ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

একের পর এক অনিয়মে জর্জরিত রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি

সালাহ উদ্দিন জসিম | প্রকাশিত: ০৬:৩৮ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

স্বেচ্ছাসেবা দানকারী সংস্থা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। বিভিন্ন দুর্যোগে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো সংস্থাটির অন্যতম কাজ। অথচ বিগত দেড় বছর সংস্থাটিতে নানান কারণে গোলযোগ লেগেই আছে। একের পর এক অনিয়ম, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত সংস্থাটি। নেই উল্লেখযোগ্য সেবা কার্যক্রমও।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয়। সংকটের শুরু মূলত বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই। ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) নিয়োগে অনিয়ম, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতিসহ দুজন অবসরপ্রাপ্ত পরিচালককে ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, নারী নিপীড়নের শাস্তি মওকুফ করে পদায়ন, দুর্নীতি করে শাস্তিপ্রাপ্তদের তোষণ, কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট নিয়োগে বিধিবহির্ভূত সিদ্ধান্তসহ নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন চেয়ারম্যান। তার এসব অনিয়মে দ্বিমত করায় রোষানলে পড়েছেন খোদ বোর্ডের একাধিক সদস্য। নিজেরাই দুদক ডেকে প্রতিষ্ঠানের সম্মানহানি করেছেন।

চেয়ারম্যান নিজেই বোর্ড সদস্য ও অধীনস্তদের বিরুদ্ধে নিউজ করতে গণমাধ্যমে বার্তা পাঠান। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে তার অনিয়মে দ্বিমত করায় হয়েছেন শত্রু।

এসব অনিয়ম সামনে এনে গত ৮ অক্টোবর থেকে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চেয়ে টানা প্রায় এক সপ্তাহ আন্দোলন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবকরা। আন্দোলনকারীদের কঠোরভাবে দমন করায় স্থবির অবস্থা। তবে রয়ে গেছে চাপা ক্ষোভ। এরপরও বন্ধ হয়নি চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারিতা।

আন্দোলন চলাকালীন সংস্থার যুব ও স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের উপ-পরিচালক মুনতাসির মাহমুদকে চাকরিচ্যুত করেন চেয়ারম্যান। এ বিষয়ে মুনতাসির মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকরা কঠোর পরিশ্রম করেন, বিনিময়ে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান। অথচ এই স্বেচ্ছাসেবকদের নানা সময়ে দ্বিমত করার কারণে মারতে গেছেন চেয়ারম্যান, অপমান-হেনস্তা করেছেন। এদের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদে বহিরাগত দিয়ে হামলা চালিয়েছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের পক্ষে কথা বলায় আমাকেও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।’

‘যিনি তার মতের বিরুদ্ধে যান, তার ওপর নেমে আসে চেয়ারম্যানের খড়্গ। এমন স্বৈরাচারী আচরণ ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্য তো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাজার মানুষ জীবন দেয়নি।’

মুনতাসির মাহমুদ বলেন, ‘এই চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতিসহ দুজন আওয়ামী লীগ সমর্থককে অবসরের পর এনে চুক্তিভিত্তিক পরিচালক নিয়োগ দিয়েছেন। অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদের দোসরদের লালন করছেন। অথচ স্বৈরাচারবিরোধী কর্মকর্তাদের অযৌক্তিক বদলি ও চুক্তি বাতিলসহ নানা অযৌক্তিক ও আক্রোশমূলক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। প্রতিটি নিয়োগে অনিয়ম করে নিজের লোক নিয়োগ দিচ্ছেন, যোগ্য আবেদনকারীদের নিচ্ছেন না। এমন চেয়ারম্যান আমরা চাই না।’

যদিও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপি-এনসিপির একাধিক ব্যক্তির যোগসাজশে একটি গ্রুপ আমার বিরুদ্ধে মব করছে।’

স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে তার নিয়োগকারী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি তার নিজস্ব আইনে চলে। আমরা হস্তক্ষেপ করার পক্ষপাতি নই।’ অথচ বর্তমান চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদ গঠন ও তাদের মেয়াদ বৃদ্ধি—দুটোই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশে হয়েছে।

এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আর পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের জন্য তাকে তিন মাস সময় দিয়েছি। শুধু নির্বাচন করে তিনি চলে যাবেন।- স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম

এসব অনিয়মের প্রমাণ নিয়ে বক্তব্য নিতে গেলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আর পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের জন্য তাকে তিন মাস সময় দিয়েছি। শুধু নির্বাচন করে তিনি চলে যাবেন।’

তবে, পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন আয়োজনে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যানের কার্যক্রমেও। বরং তিনি অভ্যন্তরীণ কোন্দল জিইয়ে রেখে নির্বাচন পেছানো ও পদ আঁকড়ে থাকার কৌশল নিয়েছেন। একটি জেলার তথ্য তুলে ধরে সেখানে নির্বাচন সম্ভব নয়—বলেও এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট নিয়োগে অনিয়ম

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যোগাযোগ বিভাগের ‘কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট’ পদে নিয়োগে অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনকে নিয়োগ দিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বিভাগের পরিচালক আরিফা মেহরা সিনহা নিয়ম ভঙ্গ করে ডেডলাইন পার হওয়া এক প্রার্থীর (মো. মিদুল ইসলাম মৃদুল) আবেদন নিজে জমা দেন এবং তাকে শর্টলিস্টে অন্তর্ভুক্ত করেন।

আরও পড়ুন
এখনো নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টে দুদকের অভিযান
মানবতার সেবায় এক নিবেদিত নাম রেড ক্রিসেন্ট

তদন্তে জানা যায়, নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থী তার কর্মজীবনের তথ্য ভুয়া দিয়েছেন এবং একাধিক গণমাধ্যমে চাকরি করার দাবি মিথ্যা। আরিফা সিনহার নিজস্ব নিয়োগ নিয়েও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। ছুটি ও প্রশাসনিক বিধি লঙ্ঘনের ঘটনাও পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা এই অনিয়মের স্বাধীন তদন্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি জানান।

অযৌক্তিক বদলি ও পদায়ন

প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে পুরোনো ও সিনিয়র পরিচালক জাফর ইমাম সিকদারকে চট্টগ্রামে বদলি করে উপ-পরিচালক সমমর্যাদার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে ‘মাফিয়া’ আখ্যায়িত করেন চেয়ারম্যান। তার বিরুদ্ধে নিউজ তৈরি করে গণমাধ্যমেও পাঠান। কিন্তু দীর্ঘ ৩৩ বছরের চাকরিজীবনে তার বিরুদ্ধে একটি শোকজও দেখাতে পারেননি। লিগ্যাল বিভাগের খুরশিদ আলম (জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নেতা) ইউনিট লেভেল কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হয়েছেন, অথচ এটি তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আসিফ আলমাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা। তার চাকরি প্রজেক্টে বদলিযোগ্য নয়, অথচ তাকেও রাজশাহী জেলা ইউনিটে বদলি করেছেন।

গাড়িচালক রহিমকে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বদলি করেছেন—সেখানে কোনো গাড়ি নেই। একজন দক্ষ কর্মীকে বসিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে। সুমন মিয়া ও লিটন কুমারকেও বদলি করেছেন।

সম্প্রতি, তিনদিনের সফরে যান সংস্থাটির মহাসচিব। এই সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক শাহানা জাফরকে মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়ে তিনদিনে ইচ্ছামতো বদলি-পদায়নসহ নানা আদেশ করিয়েছেন। রেড ক্রিসেন্টের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেন, এত সংখ্যক বদলি গত ১০ বছরেও হয়নি। যদিও এর সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি।

