ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

বরফের দেশ

খান মুহাম্মদ রুমেল | প্রকাশিত: ০৩:৪২ পিএম, ১০ জুলাই ২০২৫

কুড়ি বছরের বেশি সময় পর রতন কাকার সঙ্গে দেখা। নিউইয়র্কে। সিক্স লেন থেকে টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করে ফিরছিলাম, হেঁটেই। ঠান্ডা পড়েছে ভীষণ। আবহাওয়া দফতর থেকে একটু পরপর জানানো হচ্ছে, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হতে। অফিস শেষে বের হওয়ার পথে মনে পড়ে রাতে খাওয়ার মতো কিছু নেই বাসায়। গাড়িটা নষ্ট হয়ে আছে দুদিন। ঠিক করা হয়ে উঠছে না। ফলে হেঁটেই বাসায় যাওয়া-আসা করছি। তাছাড়া অফিস থেকে বাসা—ছয়-সাত মিনিটের হাঁটা পথ। পেজা তুলার মতো তুষার পড়ছে। প্রথম যেদিন তুষারপাত দেখি আর সব বাঙালির মতো আমিও আনন্দে দিশেহারা হয়েছিলাম। এখন সেই উচ্ছ্বাস কিছুটা কমলেও মুগ্ধতার রেশ কাটেনি একেবারে। আজ বরফ বিছানো পথে হাঁটার সময় হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন ডাকে—বিশুদ্ধ বাংলায়!
—অ্যাই, অ্যাই শুনছো?
ডাক শুনেও আমি পেছন ফিরে তাকাই না। এই মার্কিন শহরে বাঙালি গিজগিজ করে অনেকটা ঢাকার মতোই। সন্ধ্যার পর রাস্তা ধরে হাঁটতে গেলে ম্যাডিসন স্কয়ার আর কারওয়ান বাজার কিংবা পল্টনের কোনো পার্থক্য থাকে না! সুতরাং বাংলা ডাক শুনেও আমি থামি না। তবে ডাকটা আরও জোরালো হয় মুর্হূতেই। দ্রুত পায়ে মানুষটা আমার দিকেই হেঁটে আসছে বুঝতে পারি।
—তুমি ফজলু ভাইয়ের ছেলে না? কী যেন নাম তোমার? পাভেল। আমি আফজালুর রহমান। তোমার রতন কাকা। চিনতে পেরেছো আমাকে?
—জি অবশ্যই চিনেছি কাকা। এখানে কী করেন কাকা? কবে এলেন?
—এসেছি এই তো কিছুদিন হলো। কোম্পানি থেকে তিন সপ্তাহের একটা ট্রেনিংয়ে পাঠিয়েছে। এই বয়সে এসব হয় বলো! হা হা হা।
—তাহলে তো মনে হচ্ছে থাকবেন আরও কিছুদিন?
—হুম, আরও সপ্তাহ দুয়েক আছি।
—কাছেই আমার ফ্ল্যাট। চলুন না কাকা, একবার ঘুরে আসবেন!
—আজকে না, যাবো আরেক দিন। তুমি এখন কী করছো?
—বেল ল্যাবে আছি কাকা, রিসার্চার হিসেবে।
—ওয়াও, ওয়েলডান। তুমি বরং চলো আমার ওখানে। কথা বলার লোক পাই না। তুমি গেলে দুজন জমিয়ে আড্ডা দেবো।
—না, কাকা। আমি এখন যেতে পারবো না। আপনিই বরং চলুন না আমার সঙ্গে।
—না রে, যে ঠান্ডা পড়েছে। রাতে ফিরতে ঝামেলা হবে খুব। সকালে আবার ট্রেনিং আছে। তার চেয়ে তুমি আমার সঙ্গে গেলে ভালো হতো।
—ঠিক আছে কাকা, একদিন আসবো আপনার ওখানে।

এরপর রতন কাকা চলে যান। আমিও হেঁটে হেঁটে বাসায় ঢুকে কাপড়-জামা বদলে বড় জানালাটার কাছে বসি। স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে দেখা যায় নিউইয়র্কের রাতের আকাশ। অঝোরে তুষার ঝরছে। যেন আকাশজুড়ে উড়ছে অজস্র শিমুল তুলা। তখন হঠাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একুশ-বাইশ বছর আগের ঢাকার এক রোদজ্বলা দুপুর। আমি আর আব্বা সেদিন গিয়েছিলাম রতন কাকার বাসায়। সব আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসতে থাকে। ডোর বেল চাপলে দরজা খুলে দিয়েছিলেন এক বয়স্ক মহিলা। হয়তো কাকার বাসার কাজের লোক। আমি আর আব্বা হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে ছিলাম সোফায়। মিনিট দশেক পরে এসেছিলেন রতন কাকা।
—দাদা জুতাটা বাইরে রেখে আসেন। ঘরটা একদম ময়লা হয়ে গেছে।
রতন কাকার কথা শুনে বসা থেকে উঠে আব্বা ময়লা জুতাজোড়া বাইরে রেখে আসতে যান। হাতে করে আমার জুতাগুলোও নিয়ে যান! জুতা রেখে আসার পরে আব্বা হাত দিয়ে গায়ের পাঞ্জাবিতে হাত মোছেন। তারপর আলগা করে সোফায় বসেন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এ বাসায় সবকিছু স্বচ্ছ কাচের মতো। কোথাও এক কণা ধুলো পড়ে নেই। দেওয়ালে টাঙানো দামি দামি সব পেইন্টিং। আসলে পেইন্টিং আমি বুঝি না। কিন্তু যেহেতু রতন কাকার মতো সৌখিন মানুষের বসার ঘরের দেওয়ালের পেইন্টিং। তাই ধারণা করি এগুলো অবশ্যই খুব দামি। ঘরের একপাশের প্রায় পুরোটা দেয়ালজুড়ে অ্যাকুরিয়াম। রঙিন মাছেরা ঘুরছে। জলে বুদ্বুদ তুলে একটা নীল পরি অ্যাকুরিয়ামজুড়ে ঘুরছে। এত বড় অ্যাকুরিয়াম জীবনে এই প্রথম দেখলাম। সোফার সামনের নিচু টেবিলটাতে ছোট-বড় অনেক রকম শো পিস। ক্রিস্টালের, পোর্সেলিনের, ব্রোঞ্জের, রুপার। দুয়েকটা সোনারও ছিল কি? কে জানে, হয়তো থাকতেও পারে। চারপাশের দেওয়ালে কায়দা করে লাগানো লাইট থেকে ঝরছে স্বচ্ছ আলো। সব মিলিয়ে খুব জৌলুস। এত সুন্দরের মাঝে শুধু আমার আব্বার গায়ের পোশাক ছিল খুব মলিন। যদিও অন্য সময় তেমন মলিন মনে হয়নি। এখন এ বাসায় আসার পরে বেশি মলিন মনে হচ্ছিল। খুব ম্রিয়মান লাগছিল। আব্বা অকারণেই তার পাঞ্জাবিটা বারবার হাত দিয়ে ডলে মসৃণ করার চেষ্টা করছিলেন। আমি তাকিয়ে দেখি, আব্বার পাঞ্জাবিতে একটা হলুদ দাগ লেগে আছে। মা পাঞ্জাবি ধুয়ে দিয়েছেন ঠিকই। তবে দাগ তুলতে পারেননি। আব্বার গুটিয়ে বসা দেখে আমিও আব্বার মতো গুটিয়ে বসি। যেন পায়ের ধূলো ফ্লোরে না লেগে যায়। এটাও খেয়াল করি আব্বার দেখাদেখি।

