সম্মান আছে, স্বীকৃতি নেই
স্মৃতিফলকে নাম থাকলেও নেই সরকারি গেজেটে
সিরাজুল ইসলাম (ছেরু) ছিলেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক এই যোদ্ধাকে আরও ১৮/২০ জনের সামনেই গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
সতীর্থ তিন চাক্ষুষ সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা এখনো জীবিত। আঞ্চলিক কমান্ডারও বেঁচে আছেন। সবাই জানে তিনি যুদ্ধে শহীদ। কবরও সংরক্ষিত। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সমাধিস্থলে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ করেছে সরকার। বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) পুরো বরুড়া উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ তার সমাধিসৌধে গিয়ে শ্রদ্ধাও জানাচ্ছেন। অথচ জামুকার গেজেটে তার নাম নেই। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার স্বীকৃতিও নেই। পরিবার পায় না সম্মানি বা কোনো সুযোগ-সুবিধা।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সবাই সম্মান করেন তাকে। কিন্তু স্বীকৃতি বিষয়ে ‘কেউ কিছু জানেন না’। অনেক ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ ভাতা পেলেও কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের সিঙ্গুরিয়া গ্রামের এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে গত ৫৫ বছরেও স্বীকৃতি দেয়নি কোনো সরকার।

গত ১৩ ডিসেম্বর তার যুদ্ধস্থল বরুড়া উপজেলার পয়ালগাছা ইউনিয়নের বটতলী গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একসঙ্গে পাঁচজনের সমাধি রয়েছে। তালিকার এক নম্বরেই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের (ছেরু) নাম। পাশেই বিশাল আকৃতির স্মৃতিস্তম্ভ। ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে ইউনিয়ন চেয়রম্যানের নির্দেশে পাঁচজন গ্রাম পুলিশ মিলে স্মৃতিস্তম্ভ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন।
মোহাম্মদ আলী নামে এক গ্রাম পুলিশের কাছে জানতে চাইলে এ স্মৃতিস্তম্ভের ইতিহাস সম্পর্কে জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সিরাজুল ইসলাম (ছেরু), কাজী আরেফসহ এখানে পাঁচজন শহীদ হন। তারা এখানে শায়িত। তাদের স্মরণে এই শহীদ মিনার।’
বটতলীর স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বয়স তখন ১০ বছর। সেদিন যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর এখানে আসি। প্রথমে দেখছি, বটতলী বাজার হুমায়ুন পাটোয়ারীর যে দোকান এখন, তখন ক্ষেত ছিল। এটার মধ্যে একটা লাশ পড়ে আছে। সবাই মনে করছে পাঞ্জাবি হবে, কারণ অনেক লম্বা ছিল। মূলত সিরাজ ভাই (শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ছেরু)।’