নারী হেনস্তার শাস্তি বাতিল

প্রতিষ্ঠানটিতে আওয়ামী লীগের আমলে (২০২৩) নারী নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত উপ-সহকারী পরিচালক মইন উদ্দিন মঈনকে পদাবনতি করে ফিল্ড অফিসার পদে টাঙ্গাইলে পাঠানো হয়। বর্তমান চেয়ারম্যান নিয়মবহির্ভূতভাবে এক বছর পর রিভিউ করে তাকে এই শাস্তি থেকে মুক্তি দিয়ে ভূতাপেক্ষভাবে আগের পদ ফিরিয়ে দিয়ে মইন উদ্দিন মঈনকে মানবসম্পদ বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। যদিও রেড ক্রিসেন্টের নিয়মে তিন মাসের মধ্যে রিভিউ করার বিধান আছে।

এ বিষয়ে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগকারী একজন সিঙ্গেল মাদার। তার পোশাক ও বাহ্যিক আচরণ দেখে আমি বিব্রত হই। অন্যদিকে মইন উদ্দিন একজন ভদ্র, চরিত্রবান ও দক্ষ অফিসার।’

অভিযোগকারী নারী কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পর দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। রেড ক্রিসেন্টের নিজস্ব নীতিমালায় নারী নির্যাতনের বিচার হওয়া মাত্রই বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার কথা। সেটি এক বছর পরে রিভিউ করে বাতিল করা হলো—এটা কোনোভাবেই নিয়মতান্ত্রিক নয়। আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও হতবাক।’

পাশাপাশি উপ-পরিচালক সাদ মো. জহিরের নামে অভিযোগ করায় আরেক নারী সহকর্মীকেই সতর্ক করেছেন। এমনকি ‘বাড়াবাড়ি করলে’ ভিকটিমকে উল্টো বদলি করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন পরিচালক ডা. শাহানা জাফর।

তারা (আন্দোলনকারী) দুর্নীতি করেনি, চাঁদাবাজি করেনি। ওরা রেড ক্রিসেন্টের পুরোনো দুর্নীতিগ্রস্ত আওয়ামী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আওয়াজ তুলেছিল। দুদক দিয়ে মিথ্যা ন্যারেটিভ দিয়ে কীভাবে আমাকে হেনস্তা করেছে আপনাদের অনেকেরই মনে আছে।- রেড ক্রিসেন্টের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ডা. মাহমুদা আলম মিতু

ভিকটিমদের মানসিক বিকারগ্রস্ত প্রমাণ করতে মরিয়া ডা. শাহানা। চেয়ারম্যানের নির্দেশে ভিকটিমদের হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের মনোচিকিৎসক দিয়ে বিকারগ্রস্ত প্রমাণের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে একজন ভিকটিমকে হাসপাতালের প্রধান মনোচিকিৎসকের কাছে কাউন্সেলিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে।

ফ্যাসিস্টবিরোধীরা কোণঠাসা, আশ্রিত দোসররা

নতুন বোর্ড গঠন, নানাবিধ নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ, ইচ্ছামতো বদলি—এসবের মাধ্যমে কয়েকজন কর্মকর্তা—বিশেষত যারা সিস্টেমগত অনিয়মকে বাধা দিচ্ছে—তাদের কোণঠাসা করা হয়েছে। নতুন চক্রটি তাদের কোণঠাসা করার জন্য বদলিসহ এমন কিছু নেই যা করার চেষ্টা করেনি।

আওয়ামী লীগের দোসর বা বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, কারণ তারা তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বাধা হচ্ছেন না। ইতোমধ্যে পাঁচ উপ-পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে পরিচালক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজনই আওয়ামী লীগের—বঙ্গবন্ধু পরিষদ রেড ক্রিসেন্ট শাখার সদস্য রেজাউল করিম, আওয়ামী লীগের জন্য প্রকাশ্যে ভোটের প্রচারণায় অংশ নেওয়া এ এস এম আক্তার এবং আওয়ামী সমর্থক সাবিনা ইয়াসমিন।

এর মধ্যে এ এস এম আক্তার চলতি মাসে চাকরি থেকে অবসর নিলেও ডা. শাহানার ইশারায় চেয়ারম্যানের নির্দেশে তাকে আবার চুক্তিভিত্তিক পরিচালক হিসেবে মানবসম্পদ বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে চুক্তির মেয়াদ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে অফিস আদেশ দেওয়া হয়।

