ঈদের কেনাকাটায় সতর্ক থাকবেন যেভাবে

ঢাকা শহরের শপিং কমপ্লেক্সগুলোতে ঢুকলেই মনে হবে, নগরবাসী যেন সব সময়ে ব্যস্ত থাকেন কেনাকাটায়। কারণও আছে। আছে নানারকম উপলক্ষ্য। আর ঈদ-পূজাকে সামনে রেখে কেনাকাটার ধুম পড়া তো অসাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু শপিং করতে গিয়ে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যে কি আপনি আপনার কেনাকাটা সারতে পারছেন?
সে প্রশ্নের উত্তর থাক। কেনাকাটায় কিছু কায়দা কৌশল রয়েছে। যা অনুসরণ করলে স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করা যায়। প্রতারণার হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। কেনাকাটার কায়দা-কৌশল সম্পর্কে জানার আগে প্রথমেই কী কী কেনা প্রয়োজন তার একটি তালিকা আগেই তৈরি করুন। তালিকায় কী কী পণ্য অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এবং এসব পণ্য কোথায় কোথায় পাওয়া যায় তা স্থির করে বেরিয়ে পড়ুন। কাঁচা বাজারে ঢুকে ঝটপট তরকারি, সদাইপাতি, পণ্য কেনাকাটা করা উচিত নয়। কেননা বাজারে দরদামে কিছুটা তারতম্য থাকে। দামদর করার ক্ষেত্রে পণ্য সম্পর্কে কিছুটা পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। বিক্রেতা দাম হাঁকার পর একটা মাঝামাঝি পর্যায়ের দাম করুন। অথবা একটা সম্ভাব্য দাম করুন।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
ঈদের সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন হাউজগুলো বিপুল পরিমাণ পোশাক আনে। এগুলো থেকে পোশাক কেনার সুবিধা হলো, তাদের শোরুম শপিং মলসহ সুবিধামতো অনেক স্থানেই খুঁজে পাওয়া যায়। এসবের পোশাক সেলাই করাই থাকবে। বাড়তি ঝামেলা নিতে হয় না। নজরকাড়া ধরন এবং সূচিকর্মে সাজানো দেশের প্রথিতযশা ফ্যাশন ডিজাইনারদের নকশায় করা এই পোশাকগুলো এক ধরনের নান্দনিক তৃপ্তি দেয়। ব্র্যান্ডগুলোর অনলাইনেও রয়েছে সরব উপস্থিতি। তাই পাওয়া যায় ঘরে বসেই পণ্য পাওয়ার সুবিধাও।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: ঈদ কার্ড এখন সোনালি অতীতের সুখস্মৃতি
বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজের এসব পোশাকের নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন এগুলো কিছুটা ব্যয়বহুল। আবার পরিচিত কারও সঙ্গে নিজের শখের পোশাকের মিলে যাওয়ার আশঙ্কা নেহাৎ কম নয়! রাস্তায় দেখা মিলতে পারে একই পোশাক পরা কোনো অপরিচিত জনেরও। যেহেতু এই পোশাকগুলো অনেকগুলো পিস তৈরি করা হয় এবং তারমধ্যে সুন্দরগুলোই দ্রুত ও বেশি বিক্রি হয়, তাই কারও না কারও সঙ্গে পোশাক মিলে যেতেই পারে। তবে পছন্দসই পোশাক কেনার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ে ভাবতে হবে। এটি ঠিকঠাকভাবে ফিট করছে কী না, কাপড় যথেষ্ট আরামদায়ক কি না এবং রং ও ডিজাইন ক্রেতার, ব্যবহারকারীর পছন্দ কি না। তবে চাহিদামতো পোশাকের সাইজ আর পছন্দ মিললেও ক্রেতারা মূলত নির্ভর করেন নিজেদের বাজেটের ওপর।
বিজ্ঞাপন
ব্র্যান্ড হাউজগুলো ফ্যাশন চলতি ডিজাইন এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে পণ্য ডিজাইন করে থাকে। তাই স্রোতের বিপরীতে চলতে যারা পছন্দ করেন। নিজেকে একটু স্বকীয়ভাবে উপস্থাপন করতে চান। তাদের এসব ব্র্যান্ডের পণ্য পছন্দ নাও হতে পারে। এদিকে নন ব্র্যান্ডের খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে পোশাক কেনার সুবিধা হলো-অনন্য ডিজাইন এবং দাম তুলনামূলক কিছুটা কম। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হয়, কাপড়ের উপাদান ও মানের ব্যাপারে। আর বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে দরদামেও হতে হয় পটু। ঢাকা শহরের ফুটপাতের দোকানের চেয়েও আজকাল শপিং মলের বিক্রেতারা অনেক বেশি কৌশলী। কাস্টমার ভেদে দাম চেয়ে বসে প্রায় আড়াইগুণ বেশি। দাম শুনে মাথায় আগুন ধরার অবস্থা হয়। এমন অস্বাভাবিক দাম চাইলে সেলসম্যান, ম্যানেজার বা বিক্রেতার সঙ্গে রাগারাগি না করে তাকে শান্তভাবে বলুন যে তিনি দামটা খুব বেশি চাচ্ছেন। তারপর সে দোকান থেকে বেরোতে চাইলেই দেখবেন আপনাকে মিষ্টি করে আবার ডাকছে। তবে আর সেখানে ঢুকবেন না। এসব দোকানের প্রতারণার ফাঁদে পা দেবেন না একদমই।
ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে দোকানে পণ্যের সমারোহ ও বাছাইয়ের সুযোগ এতো বেশি থাকে যে, পছন্দের পোশাক বেছে নেওয়া বেশ কঠিনই হয়ে পড়ে। কিছু কিছু দোকান আছে, যেখানে ঢুকলেই দোকানি অনেকগুলো থ্রিপিস, শাড়ি বা অন্য পণ্য একসঙ্গে বের করে দেখাতে থাকবে। আপনাকে ধাঁধায় ফেলে দেবে। যাতে প্রথমেই আপনার মাথা গোলমাল হয়ে যায়। এটা থেকে দোকানিকে বিরত রাখুন। আপনার প্রয়োজনীয় পণ্যের একটি বা দু’টি পণ্য বের করে পরখ করুন মাত্র। অধিক পরিমাণ পণ্য বের করার পর না কিনলে দোকানির মনোভাব একটু খারাপ হতে পারে। এই গরমে এসব ক্ষেত্রে কখনো কখনো দোকানির সঙ্গে বাগবিতন্ডাও হয়ে থাকে। তাই এসব দোকান এড়িয়ে চলাই ভালো
বিজ্ঞাপন
আর হ্যাঁ, ফুটপাত থেকে পণ্য কিনতে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কেননা ফুটপাতে অনেক ধরনের প্রতারণামূলক ব্যবসা চলে। ফুটপাত থেকে যদি পণ্য কিনতেই হয় তাহলে দামদর জেনে পণ্যটি ভালোভাবে যাচাই করে তারপর কিনবেন। যথাসম্ভব ভাংতি টাকা দিয়ে দাম মেটাতে চেষ্টা করুন। রাতে ফুটপাত থেকে কোনো পণ্য কিনবেন না। তা না হলে এতেও প্রতারিত হওয়ার ভয় থেকে যায়।
ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট কিনতে আরও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। জেনে রাখা ভালো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শীতার কারণে বৈশ্বিক সংকটকালে বিদেশ থেকে ডলার দিয়ে বিদেশি পণ্য আমদানির বদলে দেশেই এসব পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ যোগানো হচ্ছে। দেশেই এখন তৈরি হচ্ছে বিদেশি চকলেট, খেলনা থেকে শুরু করে বিদেশি ইলেকট্রনিক্স নানান পণ্য। যা কল্পনারও বাইরে। স্মার্টফোন, ফিচার ফোন, বিভিন্ন অ্যান্ড্রয়েড গ্যাজেট এমনকি কম্পিউটারও বাংলাদেশেই তৈরি, সংযোজন হয়। এরই মধ্যে আমাদের দেশের ভিশনসহ বিভিন্ন কোম্পানির ইলেকট্রনিক্স পণ্য এখন বিদেশেও ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। তাই সতর্ক থাকতে হবে, দেশে উৎপাদিত ডিজিটাল পণ্য, ইলেকট্রনিক্স পণ্যের অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে বলা হলেও আসলে বিদেশ এখন আর এসব আসেনা।
আরও পড়ুন: নতুন উদ্যমে বাঁচার প্রেরণা জোগায়
বিজ্ঞাপন
কম্পিউটার, ওয়াইফাই, ব্যাটারি, এলইডি ইত্যাদি সামগ্রীর হার্ডওয়্যার বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশেই অ্যাসেম্বিলিং করা হয়। এসব পণ্যের গুণগতমানেরও হেরফের হয় না। তাছাড়া স্যামসাংসহ বিদেশি সব ব্র্যান্ডের ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলো নিজেরাই এদেশে তাদের নিজস্ব কারখানা স্থাপন করেছে। অবাক হলেও সত্যি দেশেই তৈরি হচ্ছে বিদেশি গাড়ি, গাড়ির টায়ারসহ নানান খুচরো যন্ত্রপাতি। ফলে ফিটিংসের ক্ষেত্রেও কোনো ত্রুটি থাকে না। যা নিশ্চিন্তে কিনে ব্যবহার করছেন দেশ-বিদেশের মানুষ। বরং বিদেশ থেকে আমদানি করা ব্র্যান্ডের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলোতে ত্রুটি পাওয়া যায়। যা বেশি দামে বিক্রি করা হলেও কেনার বছর খানেক পর ত্রুটিগুলো প্রকাশ পায়। তখন ফেলে দেওয়া, ভাঙারির দোকানে বিক্রি ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। তাই ইলেকট্রনিক্স পণ্য কিনুন নির্দিষ্ট, পরিচিত, বিশ্বস্ত এবং অবশ্যই দেশি উৎপাদিত ব্র্যান্ডের। সব সময় নির্দিষ্ট ও নিজস্ব ডিলারদের কাছ থেকেই কিনুন। অন্যদের তুলনায় দাম কিছুটা বেশি নিলেও, পণ্যেও কোয়ালিটির ব্যাপারে একটা নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।