তিনি বলেন, ‘এই সিরাজ ভাই অনেক সম্পদশালী ছিলেন। অথচ তিনি শহীদ হলে তার সম্পদ লুটে নিয়ে গেছে। তার মা মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। উনি দেশের জন্য নিজের ছেলেকে দিয়েছেন, দেশ ওনাকে কী দিয়েছে?’
স্মৃতিস্তম্ভ, সমাধির নামফলক, স্থানীয়দের বক্তব্যের পাশাপাশি গুগলে অনুসন্ধান করেও পাওয়া যায়, ‘কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার পয়ালগাছা ইউনিয়নের বটতলী গ্রাম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন ছিল, যেখানে ১৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাঁচজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এর হলেন- সিরাজুল ইসলাম (ছেরু), কাজী আরিফ হোসেন, মমতাজ উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, জয়নাল আবেদীন। তাদের স্মরণে সেখানে ‘বটতলী শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মিত হয়েছে।’
সেই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তিনজনকে গ্রেফতার করে। তাদের গুলি করে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সুবেদার মেজর সুফির বদান্যতায় তারা বেঁচে ফেরেন। তাদের একজন পয়াগাছার সামছুল আরেফিন চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিরাজ ভাইকে তো আমিসহ আটক আরও ১৮/২০ জনের সামনেই ব্রাশফায়ার করে ঝাঁঝরা করে দিছে। আমি নিজেও স্বীকৃতি পাইনি। কিন্তু সিরাজ ভাই যদি না পেয়ে থাকে, তাহলে এর চেয়ে বড় কষ্টের আর কী হতে পারে?’
আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা ৬ স্লোগান
বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই সশস্ত্র যোদ্ধা নন
শুধু রণাঙ্গনের যোদ্ধারাই মুক্তিযোদ্ধা, বাকিরা সহযোগী
‘মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে যেভাবে উৎসর্গ করেছিলাম, সেভাবে সম্মান পাইনি’
এ বিষয়ে তৎকালীন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (পরবর্তীসময়ে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং এমপি হয়েছিলেন) অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মিলন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বটতলীর যুদ্ধ আমিও করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে তো আমারও স্বীকৃতি ছিল না। একজন সচিব আমাকে ডেকে বলল, ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার লিস্টে আপনার নাম আছে। আপনি যুদ্ধ করছেন। সনদ নিচ্ছেন না কোনো? তখন আমিসহ ৩৩ জনকে সনদ দিছে। ওদের দেয় নাই কেন, জানি না। তবে শহীদ সিরাজুল ইসলামের মা আমার কাছে এসেছিলেন, আমি তাকে সহযোগিতা করেছি। তখন তো তার যে স্বীকৃতি নাই বা সুযোগ-সুবিধা পায় না সেটি আমাকে বলেনি।’
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাগিনা মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার নানা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুর ইসলামের স্বীকৃতির জন্য তার সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তারকে নিয়ে দফায়দফায় জামুকা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এমনকি মন্ত্রীর কাছে গিয়েও সমাধান পায়নি। যেখানে যাই টাকা চায়। টাকা ছাড়া কেউ কাজ করে না। ’

বীর মুক্তিযোদ্ধার আব্দুস সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানেই যাই নাই। কেউ আমাদের দাবিতে সাড়া দেয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং তাদের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় এই স্বীকৃতি হয়নি।’
বর্তমানে বরুড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের আহ্বায়ক সামছুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের উপজেলা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ একটাই- বটতলীর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। সম্মুখযুদ্ধে ওখানে তারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মরণে সেখানেই স্তম্ভ করা হয়েছে। তবে, তাদের স্বীকৃতি হয়েছে কি হয়নি, জানি না।’
জাগো নিউজ অনুসন্ধানে পেয়েছে, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের নাম শহীদ গেজেটে না উঠলেও উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে। আছে লাল মুক্তিবার্তা ও বেসামরিক গেজেটেও। এমনকি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি বাস্তবায়ন কমিটি ৫ নভেম্বর ২০২২ তারিখে তার পরিবারের অনুকূলে ভাতা দিতে সুপারিশও করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তার ‘বেসামরিক গেজেট নম্বর- ১২৪৯ জামুকার সুপারিশকৃত নয় জানিয়ে তার অনুকূলে এ মুহূর্তে সম্মানি ভাতা বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই’ বলে ১২ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে উপজেলাকে জানায়।
এ বিষয়ে জানতে গত বছর মার্চে জামুকায় গেলে তৎকালীন মহাপরিচালক জহুরুল ইসলাম রাহেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি আবার উপজেলা থেকে সুপারিশ করে পাঠাতে বলেন। হয়ে যাবে।’ কিন্তু পরে উপজেলা থেকে সুপারিশ করে পাঠালেও হয়নি।
স্বীকৃতির বিষয়ে বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান রনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন। আমার কাছে তথ্য নেই। জেনে জানাবো। এরপর আর তিনি জানাননি। ফোনও রিসিভ করেনি।’
এ বিষয়ে জানতে দফায় দফায় যোগাযোগ করেও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক শাহিনা খাতুনের বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
এসইউজে/এএসএ/জেআইএম