এর বাইরে ২৮ জন কর্মচারীকে কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগের। অনেকের নাম বঙ্গবন্ধু পরিষদের তালিকায় পাওয়া গেছে। এরা হলেন—ইসরাত জাহান পুষ্প, ফাতেমা খাতুন, বিলকিস পারভীন, মো. ইসরাফিল তালুকদার, মো. হুমায়ুন কবির, রাবেয়া আক্তার লিপি, তাহমিনা আহমেদ ও মো. হায়দার আলী।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বিভাগের পরিচালক আরিফা মেহরা সিনহা ২০২৪ সালে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে চাকরি করা এই কর্মকর্তা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ছয় মাসে ১২০ দিন ছুটি কাটিয়েছেন। সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা সাধারণ ও অসুস্থতাজনিত ছুটি ছাড়া অর্জিত ছুটি পান না। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করলেও মানেননি; বরং চেয়ারম্যানকে ‘ম্যানেজ’ করে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নেন।

আওয়ামী সমর্থক ফিল্ড অফিসার কাজী আসাদকে এই চক্র পাবনা থেকে ঢাকায় বদলি করেছে। তার স্ত্রী মনিরা বেগমকে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগের জুনিয়র অফিসার থেকে পদোন্নতিসহ স্থায়ী করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, যা সামনে বোর্ডে উপস্থাপন হবে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্থায়ীকরণ বিশেষ আদেশে স্থগিত রাখা হয়েছে।

রেড ক্রিসেন্টের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ডা. মাহমুদা আলম মিতু বলেন, ‘ছয় মাস আগে হেডকোয়ার্টার থেকে বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতিসহ চিহ্নিত সব আওয়ামী লীগের অফিসারদের বদলি করা হয়েছে। মহাসচিবের তিনদিনের ছুটিতে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ডিরেক্টরকে বসিয়ে তিনদিনে সব আওয়ামী লীগের অফিসারদের ফেরত আনা হলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট নিষেধ থাকার পরও মাত্র তিন দিনে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে দিয়ে ৪০ জনকে মনমতো বদলি করে আওয়ামীকরণ করা হলো। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করায় স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেটানো হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তারা (আন্দোলনকারী) দুর্নীতি করেনি, চাঁদাবাজি করেনি। ওরা রেড ক্রিসেন্টের পুরোনো দুর্নীতিগ্রস্ত আওয়ামী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আওয়াজ তুলেছিল। দুদক দিয়ে মিথ্যা ন্যারেটিভ দিয়ে কীভাবে আমাকে হেনস্তা করেছে আপনাদের অনেকেরই মনে আছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এখনো যুদ্ধ করতে হচ্ছে অফিসিয়ালি। এর চেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাই।’

দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পরিচালককেই স্বাস্থ্য বিভাগে পদায়ন

স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডা. শাহানা জাফর—আওয়ামী লীগের আমলেই দুর্নীতির অভিযোগে বদলি হন তহবিল সংগ্রহ বিভাগে। অথচ নতুন সরকার এলে তিনি ভিকটিম সাজেন এবং পরিচালক (স্বাস্থ্য বিভাগ) পদে ফিরে আসেন। সম্প্রতি মহাসচিব বিদেশ সফরে গেলে তিন দিনের জন্য তাকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়ে অযৌক্তিক সব বদলি করিয়ে নিয়েছেন চেয়ারম্যান। অথচ এই কর্মকর্তাই গত জুলাই মাসের ১ তারিখে স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত ডা. নাজমুস সাকিবের চুক্তির মেয়াদ বাড়াননি। নিয়ম অনুযায়ী, চুক্তির মেয়াদ না বাড়ালেও এক মাস আগে জানাতে হয়। কিন্তু সেটি অমান্য করে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বের করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্টে রীতি অনুযায়ী প্রকল্পের ফান্ড থাকলে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়।

