ্বিতীয় তলার একটি লাগোয়া ব্লকে প্রধান কমিটির রুমগুলো রয়েছে। সব ধরনের সংসদীয় কার্যক্রম, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রী, চিফ হুইপসহ হুইপগণের অফিস এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির অফিস রয়েছে এই ভবনে। একই ভবনে সংসদের সচিবের জন্যও কিছু অফিস বরাদ্দ রয়েছে।

মূল প্লাজা
মূল প্লাজার মূল অংশটি হচ্ছে সংসদ অধিবেশন কক্ষ। এখানে মোট আসন ৫৮১টি যার মধ্যে সংসদ সদস্যদের জন্য ৩৫৪টি; রাষ্ট্রপতি ও স্পীকার, অতিথি গ্যালারি ৪১টি; বিশিষ্ট অতিথি গ্যালারি ৫৬টি; সাংবাদিক গ্যালারি ৭০টি; সচিব ও কর্মকর্তা গ্যালারিতে ৬০টি আসন রয়েছে।

এখানে একই সময়ে ৩৫৪ জন সদস্যের সংস্থান রাখা হয়েছে। ভিআইপিদের জন্য দুইটি পোডিয়াম এবং দুইটি গ্যালারি রয়েছে। পরাবৃত্তাকার ছাদসম্পন্ন অধিবেশন কক্ষটির উচ্চতা ১১২ ফুট। ছাদটি স্বচ্ছভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন দিনের আলো এতে প্রবেশ করতে পারে। সূর্যের আলো চারদিকের ঘেরা দেয়াল ও অষ্টভূজকৃতির ড্রামে প্রতিফলিত হয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করে। কৃত্রিম আলোকে এমনভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যে সূর্যের আলোর প্রবেশের ক্ষেত্রে তা কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। উপরের অংশের অভ্যাগত এবং গণমাধ্যমের জন্য গ্যালারির ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও এর বিভিন্ন অংশে রয়েছে: প্রথম তলায় একটি গ্রন্থাগার; দ্বিতীয় তলায় সংসদ সদস্যদের জন্য লাউঞ্জ এবং উপর তলায় মিলনায়তন।

দক্ষিণ প্লাজা
দুই লাখ ১৭ হাজার বর্গফুটের দক্ষিণ দিকে মানিক মিয়া এভিনিউর অভিমুখে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা অবস্থিত। এর ক্রমোচ্চ ২০ফুট উচ্চতার ভবন কাঠামো, সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি সংসদ ভবনের মূল প্রবেশ পথ (অধিবেশন চলাকালে) হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এখানে আরও রয়েছে: নিয়ন্ত্রিত প্রবেশপথ, ড্রাইভওয়ে, প্রধান যন্ত্রপ্রকৌশল কক্ষ, গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বিস্তৃত পরিসর, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের অফিসকক্ষ, উপকরণ সরঞ্জাম রাখার স্থান এবং মূল ভবনে যাওয়ার জন্য উম্মুক্ত চত্বর।

রাষ্ট্রপতি প্লাজা
উত্তর দিকে ৬৫ হাজার বর্গফুটের রাষ্ট্রপতি প্লাজার সম্মুখে লেক রোড অবস্থিত। এই প্লাজা সংসদ সদস্য এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্বেলের তৈরি মেঝে, গ্যালারি এবং খোলা পথ এই প্লাজার নির্মাণশৈলীর বৈশিষ্ট্য।

স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংসদ ভবন নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের একটি উল্লেখযোগ্য ভবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। শুধু বাংলাদেশের পটভূমিতে নয় সারা বিশ্বের স্থাপত্য কর্মসমূহের মধ্যে এ ভবন একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পেশাজীবী সমাজ ছাড়াও সবারই এই ভবন সম্বন্ধে বিশেষ ও আকর্ষণ আছে। জাতীয় সংসদ ভবন বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে করেছে উন্নত। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্থাপত্যশৈলী দ্বারা। আর তাই জন্ম থেকে যেমন এটি বাংলাদেশের পরিচয়ের প্রতীক হয়ে আছে, তেমনি ভবিষ্যতের আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে থাকবে জাতীয় সংসদ ভবন।

কেএসকে/এএসএম

আরও পড়ুন