আব্বা হেসে হেসে কথা বলছিলেন। রতন কাকা খুব গম্ভীর হয়ে ছিলেন। এমন গম্ভীর হয়ে থাকতেন আমার স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক মণ্ডল স্যার। স্যারকে কখনো হাসতে দেখিনি। শুধু আমাদের এসএসসির রেজাল্টের দিন মণ্ডল স্যারের মুখে হাসি দেখেছিলাম। রতন কাকাও কি হাসেন না? না তিনি হাসেন। রতন কাকাকে তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হাসতে দেখেছি। চাচির সঙ্গেও হেসে হেসেই কথা বলেন। তবে আব্বা আসায় তখন গম্ভীর মুখ করে বসে ছিলেন।
—পাভেল তো খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। ভাবছি ওরে ঢাকায় কলেজে পড়াবো। নটর ডেমে ভর্তি পরীক্ষা দিসিলো। চান্স পাইসে। কথাটা বলেই বাবা জনকণ্ঠ পত্রিকার একটা কপি এগিয়ে দেন রতন কাকার দিকে। এই কাগজের ভেতরের দিকের একটা পাতায় ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ছাপা হয়েছে।
রতন কাকা গম্ভীর মুখে কাগজটা হাতে নেন। তারপর পাশে রেখে দেন আলগোছে। বাবার মুখে তখনো ঝলমলে হাসি।
—চান্স পেয়েছে সে তো খুবই ভালো কথা। তাহলে ভর্তি করে দেন।
—হুম, সেইটাই ভাবতেসি। তবে ভর্তি হইতে টাকা লাগে সাড়ে আট হাজার। এছাড়া ওরে কিছু জামা-কাপড় কিনে দেওয়া দরকার। সব মিলিয়ে কিছু টাকা যদি দিতি, খুব উপকার হইতো! এই ধর হাজার বিশেক টাকা দিলি, আমি মাস দুয়েক পরই ফেরত দিয়ে দেবো।
—দেখেন ফজলু ভাই, এখন আমার কাছে টাকা নেই। আর দেখেন কিছু একটা হলেই আমার কাছে ধার নিতে আসবেন, আমি টাকা দিয়ে দেবো এমনটা ভেবে বসে থাকেন কেন?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

রতন কাকার এ কথা শুনেও দেখি আব্বার মুখে একই হাসি লেপ্টে আছে। আব্বার কি মন খারাপ হয় না? নাকি মানুষ অভাবের দিনে সবকিছু সহ্য করে নিতে পারে। আব্বার মুখে একইরকম মৃদু হাসি, এই হাসির নাম কি তবে অভাবের হাসি। যত অপমান করা হোক, মুখে হাসি রেখে সবকিছু সহ্য করতে হবে।

রতন কাকা ঘরের ভেতরে চলে যান। তখনই রতন কাকার বড় ছেলে আহনাফ আসে। আহনাফ আমার বয়সী, আমার মতো সেবার সে-ও এসএসসি পাস করেছিল। আহনাফ আর আমি এক বয়সী হলেও দুজনের জীবন আলাদা। অনেক আগে একবার এসেছিলাম এ বাসায়। দেখেছিলাম আহনাফের ঘর ভর্তি খেলনা আর আমার তখন শুধু একটা ভাঙা হেলিকপ্টার ছিল, যা অনেক আগে আব্বা কিনে দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

আহনাফ এসেই আমার পাশে বসে।
—হেই পাভেল, কী অবস্থা তোমার? খুব ফাটাফাটি রেজাল্ট করসো শোনলাম!
—করসি আর কি মোটামুটি। ম্লান মুখে হাসি। বুঝতে পারি হাসিটা আমার মুখে বাবার মতো ফুটছে না।
—আচ্ছা, শোনলাম গ্রামের দিকে খুব নকল হয় পরীক্ষায়! নকল-টকল করে এত নম্বর তোলো নাই তো আবার? কথাটা বলেই চোখ টিপে হাসে আহনাফ।
—আমি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। ওইটা আমাদের জেলার সেরা স্কুল। কখনো নকল-টকল হয় না আমাদের দিকে।
—তুমি কখনো বরফের ভেতরে হেঁটেছো?
—না।
—আমরা বরফের দেশে যাচ্ছি ঘুরতে।