কিছু বিষয়ে ব্যত্যয় আছে এখানে। আমি আসার পর নানান প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছি। নানান অভিযোগও পেয়েছি। সমাধানেরও চেষ্টা করছি।- চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আজিজুল ইসলাম

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডা. শাহানা জাফর জাগো নিউজকে জানান, তিনি নিজেই ভিকটিম ছিলেন। তাকে এতদিন অন্যায়ভাবে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন পটপরিবর্তনের পর তিনি স্বপদে ফিরেছেন।

নিয়মবহির্ভূত নতুন নিয়োগ

৫ আগস্টের পর বোর্ড পুনর্গঠন, চেয়ারম্যান-মহাসচিব নিয়োগের পাশাপাশি ভেতরে বেশ কয়েকজনকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এগুলোতে মানা হয়নি প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগবিধি। এরা হলেন—সদর দপ্তরে চেয়ারম্যানের পিএস-১ সোহাগ মিয়া ও গাড়িচালক খান এনামুল সুলতান। রক্তকেন্দ্রে দুজন অভ্যর্থনা কর্মী সীমা সাহানা রাকা ও আবদুল্লাহ আল সাকিব নিয়োগ পেয়েছেন। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি সহকারী এস কে সালাউদ্দিনকে পদোন্নতি দিয়ে অফিসার করে বেতন ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, বছরে ইনক্রিমেন্ট হয় মূল বেতনের ৫ শতাংশ।

এর মধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আবেদনকারীদের বিবেচনা করা হয়নি, হয়নি কোনো বাছাই বা পরীক্ষা। এর বাইরে গিয়ে অবসরে যাওয়া দুজন পরিচালককে ফের একই পদে বসানো হয়েছে। তারা হলেন—এ এইচ এম মইনুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমানের স্ত্রী ছিলেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বোর্ডের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী। তার ভাই পলাতক পুলিশের ডিআইজি হাফিজ আখতার।

চেয়ারম্যানের পিএস নিয়োগ: যত স্বেচ্ছাচারিতা

চেয়ারম্যান তার একজন লোক নিয়োগ দেবেন—সেজন্য প্রথমে মানবসম্পদ বিভাগ থেকে প্রস্তাবনার ভিত্তিতে অনুমোদন করান জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের জন্য। পরে সে সিদ্ধান্ত পাল্টে একই কাগজে আলাদা লিখে নোট দেন পিএস-১ হিসেবে নিয়োগের জন্য, যার বেতন ধরা হয় ৩০ হাজার টাকা—যা রাজস্ব খাত থেকে দেওয়া হবে। একই নোটে আবার পরিবর্তন করে বেতন ৫০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু নিয়োগের তিন দিনের মাথায় তার বেতন করা হয় ৬৭ হাজার টাকা। কেন, কীভাবে, কোন আইনের ভিত্তিতে করা হলো—সেটির উল্লেখ নেই। এমনকি এগুলো বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নিয়োগ ও বাছাই বিধির পরিপন্থি।

অনুসন্ধানে উঠে আসে, সোহাগ মিয়া একটি ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল প্রতিনিধি ছিলেন। সে সুবাদে বর্তমান চেয়ারম্যান ডা. আজিজুল ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় ও সখ্য গড়ে ওঠে। এমনকি তিনি তার প্রাইভেট চেম্বারে সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। যদিও গত মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চাপে সোহাগকে পদত্যাগ করিয়েছেন চেয়ারম্যান। বস্তুত এখনো এই সোহাগই চালান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এমনকি বিভিন্ন জেলা কমিটি করতে গিয়ে সোহাগ আর্থিক লেনদেন করেন বলে প্রমাণ জাগো নিউজের হাতে এসেছে।

সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিছু বিষয়ে ব্যত্যয় আছে এখানে। আমি আসার পর নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছি। নানা অভিযোগও পেয়েছি। সমাধানেরও চেষ্টা করছি।’

এসইউজে/এএসএ/এমএফএ/এমএস