আজকাল মানুষের জীবনেরই কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই বলে কষ্টের টাকা দিয়ে পণ্য কিনে পানিতে ফেলবেন? পণ্যটি ব্যবহার করবেন আপনি। তাই কেনার আগে জেনে নেওয়া উচিত জিনিসটির গ্যারান্টি আছে কি না। গ্যারান্টি থাকলে গ্যারান্টি কার্ডটি ঠিকঠাক মতো বুঝে নেওয়া এবং গ্যারান্টির ধরন সম্পর্কে জেনে নিন। কোনো পণ্য কেনার আগে দোকান থেকেই পণ্যটি ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে যে, পণ্যটিতে কোনো সমস্যা আছে কি না। থাকলে তা সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করে নিতে হবে। অথবা ওই পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা বাসায় নেওয়ার পর পণ্যের কোনো সমস্যা দেখা দিলে অনেক ক্ষেত্রে দোকানি তা পরিবর্তন বা ফেরত কোনোটিই করতে চান না। আজকাল শপিং মলের ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতেও ঈদের আগে কেনা জিনিস ঈদের পরে আর ফেরত নিতে চায় না। নিলেও আপনাকে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হবে।
বিজ্ঞাপন
এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ, বদলে যাচ্ছে জীবনধারা। সময় ও স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে প্রযুক্তির উন্নতি ও উৎকর্ষ। এক সময় ঘরে বসে পণ্য কেনাকাটার কথা ভাবাই যেতো না। করোনা মহামারি এসে ঘরে বসে কেনাকাটার সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে। সময়ের পরিবর্তনে অনলাইনে কেনাকাটা এখন এতোটাই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, আমরা এতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বাজার বা মার্কেটে না গিয়ে ঘরে বসে এক ক্লিকেই পছন্দসই পণ্য হাতে আসায় মানুষ অধিক হারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে অনলাইন কেনাকাটায়। ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে প্রিয়জনকে উপহার পাঠানোর সহজ সমাধান এই অনলাইন কেনাকাটা। অনলাইনে ঈদের পোশাক কিনতে হলে খেয়াল রাখবেন একই পোশাক যদি এক স্থানে মূল্য বেশি আর অন্য স্থানে কম হয়, তাহলে দ্রুত কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কারণ পোশাকের ডিজাইন একই হলেও গুণগতমান এক নাও হতে পারে। ঠিক তেমনই কসমেটিক্স, সানগ্লাস, বেল্ট, ঘড়ি ইত্যাদি ভালো ব্র্যান্ডের জিনিসের রেপ্লিকাও এখন অনলাইন বাজারে আছে। তাই পণ্য যাচাই বাছাই করে কেনা উচিত।
তবে এমন অনলাইন ক্রেতা কম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি জীবনে একবার হলেও অনলাইন কেনাকাটায় আশাভঙ্গ বা প্রতারণার মুখোমুখি হননি। অযৌক্তিক দাম, লুকানো চার্জ, ভুয়া রিভিউ, মিথ্যা তথ্য ও ডিজিটাল প্যাঁচ নিয়ে ভোক্তাদের মাঝে অসন্তুষ্টি দেখা যায় প্রায়শই। অনলাইনে বেচাকেনা নিয়ে প্রতারণার খবর মাঝে মাঝেই পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এই প্রতারণা থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। যেমন-অনলাইনে অতিরিক্ত ছাড়, বাজার মূল্য থেকে কম মূল্যে পণ্য, ক্যাশব্যাক, সীমিত সময়ের জন্য অফার এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো। অনেক প্রতিষ্ঠান এভাবেই ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করে বড় ফাঁদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া আসল পণ্যের মোড়কে নকল পণ্য সরবরাহ, কখনোবা পরিমাণে কম দেওয়া, আবার কখনো আগাম অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া-এসব অসাধু চক্রের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। তাই অনলাইন কেনাকাটায় অগ্রিম পেমেন্ট এড়িয়ে চলা উচিত। সবকিছু যাচাই-বাছাইয়ের পাশাপাশি অর্ডারটি ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’র সুবিধা আছে কি না সেটি লক্ষ্য রাখুন। পণ্য হাতে পেয়ে দেখে শুনে তারপর অর্থ পরিশোধ করলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, এম.ফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজ্ঞাপন
কেএসকে/জিকেএস
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন