ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

পাচার হচ্ছে বন্যপ্রাণী, লাগাম টানতে প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ

জাহাঙ্গীর আলম | প্রকাশিত: ০৯:০৮ পিএম, ০১ অক্টোবর ২০২৩

চলতে-ফিরতে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছে বন্যপ্রাণী। প্রকাশ্যে অবাধে চলছে এসব বন্যপ্রাণী কেনাবেচা। সাধারণ মানুষের এ নিয়ে যেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বিষয়টি অনেক সময় এড়িয়ে যান। মূলত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে না জানা এবং এ বিষয়ে সচেতনতার অভাবই বাড়াচ্ছে এই অপরাধ। তবে শুধুমাত্র যে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে এমন নয়, গোপনে বিক্রি এবং পাচার হচ্ছে অনেক বন্যপ্রাণী। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী পাচারের অন্যতম প্রধান রুট বাংলাদেশ। ফলে প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার হচ্ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী পাচার বন্ধ করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে দুটি হনুমান উদ্ধার ও দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার হওয়া হনুমানদের মধ্যে একটি মুখপোড়া হনুমান এবং অপরটি চশমাপরা হনুমান। অবৈধভাবে শিকার করা ওই হনুমান দুটি বিক্রির উদ্দেশ্যে ধলপুর মাতৃসদন হাসপাতালের সামনে অবস্থান করছিলেন তিন যুবক। খবর পেয়ে পুলিশ কাউসার (৩৩) ও শাজ উদ্দিন (১৯) নামে দুজনকে গ্রেফতার করে। তবে এসময় তাদের সঙ্গে থাকা আরেকজন পালিয়ে যান।

 

শুধু মামলার সংখ্যা দেখে বন্যপ্রাণী পাচারের সঠিক পরিসংখ্যান মিলবে না। কারণ, যে সংখ্যক বন্যপ্রাণী বছরে পাচার হয়, তার মধ্যে মামলা হয় খুবই কম। সাধারণত অভিযোগ এলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ ও মামলা করে পুলিশ।

 

আরও পড়ুন: এক মাস ধরে বাসায় পুষছিলেন অজগর, খবর পেয়ে উদ্ধার 

এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেন যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মুকিত হাসান। ১৯২৭ সালের বন আইনের ২৬(১এ) ও (এফ), ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের ৬(১) ও ৩৪(খ) এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(বি) ও (ডি) ধারায় অভিযোগ এনে এ মামলা করা হয়। এরপর গ্রেফতার দুজনকে কারাগারে পাঠান আদালত।

গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার কুতুবখালী এলাকা থেকে দুটি তক্ষক উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিউটন নামের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এ যুবক পুলিশকে জানান, তক্ষকগুলো খাগড়াছড়ি থেকে এনে ফরিদপুরের এক ব্যক্তিকে দেওয়ার কথা ছিল। এ ঘটনায় নিউটনের বিরুদ্ধে বন আইন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে অভিযোগ এনে মামলা করেন যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মনির হোসেন।

jagonews24

বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারের অভিযোগে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরে মামলা হয়েছে পাঁচটি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এসব মামলার বাদী সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ। এর মধ্যে ২০২২ সালের ২০ জুন, ১ আগস্ট ও ২৭ আগস্ট পল্টন থানায় একটি করে মামলা হয়। এছাড়া ২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ও ২০ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি করে মামলা দায়ের হয়। এর আগে ২০২১ সালে এ সংক্রান্ত ৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ওই বছরের ২২ অক্টোবর মতিঝিল থানায় একটি, ১৬ অক্টোবর রমনা মডেল থানায় একটি, ২৯ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি, ১১ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় আরেকটি, ৭ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় আরও একটি ও ১৮ ডিসেম্বর সবুজবাগ থানায় একটি মামলা হয়।

আরও পড়ুন: বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ দমনে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা 

শুধু মামলার সংখ্যা দেখে বন্যপ্রাণী পাচারের সঠিক পরিসংখ্যান মিলবে না। কারণ, যে সংখ্যক বন্যপ্রাণী বছরে পাচার হয়, তার মধ্যে মামলা হয় খুবই কম। সাধারণত অভিযোগ এলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ ও মামলা করে পুলিশ। তবে এ সংক্রান্ত অভিযোগও আসে খুবই কম। কারণ, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার যে অবৈধ ও আইনত দণ্ডনীয়- এ বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই সচেতন নয়।

গত বছরের (২০২২ সালের) ২৫ নভেম্বর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ‘এক্সপ্লোরিং মার্কেট-বেজড ওয়াইল্ড লাইফ ট্রেড ডাইনামিকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত ওই গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ১৩ জেলায় প্রকাশ্যে বন্যপ্রাণী কেনাবেচা চলে। এসব জেলা থেকে বন্যপ্রাণী ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আনা হয়। পরে সেগুলো দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে পাচার করা হয় মোটা টাকার বিনিময়ে।

ওই প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ থেকে জীবন্ত প্রাণী সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, বিষধর সাপ, তক্ষক, ছোট সরীসৃপ প্রভৃতি। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওসেও পাচার হচ্ছে এসব প্রাণী।

আরও পড়ুন: হাতি-হরিণ-কুমির-ময়ূর যেভাবে বৈধভাবেই পালন করা যায় 

শুধু গোপনে নয়, প্রকাশ্যেও বিক্রি ও পাচার হচ্ছে এসব বন্যপ্রাণী। সাধারণত বনের আশপাশের এলাকাগুলোতে বন্যপ্রাণী বিক্রির প্রকাশ্য ও গোপন বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে হয় আগাম দরদাম, এরপর পাচারকারী বন থেকে প্রাণীগুলো ধরে এনে বিক্রি করেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে বন্যপ্রাণী বেচাকেনায় ১৩ জেলার নাম উঠে এসেছে। সেগুলো হলো- সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, রাঙামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান ও গাজীপুর।

 

বাংলাদেশ থেকে জীবন্ত প্রাণী সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, বিষধর সাপ, তক্ষক, ছোট সরীসৃপ প্রভৃতি।

 

নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় বন্যপ্রাণী বিক্রি হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। সাধারণত জনবহুল স্থান, যেমন- বাসস্ট্যান্ড, হাট ও বাজারে হরহামেশাই কেনাবেচা হয় এসব প্রাণীর অঙ্গ-প্রতঙ্গ। সাধারণত বনরুই, বেজি, সাপসহ নানা ধরনের প্রাণীর তেল, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। ক্রেতাদের বড় অংশ এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ওষুধ হিসেবে কার্যকর মনে করেন। এর বাইরে ব্যাগ, বেল্ট, গৃহশয্যা ও উপহারের সামগ্রী এবং গয়না তৈরিতে বন্যপ্রাণীর চামড়া, দাঁত ও নখের বিপুল ব্যবহার আছে। ফলে জীবিত ও মৃত বন্যপ্রাণীর বিপুল চাহিদা থাকায় এর পাচার এবং ব্যবসাও বেশ রমরমা।

আরও পড়ুন: তক্ষকসহ আটক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একজন কারাগারে 

দেশের বিত্তশালী সম্প্রদায়ের অনেকেই অননুমোদিতভাবে বন্যপ্রাণী পোষেন। কারও কারও বাড়িতে শোভা পায় বন্যপ্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এর মধ্যে রয়েছে গন্ডার বা হরিণের শিং, হাতির দাঁত, বাঘছাল ইত্যাদি। কেউ শখ পূরণ করতে গিয়ে বা আভিজাত্যের প্রদর্শন হিসেবে এ ধরনের বন্যপ্রাণী বা প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রাণী বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বড় অংশ অবৈধভাবে সংগ্রহ করা।

এদিকে, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ চান সংশ্লিষ্টরা। আসামিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করলে বন্যপ্রাণী পাচার কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।

বন্যপ্রাণী গবেষক শাহরিয়ার সিজার রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বন্যপ্রাণী পাচার একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। এটা বাংলাদেশের বড় সমস্যা। এটা পাচার রোধে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) তাপস কুমার পাল জাগো নিউজকে বলেন, বন্যপ্রাণী পাচার জঘন্য অপরাধ। বন্যপ্রাণী পাচার রোধে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আইনের মাধ্যমে আসামিদের শাস্তির আওতায় আনলে পাচার অনেকটা কমে আসবে।

চলতি বছর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় হনুমান উদ্ধারের যে মামলা হয়- ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই রাসেদুল ইসলাম। জাগো নিউজকে রাসেদুল ইসলাম বলেন, আসামিরা হনুমান শিকার করে বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে নিজেদের হেফাজতে রাখেন তা প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ হয়েছে। তাদের সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত। তাদের গ্রেফতারেও চেষ্টা চলছে।

jagonews24

আরও পড়ুন: সাপের খবর পেলেই ছুটে যান রাকায়েত 

ওই মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী শারমিন জাহান টুম্পা জাগো নিউজকে বলেন, শাজ উদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে হনুমান দিয়ে খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীর ধলপুর মাতৃসদন হাসপাতালের সামনে খেলা দেখাতে এসে গ্রেফতার হন তিনি।

তবে আসামি কাউসার এ বিষয়ে কিছু জানেন না দাবি করে আইনজীবী শারমিন জাহান টুম্পা বলেন, ঘটনার সময় কাউসার ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময় সন্দেহমূলকভাবে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আশা করছি তিনি জামিন পাবেন।

আইন কী বলছে
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের ২০১২ এর ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন লাইসেন্স বা অনুমতি নেওয়া ছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনো বন্যপ্রাণী শিকার ও সংগ্রহ করতে পারবেন না। একইভাবে অনুমতি ছাড়া কোনো উদ্ভিদ ইচ্ছাকৃতভাবে উঠানো, উপড়ানো, ধ্বংস বা সংগ্রহ করা যাবে না।

 

বিত্তশালীদের অনেকেই অননুমোদিতভাবে বন্যপ্রাণী পোষেন। শখ পূরণ বা আভিজাত্যের প্রদর্শন হিসেবে এ ধরনের বন্যপ্রাণী বা প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রাণী বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বড় অংশ অবৈধভাবে সংগৃহ করা।

 

অপরাধের সাজা
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের ২০১২ এর ৩৪(খ) ধারায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স বা অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি অন্য কারও কাছ থেকে কোনো বন্যপ্রাণী, বন্যপ্রাণীর কোনো অংশ, মাংস অথবা ওই প্রাণী থেকে উৎপন্ন দ্রব্য বা বনজদ্রব্য কেনাবেচা বা আমদানি-রপ্তানি করলে তা অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। এছাড়া লাইসেন্স বা অনুমতি ছাড়া কোনো উদ্ভিদ অথবা তা থেকে উৎপন্ন দ্রব্যাদি কেনাবেচা বা আমদানি-রপ্তানি করলে তাও অপরাধ। এ অপরাধে তিনি সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ আবারও করলে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন বছরের করাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আরও পড়ুন: শিয়ালের মাংসে ভূরিভোজ 

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ এর (বি/ডি) ধারায় বলা হয়েছে, বর্তমানে বলবৎ কোনো আইন অনুযায়ী কিছু পণ্য বাংলাদেশে আনা (আমদানি) নিষিদ্ধ। ওইসব পণ্য বিক্রি, প্রদর্শন এবং বিক্রির জন্য দখলে বা নিয়ন্ত্রণে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এক বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জেএ/কেএসআর/জিকেএস