ঘরের ভেতর থেকে রতন কাকা ডাক দিলে ভেতরে চলে যায় আহনাফ। খানিক সময় পর রতন কাকা ঘর থেকে বের হয়ে এসে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন আব্বার হাতে। চেয়েছিলেন হাজার বিশেক। রতন কাকা দিলেন পাঁচ! তবুও এই টাকাটাই হাসিমুখে নেন আব্বা।

বের হয়ে আসি রতন কাকার বাসা থেকে। আমরা দুজনেই রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। কাকার ঘরের ভেতরে ঠান্ডা বাতাস ছিল, এখানে ভীষণ গরম। বাইরে অনেক রোদ। আব্বা আর আমি হাঁটছিলাম। আব্বার মুখে তখন হাসি ছিল না। গম্ভীর হয়ে ছিলেন। আব্বা মুখে হাসি রাখতেন, কারো কাছে টাকা ধার করতে গেলে। এই যেমন দোকানে বাকিতে বাজার নিতে হলে তখন মুখে একটা হাসি রাখতেন। রতন কাকার কাছে টাকা ধার চাইতে গেলে মুখে হাসি রাখতেন। আব্বা বিশ্বাস করতেন, তার হাসিতে অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। আদতে কিছুই সমাধান হতো না। টাকা দিতে না পারায় দোকানদার বাজার রেখে দিতো, রতন কাকা গম্ভীর মুখে না বলে দিতেন। কখনো দান করার মতো অল্প কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিতেন।

বিজ্ঞাপন

আব্বার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম—আব্বা বরফের দেশ কোথায়? আব্বা কোনো উত্তর দেন না। আমি আবার জিজ্ঞেস করি—আব্বা সেখানে কি বরফ দিয়ে ঘর বানানো? আব্বা এবারও কোনো উত্তর দেন না।
আমি মনে মনে বরফের দেশের একটা ছবি আঁকতে থাকি।
—শরবত খাবি? আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন।
—খাবো।
রাস্তার পাশেই একটা লোক বরফ দিয়ে লেবুর শরবত বিক্রি করছিলেন। প্রতি গ্লাস দশ টাকা। আব্বা দুই গ্লাস লেবুর শরবত কেনেন।

আমরা দুজন বাস স্টপেজের দিকে হাঁটতে থাকি। রামপুরা ব্রিজের কাছ থেকে একটা লোকাল বাসে উঠি, গুলিস্তান যাবো বলে। আব্বা আর আমি আজই চলে যাবো নরসিংদীর শিবপুরে—আমাদের গ্রামে। বাসের হেলপার আমাকে ঠেলেঠুলে কোনোমতে ভেতরের দিকে ঢোকায়। মানুষের ঘামের কটুগন্ধের মধ্যে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে কোনো রকম দাঁড়িয়ে থাকি। আব্বা ঝুলতে থাকেন বাসের দরজায়।

আজ এত বছর পর সেই দৃশ্যটা হঠাৎ কেন মনে পড়লো? সন্ধ্যায় রতন কাকার সঙ্গে দেখা হওয়ার কারণেই কি পুরোনো সেই স্মৃতি জেগে উঠলো!

বিজ্ঞাপন

তাকিয়ে দেখি নিউইয়র্কের আকাশজুড়ে অসংখ্য তারার মেলা। তারগুলো সব স্থির হয়ে আছে আকাশে। এই যে বিরামহীন তুষার ঝরছে। ঢেকে দিচ্ছে আশপাশের সব গাছপালা। সুনসান নীরব পথে জমছে বরফের স্তূপ—এসবে তারাদের কিছুই যায় আসে না। তারারা একেবারেই নির্বিকার। আব্বাকে ভীষণ মনে পড়ছে। আমি মনে মনে ডাকি—আব্বা… আব্বা… ও আব্বা। আব্বা কি শুনতে পান?

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন