ভারতে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার ঘিরে মুসলিমদের হয়রানির অভিযোগ, কী হচ্ছে?
ভারতে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার ঘিরে মুসলিমদের হয়রানির অভিযোগ/ ছবি: বিবিসি
ভারতে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার ঘিরে মুসলিমদের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের কানপুরে ঈদে মিলাদ-উন-ঘিরে মুসলিমদের পালনের সময়ে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার লাগানো নিয়ে তৈরি হয় এই বিতর্ক।
এই ব্যানার লাগানোকে কেন্দ্র করে এফআইআর দায়ের হয়েছে, তার আবার বিরুদ্ধে উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ করেছেন মুসলিমরা। অনেকে গ্রেফতারও হয়েছেন।
উত্তরাখণ্ডের কাশীপুরে গত রোববার ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার নিয়ে মিছিল করার সময়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের হাতাহাতি হয়। এই ঘটনায় আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার উত্তর প্রদেশের উন্নাওতে একই ধরনের মিছিল বেরোনোর পর পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আরও পড়ুন>>
ভারতের উত্তর প্রদেশে প্রায় ৩০০ মসজিদ-মাদরাসা গুঁড়িয়ে দিলো প্রশাসন
হরিয়ানায় বাংলাভাষী মুসলিমদের আটক করে নির্যাতনের অভিযোগ
ভারতে মুসলিম দেশের পতাকা ওড়ানোয় বিদ্যুৎকর্মী বরখাস্ত, গ্রেফতার ৮
কী হয়েছিল কানপুরে?
কানপুর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (পশ্চিম) দীনেশ ত্রিপাঠি এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাওয়াতপুর থানা এলাকায় মিলাদ-উন-নবীর চিরাচরিত শোভাযাত্রা বেরোনোর কথা ছিল। যে জায়গা নির্ধারিত ছিল, তার বদলে এলাকার মানুষ অন্য জায়গায় প্যান্ডেল তৈরি করে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার লাগিয়ে দেয়। এক পক্ষের মানুষ এর বিরোধিতা করেন। পরে দুই পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে চিরাচরিতভাবে যে জায়গা ঠিক করা ছিল, সেখানে ব্যানার লাগানো হয়।
ত্রিপাঠির দাবি, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখার জন্য বা ব্যানার লাগানোর জন্য এফআইআর দায়ের হয়নি, বরং চিরাচরিত জায়গার বদলে অন্য জায়গায় প্যান্ডেল বানানোর জন্য এবং শোভাযাত্রা চলাকালে এক পক্ষ অন্য পক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
এফআইআরে বলা হয়েছে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার লাগিয়ে মুসলিম সম্প্রদায় নতুন রীতি শুরুর চেষ্টা করেছে এবং ‘অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ’ এর বিরোধিতা করেছে। শোভাযাত্রার সময়ে যে পুলিশ কর্মীরা মোতায়েন ছিলেন, তাদের পক্ষেই এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
এফআইআরে আরও দাবি করা হয়েছে, শোভাযাত্রা চলাকালে ‘অন্য সম্প্রদায়ের’ ধর্মীয় পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়া হয়। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধি করা এবং ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগও করা হয়েছে এতে। শোভাযাত্রার আয়োজকসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এফআইআরে।
কানপুর পুলিশ বলেছে, এই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
স্থানীয় সাংবাদিক অভিষেক শর্মার কথা অনুযায়ী, ব্যানার লাগানো নিয়ে ৪ সেপ্টেম্বর বিতর্ক বেঁধেছিল, আর পরের দিন মিলাদ-উন-নবীর দিনে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল। কিন্তু এফআইআর দায়ের হয় ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়।
কানপুরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার লাগানো নিয়ে এই বিতর্ক দানা বাঁধার পরে এআইএমআইএমের নেতা ও সংসদ সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়েইসি ১৫ সেপ্টেম্বর কানপুর পুলিশকে ট্যাগ করে এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘কানপুর পুলিশ, আই লাভ মুহাম্মদ লেখা কোনো অপরাধ নয়। যদি তা হয়, তাহলে শাস্তি মেনে নেবো।’
আরও পড়ুন>>
ভারতে প্রকাশ্যে নামাজ পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গ্রেফতার
ভারতে পুলিশের সামনেই তারাবির সময় মসজিদে ‘হামলা’
‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে গুজরাটে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলিম
লক্ষ্ণৌতে বিক্ষোভ, আটকের অভিযোগ
লক্ষ্ণৌতে বেশ কয়েকজন নারী হাতে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার নিয়ে রাজ্য বিধানসভার প্রবেশপথে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তাদের নেতৃত্ব দেন প্রয়াত কবি মুনব্বর রাণার কন্যা ও সমাজবাদী পার্টি নেত্রী সুমাইয়া রাণা।
তিনি বলেন, বেশ কিছু যুবকও তাদের বিক্ষোভে অংশ নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাদের রাস্তাতেই আটতে দিয়েছে। তার কথায়, ‘আমরা নারীরা গাড়িতে চেপে বিধানসভায় গিয়েছিলাম, সেখানেই বিক্ষোভ দেখাই। পুলিশ আমাদের সরিয়ে দেয়।’
রাণা অভিযোগ করেন, বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজনকে পুলিশ কয়েক ঘণ্টা হেফাজতে রেখেছিল। এ নিয়ে লক্ষ্ণৌ পুলিশ অবশ্য কোনো বিবৃতি দেয়নি।
সুমাইয়া রাণার কথায়, মুসলিমদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ভাষণ দেওয়া হলে কোনো মামলা হয় না। মুসলিমরা তাদের সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী ধর্মীয় অনুভূতি ব্যক্ত করতে গেলেই এফআইআর দায়ের হয়ে যায়। এটি মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতি দাবিয়ে রাখার চেষ্টা। এটা উসকানিমূলক করা হবে না।
অন্যদিকে লক্ষ্ণৌয়ের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (সেন্ট্রাল) আশিস শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন, বিধানসভার কাছে বিক্ষোভের ব্যাপারে কোনো এফআইআর দায়ের হয়নি। বিক্ষোভের জন্য নির্ধারিত স্থল হল ইকো গার্ডেন। বিক্ষোভকারীদের ধরে সেখানেই নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বিক্ষোভ অন্য রাজ্যেও
‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার নিয়ে উত্তরাখণ্ড, গুজরাট আর মুম্বাই শহরেও বিক্ষোভ হয়েছে।
বিবিসির সহযোগী সাংবাদিক দখ্শেশ শাহ জানিয়েছেন, গুজরাতের গোধরায় একটি থানার সামনে গত শুক্রবার বিক্ষোভ আর ভাঙচুরের ঘটনায় ৮৭ জনের নামে মামলা দায়ের হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে ১৭ জনকে।
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সামাজিক মাধ্যমে বেশ অ্যাক্টিভ এক যুবক জাকির জাবা ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বিতর্ক নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলেন। তারপর পুলিশ তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
পুলিশ বলছে, তারা জাবাকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি থানা থেকে চলে যাওয়ার পরে আরেকটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করেন, যেখানে তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে উৎপীড়ন আর দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন।
এর ফলেই স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আরও পড়ুন>>
ভারতে মুসলিম পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা
ভারতে পাঠ্যবই থেকে বাদ গেলো মোগল-সুলতানি ইতিহাস
ভারতে মুসলিম ছাত্রকে পাকিস্তানের পতাকায় মূত্রত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ
মুম্বাইয়ের ভায়খলা এলাকাতেও মুসলিমরা ২১ সেপ্টেম্বর মিছিল বের করেন। সেখানেও বিনা অনুমতিতে মিছিল করার অভিযোগে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এবং একজনকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
উত্তরাখণ্ডের কাশীপুর শহরে রোববার বিকেলে স্থানীয় মুসলিমরা ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার নিয়ে মিছিল করেন। সেখানে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের হাতাহাতি হয়।
স্থানীয় সাংবাদিক আবু বকর বলছেন, ওই ঘটনার পরে পুলিশ মামলা দায়ের করে আর বাড়তি বাহিনী নামায়। গভীর রাত পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কাশীপুর যে জেলার অন্তর্গত, সেই উধম সিং নগরের সিনিয়র পুলিশ সুপার মণিকান্ত মিশ্র বলছেন, বিনা অনুমতিতে কাশীপুরে মিছিল করা হচ্ছিল। প্রায় ৪০০ মানুষ সেই মিছিলে যোগ দেন। ওই ভিড় থেকে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালানো হয়। নাদিম আখতারসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে আর অন্য ১০ জনকে আটক করা হয়েছে।
‘নাদিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা জানতে চেষ্টা করছি, এই ধর্মীয় উন্মাদনার পেছনে আসলে কারা রয়েছে,’ বলেন পুলিশ কর্মকর্তা মিশ্র।
মুসলিমদের নিশানা করা হচ্ছে?
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ছোট ছোট ঘটনাকে বড় করে দেখিয়ে মুসলিমদের নিশানা করা হচ্ছে এবং তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার চেষ্টা হচ্ছে।
সামাজিক সংগঠন ইউনাইটেড এগেইনস্ট অ্যাগেইনস্ট-এর সদস্য নাদিম খান বলন, বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে খবর পাচ্ছি, পুলিশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। মোট কতগুলো এফআইআর হয়েছে বা কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার সম্পূর্ণ তথ্য এখনও আমাদের হাতে নেই।
‘কানপুরে যা ঘটেছে, তাতে মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এরকম ঘটনা তো প্রথমবার হলো না। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছেছে। রমজান মাসে ঘরের ভেতরে নামাজ পড়ার জন্য মোরাদাবাদে মামলা হয়েছে। বাড়ির ছাদে নামাজ পড়তে বাধা দেওয়া হয়েছে। এখন পয়গম্বরের পোস্টার নিয়ে মামলা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মুসলিমদের নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে তাদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, বলেন নাদিম খান।
কানপুরের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ব্যানার ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে মুসলিমরা অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। কিন্তু তার ভিত্তিতে কোনো এফআইআর হলো না। অথচ তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হলো।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/